চলমান শ্রমিক বিক্ষোভের জেরে শিল্পাঞ্চল সাভার, আশুলিয়া ও গাজীপুরে ১১৪ পোশাক কারখানা বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে ৫৪ কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে মালিকপক্ষ। মঙ্গলবার রাতে ও বুধবার সকালে কারখানাগুলোতে বন্ধের নোটিশ টানিয়ে দেওয়া হয়। বাকিগুলোতে শ্রমিকরা উপস্থিত হয়েও কাজ না করায় ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। বন্ধ থাকা ১১৪ কারখানার মধ্যে ১১১টি সাভার, আশুলিয়া ও জিরানি এলাকায়। বাকি তিনটি কারখানা গাজীপুরে বলে সংশ্লিষ্টরা নিশ্চিত করেছেন। এ ছাড়া বুধবার বেলা ১১টার দিকে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা গাজীপুরের কাশিমপুরে বিগবস নামে একটি কারখানায় আগুন লাগিয়ে দেন। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গেলে শ্রমিকরা তাদেরও তাড়িয়ে দেন।
এদিকে, বুধবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে পোশাক খাতের চলমান অসন্তোষ নিরসনে বৃহস্পতিবার সকালের মধ্যেই বেতন পরিশোধ করা হবে বলে জানিয়েছেন শ্রম উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ। আর আগামী শনিবারের মধ্যে শ্রমিক অসন্তোষ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাভার ও আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে বুধবার সকালে নির্দিষ্ট সময় অধিকাংশ কারখানায় শ্রমিকরা কাজে যোগ দেন। তবে কারখানায় উপস্থিত হওয়ার পরও কাজ না করায় ৫৭টি কারখানায় ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া শ্রম আইনের ১৩(১) ধারায় ৫৪টি কারখানা বন্ধ করা হয়। অর্থাৎ এসব কারখানার শ্রমিকরা কাজ না করলে মজুরি পাবেন না।
বিজিএমইএর নেতারা মঙ্গলবার পর্ষদ সভা করে বুধবার কারখানা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেন। তবে নেতাদের একটি অংশ আশুলিয়ার মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে শ্রম আইনের নির্দিষ্ট ধারায় কারখানা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেন। সে অনুযায়ী ওই কারখানাগুলো খোলা হয়নি।
এ বিষয়ে শিল্পাঞ্চল পুলিশ-১-এর পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সারোয়ার আলম বলেন, 'যারা পারছেন, তারা কারখানা চালাচ্ছেন। আর যারা পারছেন না, কারখানা ছুটি দিয়ে দিচ্ছেন। তবে শিল্পাঞ্চলের কোথাও থেকে কোনো সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি।'
কাশিমপুরে কারখানায় আগুন-ভাঙচুর : গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, জেলার কাশিমপুরের সারাবো এলাকায় বিগবস নামে একটি পোশাক কারখানার ওয়্যার হাউসে আগুন দেয় শ্রমিকরা। বুধবার দুপুরে বেক্সিমকো কারখানার শ্রমিকরা বেতনের দাবিতে বিক্ষোভের একপর্যায়ে বিগবস কারখানায় আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটে।
পুলিশ, এলাকাবাসী ও কারখানা কর্তৃপক্ষ জানায়, কাশিমপুর থানাধীন চক্রবর্তী এলাকায় অবস্থিত বেক্সিমকো ইন্ডাস্ট্রিজ কারখানার শ্রমিকরা সকাল থেকে বকেয়া বেতনের দাবিতে বিক্ষোভ করে। একপর্যায়ে দুপুরে শ্রমিকরা সারাবো এলাকাসহ আশপাশের এলাকার বিভিন্ন পোশাক কারখানা ছুটি ঘোষণার দাবি করে। এ ছাড়া ওইসব কারখানার শ্রমিকদের কাজ বন্ধ করে তাদের সঙ্গে বিক্ষোভে অংশ নিতে বলে। ওইসব কারখানার কাজ বন্ধ করে আন্দোলনে অংশ না নেওয়ায় বেক্সিমকো কারখানার শ্রমিকরা বিভিন্ন কারখানার সামনে গিয়ে জানালার কাঁচ ও গেট ভাঙচুর করে। এতে আতঙ্কিত হয়ে অনেক কারখানা ছুটি ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।
একপর্যায়ে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা সারাবো এলাকায় বিগবস করপোরেশন লিমিটেড কারখানার ওয়্যার হাউসে আগুন দেয়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গেলে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা তাদের তাড়িয়ে দেয়।
কাশিমপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'বেক্সিমকো গ্রম্নপের কারখানার শ্রমিকরা বকেয়া বেতনের দাবিতে বিক্ষোভ করে। এ সময় তারা অন্যান্য কারখানাও বন্ধ করতে বিভিন্ন কারখানায় হামলা ও ভাঙচুর চালায়। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশ চেষ্টা করছে।'
প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন বলেন, 'সকাল থেকে বকেয়া বেতনের দাবিতে বেক্সিমকো কারখানার শ্রমিকরা আন্দোলন শুরু করেন। তারা সড়কও অবরোধ করেন। পরে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে এক দল বিক্ষুব্ধ শ্রমিক বিগবস কারখানায় আগুন ধরিয়ে দেন। পরে তারা লাঠিসোঁটা নিয়ে সেখানে অবস্থান নেন।'
গাজীপুর ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক আবদুলস্নাহ আল আরেফিন বলেন, 'বিগবস নামে একটি কারখানায় আগুন লাগার সংবাদ পেয়ে তাদের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে যায়। তবে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা তাদের একটি গাড়িতে ভাঙচুর করলে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা চলে আসেন।'
বিগবস করপোরেশন লিমিটেড কারখানার স্টোরকিপার ওয়াহেদ খান বলেন, 'বেক্সিমকো কারখানার শ্রমিকরা বেতন পরিশোধের দাবিতে বিক্ষোভ করেন। একপর্যায়ে শ্রমিকরা বিগবস কারখানাসহ বিভিন্ন কারখানায় এসে হামলা ও ভাঙচুর চালায়। পরে শ্রমিকরা তাদের কারখানার ওয়্যার হাউসে অগ্নিসংযোগ করে। সেখানে মূল্যবান ফেব্রিক্স রয়েছে। এ ছাড়াও এর আশপাশে বসতবাড়ির দোকানপাটও রয়েছে।'
বৃহস্পতিবার সকালের মধ্যে বেতন পরিশোধ :শ্রম উপদেষ্টা
এদিকে, শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ে বুধবার সচিবালয়ে জরুরি বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে এসে শ্রম উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেছেন, সাভারের আশুলিয়ায় পোশাক কারখানাগুলোতে যে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে, আজ (বুধবার) রাত কিংবা আগামীকাল (বৃহস্পতিবার) সকালের মধ্যে শ্রমিকদের বকেয়া বেতন পরিশোধ করা হবে। এ ছাড়া শ্রমিকদের বকেয়া বেতন-ভাতা দ্রম্নত পরিশোধে কারখানাগুলোর আবেদনে ব্যাংকগুলোকে দ্রম্নত অর্থ ছাড়ের নির্দেশনা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকেও সরকারের পক্ষ থেকে তাগিদ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
ছাত্র-জনতার জুলাই আন্দোলনে একাধিক সময় কারফিউ ঘোষণায় তৈরি পোশাক খাতের উৎপাদন ও রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হওয়ায় উদ্যোক্তারা আগস্ট মাসের শ্রমিক বেতন পরিশোধে 'সফট' ঋণ চান। সেই দাবি পূরণে ব্যাংকগুলোর কাছে আবেদন করতে বলেছে সরকার।
আগস্ট মাসের বেতন দ্রম্নত পরিশোধ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে মন্তব্য করে উপদেষ্টা আসিফ বলেন, 'কিছু সমস্যা আছে দীর্ঘ মেয়াদের। সবার সঙ্গে আলোচনা করে একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শুনে তা সমাধানের চেষ্টা করা হবে।'
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন শ্রেণি-গোষ্ঠীর নানা দাবি নিয়ে রাজপথে নামার পর পোশাক ও ওষুধ শিল্পেও অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে দফায় দফায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, কারখানা মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে।
সবশেষ গত সোমবারও রাজধানীর উত্তরায় বিজিএমইএ কার্যালয়ে বৈঠক করেন সমিতির সদস্যরা। প্রতি বৈঠকেই কারখানা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত হয়। শ্রমিক নেতাদের পক্ষ থেকে পরিবেশ শান্ত রাখতে সহযোগিতা দেওয়ার আশ্বাস আসে। এরপরও প্রতিদিনই কারখানায় ছুটি ঘোষণা করছেন মালিকপক্ষ শ্রম অসন্তোষের কারণে।
শ্রমিকদের দাবি এক জায়গায় শুনতে কমিটি গঠন
সংবাদ সম্মেলনে শ্রম উপদেষ্টা বলেন, 'শ্রমিকরা যেন একটি নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দাবিগুলো জানাতে পারে, এর জন্য একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গত কেবিনেট বৈঠকে শ্রম পরিস্থিতি রিভিউ করার জন্য সিদ্ধান্ত হয়। সেই লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।'
এই কমিটি মাঠপর্যায়ে গিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলবে জানিয়ে তিনি বলেন, 'সরাসরি শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে সমস্যা সুনির্দিষ্ট করা হবে এবং তা সমাধান করা হবে। কমিটি সমস্যা বুঝে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা দপ্তরের সঙ্গে কথা বলবে।'
উপদেষ্টা জানান, ২০২৩ সালে মজুরি নিয়ে আন্দোলনে শ্রমিকদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক যেসব মামলা হয়েছিল, তা প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এসব মামলার তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। শ্রমিক আন্দোলনের পেছনে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা কিংবা বহিরাগতদের ইন্ধন আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
শনিবারের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে :বিজিএমইএ সভাপতি
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম বুধবার শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আরএমজি এবং নন-আরএমজি সেক্টরের শ্রমিক অসন্তোষ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়ার লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় বলেছেন, আমার বিশ্বাস, আগামী শনিবার থেকে সব কারখানা নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে পারবে।
শ্রমিক অসন্তোষ কত দিনের মধ্যে স্বাভাবিক হবে বলে মনে করেন- এমন প্রশ্নের জবাবে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, 'আজকে কারখানগুলো সুন্দরভাবে চালু হয়েছে। কিন্তু একটি বড় প্রতিষ্ঠানের গতকাল বেতন দেওয়ার কথা ছিল। দিতে না পারায় এদিন দুপুর থেকে ওই কারখানার শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন। এতে আশপাশের কিছু কারখানা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমি আশা করছি, এদিন সন্ধ্যার মধ্যে সেই কারখানার শ্রমিকরা বেতন পেয়ে যাবেন। আমার বিশ্বাস, আগামী শনিবার থেকে সব কারখানা নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে পারবে।'
শ্রমিক অসন্তোষে কতগুলো কারখানা আক্রান্ত হয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাব বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, আশুলিয়া, জিরাবো, জিরানী জোনে ৪০৮টি কারখানা রয়েছে। গত কয়েক দিনের শ্রমিক অসন্তোষে এসব এলাকার ৪০-৬০টি কারখানা বন্ধ আছে। কিছু বন্ধ রেখেছে ইচ্ছাকৃত, কিছু শ্রমিক অসন্তোষের জন্য।
তিনি বলেন, গার্মেন্ট খাত সিজনাল ব্যবসা, আজ ঠিক করা হয় তিন মাস পর কোন পণ্যটা বাজারে আসবে। তাই এই অস্থিরতার কারণে, একটা সিজনে সমস্যার কারণে বায়াররা অন্য স্থান থেকে সোর্সিং করছে। এতে করে আমাদের প্রায় ১০-১৫ শতাংশ অর্ডার অন্য দেশে চলে গেছে। তবে আমি আশাবাদী, বর্তমান সরকারের সহযোগিতায় অবশ্যই আমরা এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে পারব।