'ডান চোখে ৫টা, বাম চোখে ৩টা গুলি লাগে। গুলি চোখের ভিতরে এখনো রয়েছে। বাম চোখে অপারেশন হয়েছে। এই চোখের আরেকটা অপারেশন হবে। বাম চোখের আলো ফেরার সম্ভাবনা আছে। ডান চোখে কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে আমি এখন কিছুই দেখছি না। শুধুমাত্র চোখের ভেতর লাইট ধরলে অনুধাবন করতে পারি কিছু আলো চোখে পড়েছে। আমি দেখতে চাই।' এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত সিলেট সরকারি কলেজের সম্মান ২য় বর্ষের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষার্থী মো. আবু সালেহ।
একুশ বছরের টগবগে তরুণ মো. আবু সালেহ। সিলেটের আমারবাগ এলাকায় নিজ পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। গত জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। গত ৪ আগস্ট সকাল সোয়া ১১টার দিকে এলাকার ছোট ভাইদের সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনে যোগ দেন। ওইদিন সকাল থেকে সিলেট জেল রোডের করিম উলস্নাহ মার্কেটের পেছনের গেইট থেকে থেমে থেমে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ চলছিল। পুলিশ রাবার বুলেট, ছররা গুলি ও টিয়ার গ্যাস মারছিল। ছাত্র-জনতা ইট মারতে থাকেন।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ের জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ৪ তলার পুরুষ ওয়ার্ডে পি বি ১৭ শয্যায় শুয়ে শুয়ে সে দিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে আবু সালেহ বলেন, 'ওইদিন ১২টার দিকে যখন গোলাগুলি থামল, আমি একটু সামনের দিকে এগুতে থাকি। জেল রোডের করিম উলস্নাহ মার্কেটের পেছনের গেইটে পুলিশের কাছাকাছি চলে যাই। পরে সাড়ে ১২টার দিকে পুলিশ আবার গুলি চালালে আমার সারা শরীরে গুলি লাগে। আমার ১৫ সেকেন্ড জ্ঞান ছিল না। জ্ঞান ফিরলে আমি দেখতে পাই, আমি রাস্তায় পড়ে আছি। সবাই বলাবলি করছিল গুলি খাইছে হাসপাতালে নিতে হবে। ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে হাসপাতালে নেওয়া হয় আমাকে। হাসপাতালে নেওয়ার পর বাড়িতে খবর দেওয়া হয়। সেই থেকে আমার এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে চিকিৎসা চলছে।'
হাসপাতালে আবু সালেহের শয্যার একপাশে মামা মো. আরিফ উজ জামান আর অন্য পাশে সিএনজি চালক মো. হাবিবুর রহমান বসে সেবা করছেন।
সিএনজি চালক বাবা মো. হাবিবুর রহমান বলেন, সিলেটের উইমেন্স মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু হয়। ৪ দিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর ১০ দিন আইসিইউতে ছিল। রাজধানীর আগারগাঁওয়ের জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে রেফার্ড করা হয়। শারীরির অবস্থা ভালো না হওয়ায় সেখান থেকে রেফার্ড করা হয় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে। ৭ দিন কুর্মিটোলা থাকার পর শারীরিক ফিটনেস আসলেও, এখানে আসার পর বলা হলো মানসিকভাবে দুর্বল। পরে আবার বাড়িতে নিয়ে যাই। এক সপ্তাহ পরে আবার চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে নিয়ে আসি। ১ সেপ্টেম্বর এখানে ভর্তি করা হয়। ৯ তারিখ একটা অপারেশন করা হয়েছে।
আবু সালেহর মামা মো. আরিফ উজ জামান বলেন, 'গুলি লাগার পর চোখে ছানি পড়ে, রক্ত জমাট বাঁধে। অপারেশনে চোখের লেন্স লাগানো হয়েছে। ওয়েল ও গ্যাস ব্যবহার হয়েছে। বাম চোখের আরেকটা অপারেশন হবে। চিকিৎসক বলেছেন, বাম চোখে দেখার আশা আছে। কিন্তু ডান চোখে কোনো সম্ভাবনা নেই। ডান চোখের অপারেশন পরে। চোখের ভেতর গুলি এখনো বয়ে বেরাচ্ছে। পরে অপারেশন করে বের করে দেওয়া হবে। সারা শরীরে ছররা দুই থেকে আড়াইশ' গুলি লাগে। চোখের সমস্যাটা এখন প্রকট আকার ধারণ করেছে।'
পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সিএনজি চালক বাবা মো. হাবিবুর রহমান বলেন, 'দুই মেয়ে এক ছেলের মধ্যে আবু সালেহ বড় সন্তান। এক মেয়ে সপ্তম শ্রেণিতে, অন্য মেয়ে এইচএসসিতে পড়াশোনা করে। এখন সিএনজি চালাতে পারছি না, আয় করতে পারছি না। দারদেনার ওপর চলছে সংসার। ৪ আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। হাসপাতালের চিকিৎসা ছাড়া এখন প্রতিদিন ১ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। ৬ আগস্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধপাতি, অপারেশন করতে টাকা লাগছে। পিতা হিসেবে আমার একটাই দাবি- আমার ছেলে যেন দেখতে পায়। এখন পর্যন্ত ছেলের পিছনে জীবনের সব ইনকাম ব্যয় করছি। এখন দারদেনা করে খরচ করছি। আমার আর কিছু চাওয়ার নেই।'