সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১
৭২ ঘণ্টা অবরোধের দ্বিতীয় দিন

তিন পার্বত্য জেলায় বন্ধ যান চলাচল, চরম ভোগান্তি

রিপন সরকার, খাগড়াছড়ি
  ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
সড়কে আগুন জ্বালিয়ে পাহাড়িদের বিক্ষোভ -সংগৃহীত

খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে 'পাহাড়ি-বাঙালি' সংঘর্ষে চারজন নিহতের ঘটনার পর 'বিক্ষুব্ধ জুম্ম ছাত্র-জনতা'র ডাকা ৭২ ঘণ্টার অবরোধের দ্বিতীয় দিন রোববার পার্বত্য তিন জেলায় যান চলাচল বন্ধ ছিল। খোলেনি দোকানপাট ও মার্কেট। স্কুল-কলেজ খোলা থাকলেও ছিল না শিক্ষার্থী উপস্থিতি। এদিকে, ৪৬ ঘণ্টা পর রোববার বেলা ১১টায় রাঙামাটি থেকে ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করা হয়েছে। খাগড়াছড়িতে শনিবারই তা প্রত্যাহার করা হয়েছিল।

'পাহাড়িদের ওপর হামলা, খুন ও ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ'-এর প্রতিবাদে রোববার সকালে খাগড়াছড়ি সাজেক সড়ক, পানছড়ি, রামগড় সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে অবরোধকারীরা বিক্ষোভ করেন। অবরোধের কারণে খাগড়াছড়ির সঙ্গে রাঙামাটি, ঢাকা ও চট্টগ্রামের পাশাপাশি জেলার দীঘিনালা, পানছড়ি, মাটিরাঙাসহ আন্তঃউপজেলাগুলোতে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকে।

তবে অবরোধকে কেন্দ্র করে কোথাও কোনো সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি জানিয়ে খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মো. আরেফিন জুয়েল বলেন, 'সহিংসতা এড়াতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সড়কে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশের টহল জোরদার করা হয়েছে।'

এদিকে শুক্রবারের সহিংসতার পর দুই দিন পেরিয়ে গেলেও স্বাভাবিক হয়নি রাঙামাটি শহর। পাহাড়ি শিক্ষার্থীদের ৭২ ঘণ্টার অবরোধের পাশাপাশি পরিবহণ শ্রমিকদের 'অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট' অব্যাহত থাকায় যান চলাচল বন্ধ আছে। ফলে মোটর সাইকেলে করে বা হেঁটেই অফিসে যেতে দেখা গেছে সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।

বনরূপার কাঁচাবাজারে একান্ত বাধ্য হয়ে আসা ক্রেতাদের উপস্থিতির কারণে কিছু মানুষের ভিড় চোখে পড়লেও সড়কে গণপরিবহণ না থাকা স্তব্ধই বলা যায় পুরো শহরকে।

শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা ঠিক সময়ে হেঁটে পৌঁছালেও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি না থাকায় অলস সময় কাটাতে দেখা গেছে আড্ডায়-গল্পে। অফিসগুলোর চিত্রও ছিল প্রায় একইরকম।

রাঙামাটি পৌরসভার জন্মনিবন্ধন শাখার দায়িত্বে থাকা ফিরোজ আল মাহমুদ সোহেল বলেন, 'এমনিতেই প্রতিদিনই আমাদের ভীষণ ব্যস্ত থাকতে হয়। চলমান সংকটের কারণে এবং গাড়ি চলাচল না করায় মানুষজন একেবারেই নেই।'

এদিকে প্রশাসনের এখনো কোনো সাড়া না পাওয়ায় পরিবহণ ধর্মঘট প্রত্যাহার করেননি পরিবহণ মালিক শ্রমিকরা।

অটোরিকশা চালক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বাবু বলেন, 'শুক্রবার ভাঙচুর করা গাড়ি ও চালকদের ক্ষতিপূরণ না দিলে এবং এই বিষয়ে প্রশাসনের কোনো আশ্বাস না পেলে অবরোধ চলতে থাকবে।'

অন্যদিকে নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে রাখা হয়েছে পুরো শহরকে। শহরের মোড়ে মোড়ে দেখা গেছে সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবি ও আনসার সদস্যদের অবস্থান। বেলা ১১টার দিকে জেলা প্রশাসক মোশাররফ হোসেন খান ও পুলিশ সুপার ড. ফরহাদ হোসেন আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন শেষে জানান, শহরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করা হয়েছে।

এদিকে, রাঙামাটি শহরবাসীকে কোনো গুজবে কান না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন রাঙামাটি জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মামুনুর রশীদ ও সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল ইসলাম শাকিল।

চলমান অবরোধের কারণে মেঘের রাজ্য সাজেকে আটকা পড়েছেন অন্তত এক হাজার ৫০০ পর্যটক। পর্যটকদের নিয়ে কোনো গাড়ি ছাড়া হয়নি। পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন রাঙামাটির বাঘাইছড়ির উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শিরীন আক্তার।

নিহত মামুনের স্ত্রীর করা মামলায়

আসামি আ'লীগের পলাতক ৩ নেতা

এদিকে, খাগড়াছড়িতে সংঘর্ষে নিহত যুবক মো. মামুনের স্ত্রী মুক্তা আক্তার বাদী হয়ে থানায় মামলা করেছেন। মামলার এজাহারে মুক্তা তিনজনের নাম উলেস্নখ করেছেন। তারা হলেন- মো. শাকিল, রফিকুল আলম ও দিদারুল আলম। এই তিনজনের মধ্যে রফিকুল আলম আওয়ামী লীগের নেতা ও খাগড়াছড়ি পৌরসভার সাবেক মেয়র। আরেক আসামি দিদারুল ও মো. শাকিলও আওয়ামী লীগের নেতা। এই তিনজনসহ ১০ থেকে ১২ জন অজ্ঞাতনামা 'উপজাতি ও বাঙালি'র কথাও আসামি হিসেবে উলেস্নখ করেছেন তিনি। তিন আসামিই গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে পলাতক।

গত বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) খাগড়াছড়ি সদরে মোটর সাইকেল চুরিকে কেন্দ্র করে গণপিটুনিতে মো. মামুন (৩০) নামের এক বাঙালি যুবকের মৃতু্য হয়। পরদিন বৃহস্পতিবার বিকালে এ হত্যার প্রতিবাদে দীঘিনালায় বাঙালিরা বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। বাঙালিদের অভিযোগ, মিছিলটি বোয়ালখালী বাজার অতিক্রম করার সময় পাহাড়িরা বাধা দিলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, সংঘর্ষের একপর্যায়ে দীঘিনালার লারমা স্কয়ারে বিভিন্ন দোকান ও বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়।

দীঘিনালা উপজেলায় সংঘর্ষের জেরে খাগড়াছড়ি জেলা সদর, পানছড়ি ও আশপাশের এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বৃহস্পতিবার রাতে খাগড়াছড়ি জেলা সদরে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষ ও গুলির ঘটনায় তিনজন নিহত হন। আহত হন অন্তত ১৫ জন। নিহত ব্যক্তিরা হলেন- জুনান চাকমা (২০), ধনঞ্জয় চাকমা (৫০) ও রুবেল ত্রিপুরা (৩০)। গত শুক্রবার রাঙামাটিতেও উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে পাহাড়ি ও বাঙালিদের সংঘর্ষে নিহত হন অনিক কুমার চাকমা। তিনি কর্ণফুলী ডিগ্রি কলেজের স্নাতকের শিক্ষার্থী। আহত হন অন্তত ৫৫ জন।

গণপিটুনিতে বাঙালি যুবক মামুনের মৃতু্যর পর এমন রটনা হয় যে পাহাড়িদের গণপিটুনিতেই ওই যুবকের মৃতু্য হয়েছে। এরপরই যত সংঘাত ও চারজন নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে।

মুক্তা আক্তার রোববার ফোনে বলেন, 'আমার স্বামীকে হত্যার পেছনে বাঙালি ও পাহাড়ি দোনোটাই আছে। উপজাতিদের (পাহাড়ি) চিনি নাই, তাই তাদের নাম দিই নাই।'

খাগড়াছড়ি সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আবদুল বাতেন মৃধা বলেন, মো. শাকিল, রফিকুল আলম ও দিদারুল আলমের নাম উলেস্নখ করে মামলা হয়েছে। এখন বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। এ নিয়ে আর কোনো কথা বলতে চাই না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে