দারার বিরুদ্ধে শত কোটি টাকা বাণিজ্যের অভিযোগ
প্রকাশ | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
রাজশাহী অফিস
রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ মেয়াদের স্থানীয় সরকার, পলস্নী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী আব্দুল ওয়াদুদ দারার বিরুদ্ধে শত কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। এমপি-প্রতিমন্ত্রীর হওয়ার পর নির্বাচনি এলাকায় উন্নয়ন না হলেও উন্নতি হয়েছে তার পরিবারের সব সদস্যের। হয়েছে বিলাসবহুল বাড়ি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১০ বছরে পুঠিয়া ও দুর্গাপুর উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় ৭০০ নিয়োগ হয়। এর মধ্যে পুঠিয়ায় বিভিন্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক ও প্রধান শিক্ষক পদে ২১৭ জন, কলেজের প্রভাষক পদে ১৮৭ জন এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নৈশপ্রহরী কাম পিয়ন পদে ৩১ জনের নিয়োগ হয়েছে। দুর্গাপুরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ হয়েছে ২০৮ জনের। এ ছাড়া পুলিশের কনস্টেবল পদেও কয়েকজনের নিয়োগ হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, শুধু নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমেই তিনি শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন।
এমপি হওয়ার আগে রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার বিড়ালদহ গ্রামে মাটির ঘরে বসবাস করতে তিনি। বর্তমানে সেখানে তিন ভাইয়ের জন্য পাশাপাশি তিনটি দোতলা বিলাসবহুল ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। মেয়েকে যুক্তরাজ্যে রেখে লেখাপড়া করাচ্ছেন। সেখানে তিনি টাকা পাচার করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। তার বাবা আওয়াল কাজী ছিলেন নিকাহ রেজিস্ট্রার।
নির্বাচনী হলফনামায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালে প্রথমবার এমপি হওয়ার আগে আব্দুল ওয়াদুদ দারা এবং স্ত্রীর অস্থাবর সম্পদ ছিল ৯২ লাখ ৪৫ হাজার টাকার। এর মধ্যে দারার ৭০ লাখ ৩৫ হাজার এবং স্ত্রীর ২২ লাখ ১০ হাজার টাকার। কিন্তু ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে সেটি বেড়ে দাঁড়ায় ১৪ কোটি ৭২ লাখ টাকায়। এর মধ্যে দারা ৯ কোটি ৭৪ লাখ টাকার অস্থাবর সম্পদের মালিক। তার স্ত্রীর ৪ কোটি ৯৪ লাখ টাকার অস্থাবর সম্পদ রয়েছে।
অস্থাবর সম্পদের মধ্যে রয়েছে তার নিজের নগদ ২ কোটি ২১ লাখ এবং স্ত্রীর ৫ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। ব্যাংকে জমা আছে নিজের ২ লাখ ৯১ হাজার, স্ত্রীর ৩১ লাখ ৫৫ হাজার এবং নির্ভরশীলদের ৫ লাখ ৭২ হাজার টাকা। এছাড়াও ২০০৮ সালে একটি পোশাক কারখানার দারার শেয়ার ছিল ১৪ লাখ টাকা। ২০২৪ সালে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে নিজের নামে ৪ কোটি ৮৩ লাখ ও স্ত্রীর ২ কোটি ২০ লাখ টাকার।
স্থানীয়দের অভিযোগ, দারা এমপি থাকাকালীন তার এবং পরিবারের বিরুদ্ধে যারা গিয়েছেন তাদের একের পর এক হত্যার শিকার হতে হয়েছে। আর যারা হত্যার শিকার হয়েছেন তারা সবাই তার বাড়ির আশপাশের লোকজন। নিহতরা হলেন আবু দাউদ ও তার ছেলে নুহু। তার চাচাতো ভাই রয়েল। চাল ব্যবসায়ী আবুল ও তার স্ত্রী।
এ আসনে ১৫০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এমপি নির্বাচিত হয়ে প্রথমে এ আসনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নতুন ভবন নির্মাণ করে দেওয়ার নামে কমিশন নেওয়ার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। তার ১০ বছরে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সর্বনিম্ন ১০ জন করে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রতিটি চাকরি প্রার্থীর কাছ থেকে ৫ লাখ থেকে ২০ লাখ পর্যন্ত টাকা নেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
দারার চাচা বিড়ালদহ বালিকা বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক আলীউজ্জামান মুন্টু
শিক্ষা-বাণিজ্যের প্রধান ছিলেন বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয়রা। তারা জানান, দুই উপজেলা থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ নেওয়ার জন্য দারা এমপির বাড়িতে টাকার চুক্তি করতে আসতেন। নিয়োগ প্রত্যাশীদের কাছে চুক্তির ব্যাপারে কথা বলতেন মুন্টু। তখন মুন্টুর উপাধি ছিল শিক্ষামন্ত্রীর নাম। দারা যতদিন এমপি ছিলেন ততদিন তার প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে শিক্ষকদের উপস্থিত থাকা বাধ্যতামূলক ছিল।
মুন্টু ছাড়াও শিক্ষা-বাণিজ্যের চুক্তি করতেন উপজেলা যুবলীগের সভাপতি এবং সাবেক মেয়র রবিউল ইসলাম রবি, ধোপাপাড়া বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মতিউর রহমান মুন্টু। আর তার চাচাতো ভাই শরীফ কাজী নিয়ন্ত্রণ করতেন দুই উপজেলা পলস্নী বিদু্যৎ বিষয়ের বাণিজ্য। কোনো এলাকায় নতুন বিদু্যৎ সংযোগ দিলে তাদের আয় হবে, তা দেখভালের দায়িত্ব ছিল তার। এছাড়াও দারার আরেক চাচাতো ভাই রিপন টানা ১০ বছর উপজেলা পর্যায়ের সব টেন্ডার নিয়ে নিজে কাজ করতেন বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পুঠিয়া-দুর্গাপুর নির্বাচনি এলাকায় সরকারি কয়েকশ' খাস পুকুর রয়েছে। প্রতিবছর পুকুরগুলো পানির দামে ইজারা দিয়ে দারা কোটি আয় করেছেন। দুই উপজেলার কাবিখা-কাবিটারসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজের প্রকল্পের ৪০ শতাংশ টাকা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসের মাধ্যমে তিনি নিতেন। সমেন ঘোষ নামে একজনকে মাস্টার রোলে ওই অফিসে নিয়োগ দেওয়া হয়। সমেন প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসের কমিশনের টাকা উঠিয়ে দারাকে দিতেন। সেই সমেনও বর্তমানে কোটিপতি।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও পুঠিয়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, 'আব্দুল ওয়াদুদ দারা শুধু শিক্ষা খাত থেকে কয়েকশ' কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তার দুঃশাসনে পুঠিয়া-দুর্গাপুরের মানুষ বাকরুদ্ধ হয়েছিল। কারও কিছু বলার সাহস ছিল না দারাসহ তার লোকজনের বিরুদ্ধে।'
রাজশাহী-৫ আসনে ২০০৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত দুই মেয়াদে ১০ বছর এমপি ছিলেন। ২০২৪ সালের নির্বাচনে সংসদ সদস্য হয়ে প্রতিমন্ত্রী হন তিনি। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকার পতনের পর আত্মগোপনে চলে যান আব্দুল ওয়াদুদ দারা। তার বিরুদ্ধে পুঠিয়া ও দুর্গাপুরে হত্যাসহ চারটি মামলা হয়েছে।