প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে ঘর-বাড়ি পানিতে তলিয়ে থাকায় দেশের পূর্বাঞ্চলের তিন জেলা ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিলস্নায় কয়েক লাখ শিক্ষার্থীর বই-খাতাসহ শিক্ষা উপকরণ নষ্ট হয়েছে। শিক্ষার্থীরা বলছে, অকস্মাৎ বন্যায় কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছিল যে, পরিবারের সবাইকে এক কাপড়ে বাসা থেকে বেরিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বাধ্য করেছিল। আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার সময় ঘর থেকে কোনো কিছুই আর বের করা যায়নি। বন্যার পানির স্রোতে অন্যান্য জিনিসপত্রের সঙ্গে তাদের বই-খাতা, কাপড় সব ভেসে গেছে। আর বই-খাতা হারিয়ে এখন বিপাকে পড়েছে এসব শিক্ষার্থী।
ফেনীর গিরিশ-অক্ষয় একাডেমি স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র তানজিমদের বাড়ি পৌরসভার সাত নম্বর ওয়ার্ডের একাডেমি রোডে। তানজিমের পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল তারই স্কুলের তিনতলা ভবনের দ্বিতীয় তলায়। টানা এক সপ্তাহ তাদের বাড়িতে পানি ছিল মাথার ওপরে। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ফিরে বাসায় কোনো বইপত্র পায়নি তাহসান। ফলে পড়াশোনা ও স্কুলে যাওয়া নিয়ে বেকায়দায় পড়েছে সে। অথচ আগামী বছর তার এসএসসি পরীক্ষায় বসার কথা।
তানজিম বলছিল, বছরের শুরু থেকে বিভিন্ন সময় নানা কারণে টানা স্কুল বন্ধ থাকায় এমনিতেই ঠিকমতো সিলেবাস শেষ করা যায়নি। বন্যায় বই-খাতা সব নষ্ট হওয়ায় কিছুদিন বাদে তাকে নির্বাচনী পরীক্ষায় বসতে হবে প্রস্তুতি ছাড়াই।
একই বিপদের মধ্যে পড়েছে ছাগলনাইয়া উপজেলার উত্তর কহুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির ছাত্রী লুসাইবা জামানের পরিবার। বন্যার পানিতে বাচ্চাদের সব বই নষ্ট হয়ে গেছে। পানির কারণে স্কুল এখনো শুরু হয়নি। ফলে বাচ্চাদের পড়াশোনাও বিঘ্নিত হচ্ছে। শিশু লুসাইবা জামান বলছিল, তার নতুন বই লাগবে। সে স্কুলে যেতে চায়।
ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) মাহমুদা হক জানান, 'জেলার কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস শুরু হলেও বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তা পারেনি। এখনো অনেক স্কুলে পরিচ্ছন্নতা আর মেরামতের কাজ চলছে। শুধু ক্লাস চালু করলে তো হবে না, বাচ্চাদের দিকটাও দেখতে হবে। অনেক প্রতিষ্ঠান এখনো দুর্গন্ধময় হয়ে রয়েছে। বইপত্রের জন্য শিক্ষা উপদেষ্টার কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে।'
আগস্টের বন্যায় দেশের পূর্বাঞ্চলের জেলা ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিলস্নায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ফেনীতে। সেখানকার কয়েকটি উপজেলায় প্রায় তিন সপ্তাহ পর্যন্ত পানিবন্দি ছিল লাখ লাখ মানুষ।
হঠাৎ করে প্রবল বেগে পানি আসায় মানুষজন জীবন বাঁচাতে এক কাপড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে উঠেছিল। ঘরের মালামাল কোনো কিছুই তারা নিয়ে যেতে পারেনি। শিক্ষার্থীরাও তাদের বই বাঁচাতে পারেনি।
অনেকের স্কুল ড্রেসও নষ্ট হয়ে গেছে। আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরলেও পড়াশোনা ব্যাহত হচ্ছে। কিছু কিছু জায়গায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে পুরনো বই সংগ্রহ শুরু হয়েছে। যদিও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। সরকারিভাবেও নতুন করে বইয়ের চাহিদা চাওয়া হয়েছে।
বিপাকে ফেনীর চার লাখ শিক্ষার্থী
এবারের ভয়াবহ বন্যায় ফেনী জেলার প্রায় সবগুলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পস্নাবিত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৩৫১টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা, ৫৫৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ৪১টি কলেজ ও কারিগরি, ডিপেস্নামা প্রশিক্ষণ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের ৩ লাখ ৮২ হাজার শিক্ষার্থী গত ২০ আগস্ট থেকে ক্লাসে ফিরতে পারেনি। কর্তৃপক্ষ ক্লাস শুরু করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
ফুলগাজী উপজেলার জিএম হাট নূরপুর আবদুল হাকিম ভূঁইয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জার আফসান খানম জানান, তার বিদ্যালয় ১০ ফুট পানির নিচে ছিল। ২৭ আগস্ট স্কুল থেকে পানি নেমে গেলেও কাদায় ভরপুর শ্রেণিকক্ষগুলো পরিষ্কার করতে এক সপ্তাহের বেশি সময় লেগেছে। ভেজা বেঞ্চ রোদে শুকোতে হচ্ছে। শ্রেণিকক্ষে পাঠদান উপযোগী করতে আরও কিছু সময় লাগবে।
একই উপজেলার উত্তর দৌলতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক এরশাদ উল্যাহ চৌধুরী জানান, তাদের স্কুল অন্তত আট ফুট পানির নিচে ছিল। স্কুলের ল্যাপটপসহ অন্যান্য সরঞ্জাম নষ্ট হয়েছে। স্কুলের প্রায় সাত লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
ফেনী সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দোলন কৃষ্ণ সাহা বলেন, 'বন্যায় ফেনী সরকারি কলেজ, সংলগ্ন পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবনে হাজারো মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। প্রতিষ্ঠানের কোনো শ্রেণিকক্ষই এখনো কার্যক্রম পরিচালনার উপযোগী হয়নি।'
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, জেলার সব স্কুলই পানিতে ডুবেছে। প্রাথমিকভাবে জেলা প্রশাসক বরাবর সম্ভব্য ক্ষতির হিসাব জমা দেওয়া হয়েছে। এতে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চার কোটি ২০ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী ইসরাত নূরজাহান সিদ্দিকা বলেন, প্রাথমিকভাবে ১৩৫টি প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির হিসাব জেলা প্রশাসনের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। তাতে ১৩ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির হিসাব এসেছে। কয়েকটি উপজেলা থেকে এখনো হিসাব আসেনি।
পুরনো বই সংগ্রহ
হাজার হাজার শিক্ষার্থীর বই, খাতা ও শিক্ষা উপকরণ ভিজে নষ্ট হয়েছে। তাদের পাশে দাঁড়াতে পুরনো বই সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেলা সমন্বয়ক আবদুল আজিজ বলেন, ফেনী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে একটি বুথ বসিয়ে পুরনো বই সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। কর্মসূচির উদ্বোধন করেছেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ রায়হান মেহবুব।
কুমিলস্নায় অনেকের স্কুলড্রেসও নেই
কুমিলস্নার বুড়িচং উপজেলার নানুয়ার বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী উম্মে হাবিবাদের ঘরবাড়ি ভেসে গেছে বন্যায়। পানি নেমে গেলে বিধ্বস্ত বাড়িতে হাবিবা খুঁজে পেয়েছে তার স্কুল ব্যাগ। কিন্তু টানা ১২ দিন বন্যার পানিতে ডুবে থাকায় নষ্ট হয়েছে তাদের তিন বোনের সব বই-খাতা। হাবিবা বললো, 'বই-খাতার সঙ্গে আমাদের স্কুলের ব্যাগ ও স্কুলের পোশাকও ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এখন স্কুল খুললেও যেতে পারব না।'
শুধু হাবিবা নয়, বন্যার কারণে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে জেলার বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কুমিলস্নার ১৪টি উপজেলার মধ্যে বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বুড়িচং উপজেলা। গোমতী নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে এক রাতে তলিয়ে গেছে প্রায় পুরো উপজেলা। সে কারণে প্রাণ বাঁচাতে অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটলে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী সঙ্গে নিতে পারেনি বই-খাতাসহ মূল্যবান জিনিসপত্র।
জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, কুমিলস্না জেলায় মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ রয়েছে ৭২৪টি। এর মধ্যে ১৪ উপজেলায় ভয়াবহ বন্যায় ২৮৬টি প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বর্তমানে সংস্কার ছাড়া পাঠদান শুরু করা যাবে না এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২০৫টি। বন্যায় এসব প্রতিষ্ঠানে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আনুমানিক ৩ কোটি ৮৪ লাখ ৪৩ হাজার টাকা।
নোয়াখালীতে শিক্ষার্থী উপস্থিতি কম
নোয়াখালীতে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জলমগ্ন হয়ে আছে। অনেক জায়গায় বাবার পানিবন্দি মানুষ অবস্থান করছেন। ফলে অর্ধেকের বেশি প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা শুরু করা যায়নি। আর যেসব প্রতিষ্ঠানে পাঠদান চলছে, বই-খাতা না থাকায় সেখানেও উপস্থিতি কম।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মনসুর আলী চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, জেলায় মোট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এক হাজার ২৫৩টি। এর মধ্যে পাঠদান শুরু করা গেছে ৭৫৪টি বিদ্যালয়ে।
বন্যায় জেলার ৭৬৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আসবাবপত্র ও অবকাঠামো নষ্ট হয়ে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বেগমগঞ্জ ও সেনবাগ উপজেলায় অনেক শিক্ষার্থীর বইখাতা ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। এ দুই উপজেলার বিভিন্ন বিদ্যালয় থেকে ছয় হাজার নতুন বইয়ের জন্য চাহিদা দেওয়া হয়েছে বলে জানান এই শিক্ষা কর্মকর্তা।
সদর উপজেলার গোলাম মাওলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্যার কারণে ২১ দিন বন্ধ ছিল। ৪ সেপ্টেম্বর থেকে কিছু ক্লাস শুরু হয়েছে সেখানে। স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বিবি মরিয়ম বলেন, 'তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান শুরু করা হয়েছে। মাঠে এক হাঁটু পানি থাকায় বাকি ক্লাসগুলো শুরু করা যাচ্ছে না। বিদ্যালয় ভবনে আশ্রয়কেন্দ্র করায় ওয়াশবস্নক নষ্ট হয়ে গেছে। পানিতে ভবনের রং উঠে গেছে।'
জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নূর উদ্দিন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর বলেন, 'নোয়াখালীতে ৩৬৩টি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং ৩৪৩টি মাদ্রাসা রয়েছে। এর মধ্যে ৯০ ভাগ স্কুল-কলেজই বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানি কমে গেলে খুব শিগগিরই বেগমগঞ্জ, সেনবাগ, চাটখিল, সোনাইমুড়ী উপজেলায় শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক করা যাবে।'