নিম্নচাপের প্রভাব

ভারী বর্ষণ :৮ জেলার নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা

দ্বীপ হাতিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন উপকূলে ফেরেননি তিন শতাধিক জেলে চট্টগ্রামে সরকারি কর্মকর্তাদের ছুটি বাতিল

প্রকাশ | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
ভারী বৃষ্টিপাতে শনিবার ভোরে চট্টগ্রামের বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোডে ভূমি ধসের ঘটনা ঘটে -যাযাদি
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট স্থল নিম্নচাপ ও সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভারী বর্ষণ হচ্ছে। একই সঙ্গে ভারী বর্ষণ অব্যাহত আছে উজানে। এতে চট্টগ্রাম, ঢাকা, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের নদীর পানি বাড়ার আভাস দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র। একই সঙ্গে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, ফেনী, কুমিলস্না, নোয়াখালী ও লক্ষ্ণীপুর জেলার নিম্নাঞ্চল ডুবে যাওয়ার পাশাপাশি পাহাড় ধসের আশঙ্কার কথাও জানিয়েছে সংস্থাটি। এদিকে বৈরী আবহাওয়ার কারণে উপকূলীয় এলাকার একাধিক রুটে নৌ চলাচল রয়েছে। সাগর উত্তাল থাকায় বরগুনার পাথরঘাটার তিন শতাধিক জেলে উপকূলে ফিরতে পারেননি। বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন মেঘনা নদী উত্তাল থাকায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে দ্বীপ হাতিয়া। অন্যদিকে, বন্যার আশঙ্কায় চট্টগ্রাম বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। আবহাওয়া সংস্থাগুলোর বরাত দিয়ে শনিবার বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নিয়মিত বুলেটিনে বলা হয়েছে, উজানে ভারী বৃষ্টির কারণে আগামী ২৪ ঘণ্টা চট্টগ্রাম বিভাগের নদীর পানি দ্রম্নত বাড়তে পারে। আর ঢাকা, বরিশাল ও খুলনা বিভাগের নদীর পানি স্থিতিশীল থাকলেও ভারী বৃষ্টির কারণে আগামী দুই দিন এই তিন বিভাগের নদীর পানি বাড়তে পারে। আবহাওয়া অফিস জানায়, স্থল নিম্নচাপটি সকালে যশোর ও এর আশপাশের এলাকায় অবস্থান করছিল। এর প্রভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টি ঝরছে। তবে রোববার থেকে বৃষ্টি কমে আসবে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। বাংলাদেশের উজানে পাহাড়ি ঢল আর অতি ভারী বৃষ্টির কারণে গত ২০ আগস্ট থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। দ্রম্নতই তা ছড়িয়ে যায় ফেনী, কুমিলস্না, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্ণীপুর ও কক্সবাজারে। বুলেটিনে বলা হয়, চট্টগ্রাম বিভাগের মুহুরী, ফেনী ও মাতামুহুরী নদীর পানি কমলেও গোমতী নদীর পানি স্থিতিশীল আছে। অন্যদিকে হালদা ও সাঙ্গু নদীর পানি বাড়ছে। তবে দেশের সব প্রধান নদীর পানি এখন বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পূর্বাভাস কেন্দ্র বলছে, রংপুর বিভাগের তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদীর পানি স্থিতিশীল আছে। আগামী ৩ দিন এসব নদীর পানি ধীরগতিতে কমে বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে। আর সিলেট বিভাগের সুরমা ও কুশিয়ারা, মনু, সারিগোয়াইন, ধলাই নদীর পানি কমছে। তবে খোয়াই নদীর পানি স্থিতিশীল আছে। আগামী ৩ দিন এসব নদীর পানি কমতে পারে এবং বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে বলা হয় বুলেটিনে। চট্টগ্রাম লিংক রোডে ভূমিধস চট্টগ্রাম বু্যরো জানায়, শনিবার ভোরে চট্টগ্রামের বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোডে ৬ নম্বর ব্রিজের কাছে ভূমি ধসের ঘটনা ঘটেছে। এতে বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। তবে এ সময় সড়কে যানবাহন ও পথচারী চলাচল না থাকায় কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। সিডিএর সহকারী প্রকৌশলী ও বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোডের প্রকল্প পরিচালক আসাদ বিন আনোয়ার বলেন, বৃষ্টির কারণে রাস্তার পাশের পাহাড় থেকে মাটি ধসে রাস্তার ফৌজদারহাটগামী লেনের ওপর পড়ে। সড়কের ক্ষতিগ্রস্ত অংশে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। মাটি সরিয়ে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক করার কাজ চলছে। এদিকে বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, বন্যার আশঙ্কায় জেলার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। পাথরঘাটায় ফেরেননি ৩ শতাধিক জেলে বৈরী আবহাওয়ার কবলে পড়ে এখনো সাগর থেকে উপকূলে ফিরে আসতে পারেননি ২০ ট্রলারসহ তিন শতাধিক জেলে। তারা কোনো নিরাপদ আশ্রয়ে আছেন কি না সেই তথ্যও দিতে পারছে না ট্রলার মালিক সমিতি। বরগুনা জেলা মৎস্যজীবী ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, 'বঙ্গোপসাগর উত্তাল রয়েছে। গত দুদিনে যেসব জেলে ফিরে এসেছেন তারা জানিয়েছেন সাগরে প্রচন্ড ঢেউ, ট্রলার নিয়ে সাগরে থাকা মুশকিল। এখন পর্যন্ত পাথরঘাটার ২০টি ট্রলার ফিরে আসতে পারেনি, ওইসব ট্রলার কোনো জায়গায় নিরাপদে আছে কি না তাও জানতে পারছি না। এছাড়া পাথরঘাটায় বিদু্যৎ না থাকায় মোবাইলফোন বন্ধ বিধায় পরিবারের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে পারছি না।' যশোরে ১০৯ মিমি বৃষ্টিপাত রেকর্ড স্টাফ রিপোর্টার, যশোর জানান, নিম্নচাপের প্রভাবে যশোর অঞ্চলে ভারী বর্ষণ অব্যাহত আছে। শুক্রবার সকাল থেকে শনিবার বিকাল পর্যন্ত যশোরে ১০৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। অব্যাহত বৃষ্টিপাতের কারণে যশোরের অনেক নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হয়েছে। টানা বর্ষণে দুর্ভোগে পড়েছেন নিম্নআয় ও জলাবদ্ধ এলাকার মানুষ। এদিকে, অব্যাহত এই বৃষ্টিপাতে যশোরের বেজপাড়া, টিবি ক্লিনিকপাড়া, স্টেডিয়ামপাড়া, শংকরপুর, মিশনপাড়া, উপশহর, চাঁচড়া, কারবালা, এমএম কলেজ এলাকা, নাজিরশংকরপুর, বকচর, আবরপুরসহ শহরের নিম্নাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। শংকরপুর, বেজপাড়া, খড়কি, কারবালা, স্টেডিয়ামপাড়ার অনেক বাড়িঘরে পানি প্রবেশ করেছে। শহরের শংকরপুর বটতলা এলাকার বাসিন্দা লিটন হোসেন জানান, তাদের এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। আগে ড্রেনের মাধ্যমে এই পানি হরিণার বিলে নেমে যেত। এখন সেখানে বড় বড় বিল্ডিং হওয়ায় ড্রেন বন্ধ হয়ে গেছে। পানি নামতে পারছে না। কিন্তু শহরের পানি এই এলাকায় এসে জমা হচ্ছে। একই এলাকার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, আগে শহরের পানি হরিণার বিল দিয়ে মুক্তেশ্বরী নদীতে যেত। কিন্তু ২০১০ সালে হরিণার বিলে মেডিকেল কলেজ হওয়ার পর আশপাশে আরো অনেক স্থাপনা গড়ে উঠেছে। এতে বিল দিয়ে পানি আগের মতো নিষ্কাশিত হতে পারছে না। ফলে এই এলাকা বৃষ্টি হলেই তলিয়ে যাচ্ছে। বেজপাড়া কবরস্থান এলাকার বাসিন্দা ফিরোজ আহমেদ জানান, তাদের এলাকার ড্রেন উপচে নোংরা পানি রাস্তায় থই থই করছে। অনেকের বাড়িঘরে পানি ঢুকে পড়েছে। ড্রেনগুলো পরিষ্কার না করায় বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন হচ্ছে না। এজন্য পানি নামতে না পারায় গোটা এলাকায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। নৌযান চলাচল বন্ধ, বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হাতিয়া বৈরী আবহাওয়ায় ঢাকা থেকে উপকূলীয় অঞ্চলের তিন নৌপথের নৌযান চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। বিআইডবিস্নউটিএ জানায়, উপকূলীয় অঞ্চলসহ সারাদেশে চলমান বৈরী আবহাওয়া ও অভ্যন্তরীণ নৌপথে ২ নম্বর সংকেত এবং সমুদ্র বন্দরে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্কতা সংকেত ছাড়াও নদীতে প্রচন্ড রোলিং বিদ্যমান। এ কারণে যাত্রীদের জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে ঢাকা থেকে হাতিয়া ও বেতুয়াগামী এবং বেতুয়া ও হাতিয়া থেকে ঢাকাগামী, ঢাকা থেকে খেপুপাড়গামী এবং খেপুপাড়া থেকে ঢাকাগামী এ তিনটি উপকূলীয় অঞ্চলের নৌপথের নৌযান চলাচল বন্ধ রাখার ঘোষণা করা হয়েছে। অপরদিকে আরিচা-পাটুরিয়া-কাজিরহাট নৌপথের সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ করা হয়েছে। আশুগঞ্জ-ভৈরব বাজারসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নৌপথে বৈরী আবহাওয়ায় চলাচল অনুপযোগী নৌযানসমূহকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখা হয়েছে। বর্ষণে নোয়াখালীতে বন্যা, দ্বীপ হাতিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন নিম্নচাপের প্রভাবে শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে নোয়াখালীর বিভিন্ন এলাকায় মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। এতে বন্যা-পরবর্তী জলাবদ্ধতা আবারও বন্যায় রূপ নিচ্ছে। অধিকাংশ সড়ক ও বাড়িঘর ফের ডুবতে শুরু করেছে। আতঙ্ক বাড়ছে পানিবন্দি ও বানভাসিদের মাঝে। জেলা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম জানান, শনিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় মাইজদীতে ১২৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। নিম্নচাপের প্রভাবে নদী ও সাগর উত্তাল রয়েছে। শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে শনিবার সকাল পর্যন্ত বঙ্গোপসাগর ও মেঘনা নদীর মোহনায় ১০টি মাছ ধরার ট্রলার ডুবেছে। এখন পর্যন্ত এসব ট্রলারের ১১২ জন জেলেকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। এখনো নিখোঁজ রয়েছেন অনেকে। হাতিয়ার জাহাজমারা ইউনিয়নে গাছচাপায় সিএনজি অটোরিকশায় থাকা একজনের মৃতু্যর খবর পাওয়া গেছে। এখনো তার পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেনি প্রশাসন। জেলা প্রশাসকের তথ্য মতে, নোয়াখালীর ৮ উপজেলার ৮৭ ইউনিয়নের ১১ লাখ ৫৫ হাজার ৩০০ মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছেন। হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শুভাশিষ চাকমা বলেন, 'বৈরী আবহাওয়ায় হাতিয়ার প্রায় ১০টি ট্রলার ডুবে ৩০ জনের অধিক জেলে নিখোঁজ আছেন। দ্বীপ হাতিয়ার সঙ্গে আমাদের সব ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। কেউ হাতিয়ায় আসতে পারছেন না আবার যেতেও পারছেন না।' খালি হাতে ঘাটে ফিরেছেন কুতুবদিয়ার জেলেরা কুতুবদিয়া (কক্সবাজার) প্রতিনিধি জানান, নিম্নচাপের প্রভাবে সাগর উত্তাল থাকায় কুতুবদিয়ার জেলেদের মাছ ধরার নৌকাগুলো ঘাটে ফিরেছে। বৈরী আবহাওয়ার কারণে মাছ না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরছেন তারা। উত্তর ধূরুং ইউনিয়নের আকবর বলী মৎস্য ঘাটের জেলে শাহজাহান, আব্দুল করিম, রাজু ও হোছাইন বলেন, 'মাছ ধরার নৌকায় প্রয়োজনীয় বরফ-তেল ও তাদের জন্য খাদ্যদ্রব্য নিয়ে সাগরে যায়। কিন্তু বৈরী আবহাওয়ার কারণে মাছ ধরতে না পারলে, ক্ষতির কথা চিন্তা করে কয়েক ঘণ্টা থাকলেও, ক্রমেই সাগর বেশি উত্তাল হওয়ায় জীবনের নিরাপত্তায় ঘাটে চলে এসেছি।'