রাজস্ব আদায়ে এগিয়ে থাকা ভোমরা বন্দর নিয়ে চক্রান্ত

গত অর্থবছরের চেয়ে রাজস্ব আদায় বেড়েছে পৌনে ৩০০ কোটি টাকা। ভারতের কলকাতার সঙ্গে ভোমরা স্থলবন্দরের দূরুত্ব কম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করার কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৯০৭.৫৮ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে

প্রকাশ | ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

শাকিলা ইসলাম জুঁই, সাতক্ষীরা
সাতক্ষীরার ভোমরা শুল্ক স্টেশনে আমদানি কমলেও বেড়েছে রপ্তানি, সেই সঙ্গে বেড়েছে রাজস্ব আদায়। গত অর্থবছরের চেয়ে রাজস্ব আদায় বেড়েছে পৌনে ৩০০ কোটি টাকা। ভারতের কলকাতার সঙ্গে ভোমরা স্থলবন্দরের দূরুত্ব কম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করার কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৯০৭.৫৮ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। যেখানে ৬ লাখ ৫৪ হাজার ৮৯৩ মেট্রিক টন পণ্য কম আমদানি হয়েছিল। কিন্তু তারপরও রাজস্ব আদায় বেড়েছে ২৭৫.৮৬ কোটি টাকা। যার প্রবৃদ্ধির হার ৪৩.৬৭ শতাংশ। দিনদিন রাজস্ব বৃদ্ধির কারণে এই বন্দর নিয়ে আবার চক্রান্ত শুরু হয়েছে। পার্শ্ববর্তী বেনাপেল বন্দরের একটি কুচক্রীমহল সাতক্ষীরা ভোমরা স্থলবন্দরে অস্থিরতা ও ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন দপ্তর ও পত্রপত্রিকায় ভুল তথ্য উপস্থাপন করে সংবাদ প্রচার করে ভোমরা বন্দর ও বন্দর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে বলে দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা। তবে ভোমরা স্থলবন্দরের জমি অধিগ্রহণসহ অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ চলছে। অচিরেই, কাস্টম হাউস, শেড, ইয়ার্ড, প্যাসেঞ্জার টার্মিনালসহ অন্য অবকাঠামো নির্মাণসহ সব ধরনের পণ্য আমদানির কার্যক্রম পুরোদমে ব্যবসায়ীরা শুরু করলে বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকা এই বন্দর থেকে সরকারের রাজস্ব আদায় হবে বলে জানিয়েছে কাস্টম কর্তৃপক্ষ। খোঁজ-খবর নিয়ে ও সরেজমিন জানা গেছে, ১৯৯৬ সালের ১৫ এপ্রিল ১৬টি পণ্য নিয়ে এলসি স্টেশন হিসেবে যাত্রা শুরু করে ভোমরা স্থলবন্দর। ২০১৩ সালে ওয়্যার হাউস নির্মাণের পর ভোমরাকে পূর্ণাঙ্গ স্থলবন্দর করা হয়। দীর্ঘদিন ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে ২৯ আগস্ট বেনাপোল বন্দরের মতো দুধ ব্যতীত আমদানিকৃত সব পণ্যের অনুমতি দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর। সাতক্ষীরার ভোমরা বন্দরের বিপরীতে ভারতে ঘোজাডাঙ্গা কাস্টমস ও কলকতার দূরত্ব বেনাপোল বন্দর থেকে ৩৫ কিলোমিটার কম হওয়ায় আমদানি-রপ্তানিকারকরা এই বন্দরের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হন। দূরত্ব কম, পণ্য পরিবহণে জ্বালানি সাশ্রয় ও সময় বাঁচার কারণে ব্যবসায়ীরা অতি কম সময়ের মধ্যে ভোমরা বন্দর থেকে রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পণ্য সরবরাহ করতে সক্ষম হন। বিশেষ করে আমদানিকৃত আপেল, আঙ্গুর, আনার, টমেটো, কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ ও মাছসহ সব ধরনের পচনশীল দ্রব্য পরিবহণের ক্ষেত্রে সময় কম লাগায় ব্যবসায়ীরা বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে ভোমরা বন্দরে। যে কারণে পার্শ্ববর্তী বেনাপোল বন্দর ছেড়ে ব্যবসায়ীরা এখন বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্থলবন্দর সাতক্ষীরার ভোমরা বন্দরের দিকে ঝুঁকছেন। এখানে পার্শ্ববর্তী বেনাপোল বন্দরের মতো ফলের ট্রাক থেকে শুরু করে সব ধরনের পণ্যবাহী ট্রাক ডিজিটাল স্কেলে নিখুঁতভাবে পরিমাপ করে রাজস্ব নির্ধারণ করা হচ্ছে। ভোমরা শুল্ক স্টেশনের তথ্যমতে, ২০২২-২৩ গত অর্থবছরে রপ্তানীকৃত পণ্যবাহী গাড়ির সংখ্যা ২১ হাজার ৬২৭টি এবং ২০২৩-২৪ চলতি অর্থবছরে রপ্তানীকৃত পণ্যবাহী গাড়ির সংখ্যা ২৪ হাজার ৫৮০টি। যা গত অর্থবছরের তুলনা চলতি অর্থবছরে রপ্তানিকৃত গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ১৩.৬৫%। এ ছাড়া চলতি অর্থবছরে আমদানিকৃত পণ্যবাহী গাড়ি এসেছে ৬৩ হাজার ৯০২টি, যা গত অর্থবছরে ছিল ৮২ হাজার ২২৮টি। গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের পণ্যবাহী গাড়ির সংখ্যা কম এসেছে ১৮ হাজার ৩২৬টি। অপরদিকে গত অর্থবছরে আমদানীকৃত পণ্যের পরিমাণ ছিল ৩০ লাখ ৯ হাজার ৯৫৫ মে.টন এবং চলতি অর্থবছরে আমদানীকৃত পণ্যের পরিমাণ ২৩ লাখ ৫৫ হাজার ৬২ মে.টন। যা গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে আমদানীকৃত পণ্য কম হয়েছে ৬ লাখ ৫৪ হাজার ৮৯৩ মেট্রিক টন। আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বেনাপোল স্থলবন্দরের পরই সাতক্ষীরার ভোমরা স্থলবন্দরের অবস্থান। দিনে গড়ে ২০০ থেকে ২৫০টি ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাকের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ভোগ্যপণ্যসহ আবশ্যকীয় পণ্য ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল পণ্য আমদানি হয়ে থাকে ওই স্থলবন্দর দিয়ে। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রতিদিন গড় ৫০ থেকে একশ পণ্যবাহী ট্রাকে বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি হয়ে থাকে। এ ছাড়া প্রতিদিন ৮০০ থেকে ১০০০ জন পাসপোর্টধারী যাত্রী বাংলাদেশ থেকে ভারত ও ভারত থেকে বাংলাদেশে আসা-যাওয়া করেন। ভোমরা স্থলবন্দরের সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বায়ক হাবিবুর রহমান হাবিব ও ১ নম্বর সদস্য মাকসুদ খান বলেন, ভোমরা স্থলবন্দর প্রতিষ্ঠার পর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের ব্যবসা-বাণিজ্যে ভাগ্য খুলেছে। কলকাতা থেকে ভোমরা বন্দরটি সব থেকে কাছে হওয়ায় আমদানি-রপ্তানিতে ভোমরা বন্দর খুবই গুরত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। দিন দিন ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য এই বন্দরের প্রতি আমদানি-রপ্তানিকারকরা ঝুঁকছে। কিন্তু ব্যবসায়ীদের ভিতর একটি কুচক্রীমহল এই বন্দরের ব্যবসা-বাণিজ্যে অচল অবস্থা সৃষ্টির জন্য সড়যন্ত্র শুরু করেছে। গত ২০ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন অনলাইন নিউজ পোর্টালে ভোমরা বন্দরে অ্যানালগ স্কেলে পণ্যবাহী ফলের ট্রাকের ওজন পরিমাপের মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকির কথা বলে ভুল তথ্য দিয়ে মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করে বন্দরের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। যে খানে জাতীয় শুল্ক গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই, জাতীয় গোয়েন্দা প্রতিরক্ষা সংস্থা ডিজিএফআই ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষের উপস্থিতিতে সম্পূর্ণ ডিজিটাল স্কেলে সব ধরনের পণ্য পরিমাপ করা হয়। কোনো আমদানিকারকের ওজন ফাঁকির কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তারা আরও জানান ভোমরা সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে ভোমরা স্থলবন্দর নিয়ে সড়যন্ত্রমূলক প্রকাশিত নিউজের প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাচ্ছি। এ ছাড়া কাস্টমস হাউস বাস্তবায়নের পাশাপাশি ব্যবসায়ীরা সব ধরনের পণ্য আমদানির কার্যক্রম শুরু করলে এই বন্দরে রাজস্ব আদায় কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। ভোমরার স্থলবন্দরের রাজস্ব কর্মকর্তা (পরিক্ষণ) বাবলুর রহমান জানান, এ বন্দরে ফলের ট্রাকের ওজনসহ সব পণ্য পরিবহণের ওজন জাতীয় শুল্ক গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই, ডিজিএফআইসহ বন্দর ও কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সবার উপস্থিতিতে ডিজিটাল স্কেলের মাধ্যমে শতভাগ নিশ্চিত করা হয়ে থাকে। এখানে অ্যানালগ পদ্ধতিতে কোনো ওজন পরিমাপের সুযোগ নেই। গত ২০ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন নিউজপোর্টালে ভোমরা বন্দরের ওজন ফাঁকির মাধ্যমে রাজস্ব ফাঁকির মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করে বন্দরের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। ভারত থেকে পিটি-১৩২০১১ নাম্বারের যে ট্রাকে করে ভোমরা বন্দরে আপেল প্রবেশের কথা বলা হয়েছে। আদৌ এই নাম্বারের কোনো ট্রাক ভোমরা বন্দরে প্রবেশ করে নাই। বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে মিথ্যাচার করা হয়েছে। ভোমরা স্থলবন্দরের উপ-পরিচালক মো. রুহুল আমিন (ট্রাফিক) জানান, প্রায় ১১শ' কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে ১০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। সেখানে স্যান্ড ফিলিংয়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আরও ৫৮ একর জমি অধিগ্রহণ করা হবে। সেখানে উন্নতমানের ওয়ারহাউস, শেড, ইয়ার্ড, প্যাসেঞ্জার টার্মিনালসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে। এগুলো সম্পন্ন করা হলে ভোমরা স্থলবন্দরে ব্যবস্থা বাণিজ্যে আরও গতি আসবে। বছরের কয়েক হাজার কোটি টাকা সরকারের আরও বেশি রাজস্ব বৃদ্বি পাবে। ভোমরা কাস্টমসের সহকারী কমিশনার মতলেবুর রহমান জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করছে কাস্টমস প্রশাসন। কোনো অনিয়ম দুর্নীতি করার সুযোগ না থাকায় তৈরি হয়েছে ব্যবসাবান্ধব অনুকূল পরিবেশ। বিগত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে ২৭৫.৮৬ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় বেশি হয়েছে। আগামীতে সবার সহযোগিতায় চলতি অর্থবছরে তুলনায় আরও বেশি রাজস্ব আদায় হবে বলে তিনি প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।