দেশের বন্যাকবলিত বিভিন্ন জেলায় ত্রাণসহায়তা কমেছে। এতে দুর্গত মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। সোমবার রাতভর ও মঙ্গলবার দিনভর বৃষ্টির কারণে নোয়াখালীতে ফের বেড়েছে পানি। এখনো আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন জেলার ৭০ হাজার মানুষ আর পানিবন্দি প্রায় ১৩ লাখ। স্থানীয়রা বলছেন, খাল দখল ও ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণ, অপরিকল্পিত কালভার্ট তৈরি ও যেখানে-সেখানে বাঁধ দিয়ে পানি নিষ্কাশনের বাধা দেওয়ায় পানি নামছে না। ফলে জেলার সেনবাগ, বেগমগঞ্জ, সোনাইমুড়ী ও চাটখিল উপজেলার বেশিরভাগ এলাকা এখনো জলাবদ্ধ। এ ছাড়া সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এবারের বন্যায় চাঁদপুরে ১৯২ গ্রামীণ সড়ক ও ১২ হাজার হেক্টর ফসলের ক্ষতি হয়েছে। আর লক্ষ্ণীপুরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সাড়ে ১৮ হাজার বসতঘর। বন্যার পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে বন্যাদুর্গত এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগব্যাধি।
নোয়াখালীর দুর্গত এলাকার লোকজন জানান, গত কয়েকদিন রৌদ্রোজ্জ্বল পরিবেশ থাকার কারণে জেলার বেশিরভাগ উঁচু এলাকা থেকে পানি নেমে যায়। তবে নিম্নাঞ্চল ছিল জলাবদ্ধ। এরই মধ্যে সোমবার রাতে ও মঙ্গলবার দিনে হওয়া বৃষ্টিতে নিচু এলাকায় বেড়েছে পানি। পানি নেমে যাওয়া কিছু সড়ক আবারও তলিয়েছে। বৃষ্টির সঙ্গে নিচু এলাকাগুলোয় তিন থেকে চার ইঞ্চি পানি বেড়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
জেলার বন্যা আক্রান্ত ৮টি উপজেলার মধ্যে সদর, কোম্পানীগঞ্জ ও সুবর্ণচর উপজেলার বেশিরভাগ এলাকা থেকে পানি নেমে গেলেও এখনো জলমগ্ন কবিরহাট, সেনবাগ, বেগমগঞ্জ, সোনাইমুড়ী ও চাটখিল উপজেলার অধিকাংশ এলাকা। কোথাও কোথাও এখনো হাঁটু থেকে কোমরসমান পানি রয়েছে। যারা আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বাড়ি ফিরেছেন বন্যার পানিতে রান্নাঘরে চুলা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন তারা। ফলে খাদ্য সমস্যায় ভুগছেন। বন্যার শুরুর দিকে জেলার বাইরে ও জেলার বিভিন্ন সংগঠন থেকে খাবার ও ত্রাণসহায়তা দিলেও সেটি বর্তমানে অনেকটা কমে এসেছে।
জেলা প্রশাসকের তথ্যমতে, বন্যাকবলিত এলাকাগুলোয় এখনো পানিবন্দি প্রায় ১৩ লাখ মানুষ। বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন ৭০ হাজার মানুষ। এ ছাড়া জেলায় বেড়েছে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা। বন্যাকবলিত ৮টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্স ও নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে ভর্তি আছেন প্রায় ৪৪৮ জন রোগী।
লক্ষ্ণীপুরে সাড়ে ১৮ হাজার বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত
এবারের বন্যায় লক্ষ্ণীপুর জেলায় প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার পাকা-আধাপাকা ও কাঁচাঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয়। এসব ঘর মেরামতে প্রায় ১২৬ কোটি ১৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা ব্যয় হতে পারে।
ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় সূত্র জানায়, জেলার বিভিন্ন এলাকায় ১৮ হাজার ৩৬৫ বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলায় সাড়ে সাত হাজার, রায়পুরে এক হাজার ৩০৮, রামগঞ্জে এক হাজার ৮৮৫, রামগতিতে এক হাজার ২৯২ ও কমলনগরে ছয় হাজার ৩৮০ বসতঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত বসতঘরগুলো মেরামতের জন্য প্রায় ১২৬ কোটি ১৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা ব্যয় হতে পারে।
এর মধ্যে সদরের ক্ষতিগ্রস্ত ঘরগুলো মেরামতে ৬২ কোটি ৩৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা, রায়পুরে দুই কোটি ২২ লাখ ৮০ হাজার, রামগঞ্জে ১৯ কোটি ৩৭ লাখ ৫০ হাজার, রামগতিতে পাঁচ কোটি ৪৬ লাখ ও কমলনগরে ৩৫ কোটি ৭৪ লাখ টাকা ব্যয়ের সম্ভাবনা রয়েছে।
জানা গেছে, জেলার পাঁচ উপজেলার প্রায় ৫০ ইউনিয়ন ও চারটি পৌরসভার বিভিন্ন এলাকা বন্যাকবলিত। এখনো সদর উপজেলার পূর্বাঞ্চলের ১২টি ইউনিয়নে বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে ভাসছে। খালবিলগুলো অবৈধভাবে দখল করে রাখার কারণেই সহজেই পানি নামছে না। এতে ২০-২৫ দিন ধরে বন্যার কবলে রয়েছে জেলার বিভিন্ন এলাকা। দীর্ঘমেয়াদি এ বন্যা মানুষের জন্য বিপদজ্জনক হয়ে উঠেছে। পানিতে নিমজ্জিত থাকা কাঁচা-পাকা ও আধাপাকা বসতঘরগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মাটির ঘরগুলোর ভিটা কাদায় পরিণত হয়েছে। কাঠ ও টিনের তৈরি বেড়াগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। কাঠের খুঁটিগুলো পচে গেছে। জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে অসংখ্য বসতঘর।
এদিকে বন্যার্ত এলাকার অধিকাংশ মানুষই কৃষিজীবী ও দিনমজুর। এ বন্যায় উপার্জন বন্ধ হয়ে অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছেন দুর্গত এলাকার বাসিন্দারা। ক্ষতিগ্রস্ত বসতঘরগুলো মেরামত নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন ভুক্তভোগীরা। ঘর মেরামতে সরকারিভাবে এখনো কোনো সহায়তা দেওয়া হয়নি। সরকারের উপদেষ্টা ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা লক্ষ্ণীপুরে এসে পুনর্বাসনের ব্যবস্থার আশ্বাসসহ নতুন ঘর নির্মাণের কথা জানিয়েছেন। তবে সরকারি সহায়তা না পেলে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরগুলো মেরামত অসম্ভব হয়ে পড়বে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ইউনুস মিয়া বলেন, 'বন্যায় বহু বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা তালিকা করেছি। সংশ্লিষ্ট দপ্তরে তালিকা পাঠানো হয়েছে।'
চাঁদপুরে ১২ হাজার হেক্টর ফসলের ক্ষতি
এদিকে ভয়াবহ বন্যা ও অতিবৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়ে চাঁদপুরের ছয় উপজেলায় ১৯২ গ্রামীণ সড়ক ও ৪৪টি কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ খাতে সম্ভাব্য ক্ষতি প্রায় ৪০ কোটি টাকা। তবে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। অন্যদিকে ১২ হাজার হেক্টর জমির ধানসহ অন্যান্য ফসলের ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতির পরিমাণ ৮৬ কোটি ৬৬ লাখ ২২ হাজার টাকা। এ ছাড়া বন্যা ও জলাবদ্ধতায় জেলায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা ৪৭ হাজার। জেলার স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বন্যাদুর্গত শাহরাস্তি, কচুয়া ও হাজীগঞ্জ উপজেলার যেসব গ্রামীণ পাকা সড়কে পানি উঠেছিল, পানি নেমে যাওয়ার পর সেখানে ভাঙনের চিহ্ন ফুটে উঠছে। সদর, হাইমচর ও ফরিদগঞ্জ উপজেলারও অধিকাংশ গ্রামীণ পাকা সড়ক দীর্ঘ একমাস পানির নিচে ছিল। ফলে সড়কগুলোর পাশের মাটি নরম হয়ে ভেঙে পড়ছে। সড়কের পাশে তৈরি হয়েছে বড় বড় গর্ত।
কচুয়া ও শাহরাস্তি উপজেলায় রোপা আউশ পানিতে নিচে তলিয়ে রয়েছে। কয়েকটি মাঠে রোপা আউশ দেখা গেলেও ধানের গোড়া পচে নুয়ে পড়েছে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর চাঁদপুরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আহসান কবির বলেন, 'এবারের বন্যায় কচুয়া, শাহরাস্তি, হাজীগঞ্জ এবং অতিবৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়ে ফরিদগঞ্জ, সদর ও হাইমচর উপজেলায় ১৯২ সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে সদরে ১২টি, হাইমচরে ১০টি, হাজীগঞ্জ ৪৫টি, কচুয়ায় ২২টি, শাহরাস্তিতে ৫৩টি ও ফরিদগঞ্জে ৫০টি সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া ছয় উপজেলায় ৪৪টি কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।'
বন্যার পানি এখনো পুরোপুরি নামেনি এবং জলাবদ্ধতাও রয়েছে জানিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী আরও বলেন, 'আমরা গ্রামীণ সড়ক ও কালভার্টের ক্ষতির পরিমাণ এখনো চূড়ান্ত করিনি। প্রাথমিকভাবে প্রায় ৪০ কোটি টাকার ক্ষতির আশঙ্কা করছি। এই পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। একই সঙ্গে আমরা এসব গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও কালভার্ট মেরামতের সম্ভব্য ব্যয় (প্রাক্কলন) তৈরি করছি। কিছু স্থানে মেরামত কাজ শুরু হয়েছে।'
চাঁদপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সাফায়েত আহম্মদ ছিদ্দিকী বলেন, 'আমাদের মাঠ জরিপের তথ্য অনুযায়ী, বন্যা ও জলাবদ্ধতায় প্রায় জেলায় ৪৭ হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফসলের মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মাঠে থাকা রোপা আউশ, আমন ও পান। পানিতে তলিয়ে ক্ষতি হয়েছে বীজতলা। জেলার ছয় উপজেলায় ১২ হাজার হেক্টর জমির ধানসহ অন্যান্য ফসলের ক্ষতির পরিমাণ ৮৬ কোটি ৬৬ লাখ ২২ হাজার টাকা। ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের প্রণোদনা হিসেবে আমনের বীজ ও সার সরবরাহ শুরু করা হয়েছে।'
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সাফায়েত আহম্মদ বলেন, 'ইতোমধ্যে প্রায় সব উপজেলায় কৃষকদের মধ্যে প্রণোদনা হিসেবে আমনের বীজ, সার ও নগদ অর্থ বিতরণ করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের আমরা প্রণোদনার আওতায় আনার চেষ্টা করছি।'