সরকার পতনের পর থেকে শিথিল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সুযোগে অলিগলি থেকে বেরিয়ে রাজধানীর মূল সড়ক দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজিবাইক। গত ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর ভেঙে পড়া পুলিশি ব্যবস্থার সময়ে কিছুদিন ছাত্র-জনতা নিজেদের উদ্যোগে রাস্তায় যান চলাচল নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছেন। সে সময় অননুমোদিত এসব রিকশার মূল সড়কে চলাচলে বাধা দিতে তাদেরকে আপ্রাণ চেষ্টা করতে দেখা গেছে। কিন্তু এরপর ধীরে ধীরে রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ নামলেও ব্যাটারিচালিত রিকশা চলছে অনেকটাই বাধাহীনভাবে।
এসব অদক্ষ চালকের এলোমেলো চলাচল, আইন না মানার প্রবণতা, উল্টোপথে চলা, যেখানে-সেখানে হুটহাট রিকশা ঘোরানো- সব মিলিয়ে রাজধানীতে রাস্তায় প্রতিদিনই সৃষ্টি হচ্ছে বিশৃঙ্খলা।
রাজধানীর মূল রাস্তায় ব্যাটারিচালিত রিকশা-ইজিবাইকের দাপট এতটাই বেড়েছে যে, এসবের চলাচল বন্ধে কিছুদিন আগে বিক্ষোভে নামেন পায়েচালিত রিকশার চালকরা। ব্যাটারিচালিত রিকশা-ইজিবাইকের দৌরাত্ম্য নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে কথা হলেও কোনোভাবেই এসব বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।
সবশেষ গত ১৫ মে ঢাকার সড়কে ব্যাটারিচালিত কোনো রিকশা চলাচল করতে পারবে না বলে ঘোষণা আসে। সেদিন বিআরটিএ ভবনে সড়ক পরিবহণ উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম সভায় সে সময়ের সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, 'ব্যাটারিচালিত কোনো গাড়ি যেন ঢাকা সিটিতে না চলে। আমরা ২২টি মহাসড়কে নিষিদ্ধ করেছি। শুধু নিষেধাজ্ঞা নয়, চলতে যেন না পারে সে ব্যবস্থা নিতে হবে।'
এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ঢাকায় রাস্তা অবরোধ করেন চালক ও গ্যারেজ মালিকরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে সংক্ষুব্ধ চালকদের সংঘর্ষে বেশ কয়েকজনের আহত হওয়ার ঘটনাও ঘটে।
এরপর ২০ মে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন বলেছিলেন, (সাবেক) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে না জানিয়েই সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সেদিন তিনি বলেন, রাজধানীতে এসব রিকশা চলতে পারবে, কিন্তু প্রধান সড়কগুলোয় এসব রিকশা আসতে পারবে না। এর আড়াই মাসের মাথায় ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরই পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এসব রিকশা-ইজিবাইক।
রাস্তায় হ-য-ব-র-ল :রাজধানীর মিরপুর, ধানমন্ডি, শ্যামলী, মহাখালী ও বাড্ডা এলাকায় সম্প্রতি ঘুরে প্রায় সব মূল রাস্তায় অসংখ্য ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইক চলতে দেখা গেছে। এসব অটোরিকশা যখন-তখন দ্রম্নতগতির যানবাহনের সামনে চলে আসছে; কোথাও হঠাৎ করেই বাঁক নিচ্ছে, এতে পেছনের যানবাহনের চালকরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন। আবার দ্রম্নতগতিতে সড়কে উল্টোদিকে চলে, এতে অন্যান্য যানবাহনের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে।
ঢাকার আগারগাঁওয়ে কথা হয় ব্যাটারিচালিত রিকশার চালক মঞ্জুর হোসেনের সঙ্গে। মিরপুর ১২ নম্বর থেকে যাত্রী নিয়ে আসা মঞ্জুর বলেন, আগে শুধু রাতে মূল রাস্তায় উঠতেন। এখন পুলিশ কিছু বলে না, তাই সব রাস্তাতেই চালাচ্ছেন।
তিনি বলেন, 'এখন আগের মতো পুলিশ আর ধরে না। এজন্যই সব রাস্তায় চালাইতে পারি। বড় রাস্তায়ও এখন ট্রিপ মারি। বড় রাস্তায় আসলে বড় গাড়ির সমানে যাওয়া লাগে, এইটা নিরাপদ না আমরাও মানি। কিন্তু মেইন রাস্তায় আইলে দূরের ট্রিপ পাওয়া যায়। ইনকাম কিছুটা বেশি হয়।'
ব্যাটারিচালিত রিকশাকে 'ইঞ্জিনের গাড়ি' দাবি করে বাড্ডা এলাকায় ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক হুমায়ুন কবির বলেন, 'সিএনজিওয়ালারা (অটোরিকশা) মেইন রাস্তায় চালাইতে পারলে আমরাও পারমু। হেরা ইঞ্জিনের গাড়ি চালায়। আমরাও ইঞ্জিনের গাড়ি চালাই।'
এসব রিকশা, ইজিবাইকের কারণে ঢাকার রাস্তা অনিরাপদ হয়ে উঠেছে বলে মনে করছেন বিভিন্ন যানবাহনের চালক ও যাত্রীরা। এ অবস্থার জন্য ট্রাফিক পুলিশের নিয়ষ্ক্রিয়তাকে দায়ী দিলেন সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক নাজমুল হোসেন।
তিনি বলেন, 'পুলিশ এখন ডিউটি দেয় না বলে তারা এখন স্বাধীনতা পাইয়া গেছে। তারা এখন যেকোনো রাস্তায় উইঠা যাইতাছে, ত্যাড়া-ব্যাকা (এলোমেলো) কইরা আহে, যেমনে খুশি তেমনে ওভারটেক করে। অটো যদি চলে তাইলে শহরের যানজট কমত না। এরা খুব জোরে রিকশা চালায়। ডানে, বামে না দেইখাই টার্ন মারে (ঘোরে)। এ কারণে পিছনে থাকা গাড়ির ড্রাইভারদের খুব সমস্যা হয়। অ্যাকসিডেন্টের রিস্ক থাকে।'
মিরপুরের বাসিন্দা বুলবুল আহম্মেদ বলেন, 'একটা সময় মেইন রোডে চলার কারণে ব্যাটারিচালিত রিকশাকে জরিমানা করা হতো, ডাম্পিং করা হতো। এখন এসব বন্ধ আছে। রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশও কম। এদের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।'
মূল রাস্তায় ব্যাটারিচালিত রিকশার চলাচল করা 'খুবই মারাত্মক' বলছেন মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা আলিফ খান। তিনি বলেন, 'এসব রিকশায় দিকনির্দেশনা দেওয়ার কোনো লাইট নাই। এতে পেছনের যানবাহনের চালকরা রিকশার গতিবিধি বুঝে উঠতে পারে না। আবার এসব রিকশার সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় ৩০ থেকে ৩৫ কিলোমিটার, ফলে পেছনের গাড়িরও গতি কমিয়ে দিতে হয়। এতে সড়কে যানজট সৃষ্টি হয়।'
পুলিশ কী করছে?
সরকারের পালাবদলের পর নানা সীমাবদ্ধতায় যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে শিথিলতার কথা স্বীকার করছেন রাস্তায় দায়িত্ব পালন করা ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা।
শ্যামলীতে একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট বলেন, 'এখন সময়টা এমন, কেউ কারও কথা শুনছে না, চারদিকেই বিশৃঙ্খল অবস্থা। সড়কে অটোরিকশা চলে আসছে। তারা স্বাধীনতা পেয়ে গেছে, উল্টাপাল্টা চালায়। আর এখন আমাদের ফোর্সও কম। প্রসিকিউশন দেওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া যাচ্ছে না। ঢাকার কোনো সড়ক নেই- যেখানে এখন এসব রিকশা চলছে না।'
ব্যাটারিচালিত রিকশা নিয়ন্ত্রণে ফের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) খন্দকার নাজমুল হাসান। তিনি বলেন, 'ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলো সড়কে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে বিষয়টি আমাদেরও নজরে এসেছে। কোথাও কোথাও তারা সড়কের চার লেইনের তিনটিও দখল করে ফেলছে। আমাদের ট্রাফিক পুলিশের ফোর্স সবাই মাঠে আছে। কিন্তু এদের অনেকেই নতুন দায়িত্ব পেয়েছেন, এজন্য বিষয়গুলো বুঝতেও কিছুটা সময় লাগছে। আমিও গতকাল মাত্র জয়েন করলাম। আশা করছি কিছুদিনের মধ্যেই একটা দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখতে পারবেন।'
সমাধান কোন পথে?
রিকশা, ব্যাটারি রিকশা, ইজিবাইক সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক খালেকুজ্জামান লিপন দাবি করেছেন, তাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে চালকদের মূল সড়কে উঠতে মানা করা হয়েছে।
যদিও রাস্তায় ঘুরে তার দাবির পক্ষে সত্যতা পাওয়া যায়নি।
তিনি বলেন, 'আমাদের নির্দেশনা ছিল প্রধান সড়ক ছাড়া বাকি সড়কগুলোতে চলাচল করবে। আমরা এরইমধ্যে আমাদের সমিতিগুলোর মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় জানিয়ে দিয়েছি, চিঠি দিয়েছি। তবে এখন রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশরা কোনো বাধা দিচ্ছে না। এ কারণে ইনডিসিপিস্নন্ড চলছে।'
এ ক্ষেত্রে ট্রাফিক পুলিশকে আরও সক্রিয় হওয়ার আহ্বান রেখে তিনি বলেন, 'এনফোর্সমেন্ট এজেন্সির লোক যদি বলেন আপনারা এইদিকে আর আইসেন না, তাহলে হয়তো তারা আর আসবে না।'
এসব যানবাহন ঝুঁকিপূর্ণ হলেও গণপরিবহণের মান ও অপ্রতুলতার কারণে এগুলো রাস্তায় চলছে, মানুষও তাতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে বলে মনে করেন বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক সাইফুন নেওয়াজ।
তিনি বলেন, 'এরা একদিকে যেমন যানজট তৈরি করছে, অন্যদিকে দুর্ঘটনারও কারণ হচ্ছে। মূল সড়কে রিকশা চলার কারণে গতির তারতম্য তৈরি হয়, যা ফ্লিট স্পিড কমিয়ে দেয়। ব্যাটারিচালিত রিকশার গতি তার কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্য নয়, তাই এগুলো ঝুঁকিপ্রবণ।'
ঢাকা শহরে রিকশা চলাচলে শৃঙ্খলা আনতে কিছু সুপারিশ করেছেন এই পরিবহণ বিশেষজ্ঞ। এজন্য প্রথম ধাপে কয়েকটি মূল রাস্তায় সড়কে রিকশা চলাচলের বন্ধ বা চলাচলের সময় নির্ধারণ করে দিতে হবে। রিকশাগুলোকে এলাকাভিত্তিক রঙ করে দিতে হবে।
তিনি বলেন, 'পিক আওয়ারে চিহ্নিত মূল সড়কে চলতে পারবে না- এটি নিশ্চিত করতে হবে। একটি জরিপ করে রিকশা চলাচলের রুট নির্ধারণ করে চলাচল ও সংখ্যা একটি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। ক্রমান্বয়ে মূল সড়ক কীভাবে ধাপে ধাপে রিকশামুক্ত করা যায় সে বিষয়টিও পরিকল্পনায় থাকতে হবে। এলাকাভিত্তিক নির্দিষ্ট রঙ থাকলে এক এলাকার রিকশা অন্য এলাকায় ঢুকলে সহজে চিহ্নিত করা যাবে।' সূত্র: বিডি নিউজ