'মনের জোরে পা কাটতে দেইনি'
প্রকাশ | ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
পাঠান সোহাগ
'পা হারানোর ভয় এখনো কাটেনি। স্বাভাবিকভাবে কবে হাঁটাতে পারব জানি না। চিকিৎসরা বলেছিলেন, পা কেটে ফেলতে। আমি মনের জোরে পা কাটতে দেইনি। গুলিতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হাড় অপারেশনে বাদ দিয়ে পায়ের মাংস জোড়া লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। পায়ের মাংস ভালো হলে হাড়ের চিকিৎসা শুরু হবে।'
রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রফিকুল ইসলাম রায়হান এভাবেই তার সাহসিকতার কথা বলছিলেন।
আটাশ বছরের টগবগে যুবক রফিকুল ইসলাম রায়হান গাজীপুরের মাওনা এমসি বাজারে টেক্সটাইল কারখানা সুফিয়া কটন মিলে কাজ করতেন। পরিবার নিয়ে থাকতেন মাওনার ওয়াপদার মোড় এলাকায়। গত জুলাইয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় কারখানায় যাওয়া-আসার পথে ছাত্রদের সঙ্গে সময় দিতেন মনের ভালো লাগা থেকে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগের খবর পেয়ে আনন্দ মিছিলে যোগ দিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন তিনি।
পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলা ফজলুল হকের দুই সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে রায়হান। বরিশালের একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েই গাজিপুরে এসেছিলেন চাকরির খোঁজে। টেক্সটাইল কারখানা শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। এরপর আর পড়াশোনা হয়নি। গত সাড়ে তিন বছর আগে বিয়েও করেছিলেন।
পঙ্গু হাসপাতালে জরুরি বিভাগের তৃতীয় তলায় মডেল বি-ওয়ার্ডে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত রোগীদের জন্য বিশেষায়িত ওয়ার্ডে বি-১০ শয্যায় শুয়ে কাতরাতে কাতরাতে সেদিনের বর্ণনা দিচ্ছিলেন রফিকুল ইসলাম রায়হান। তিনি বলেন, 'তিনটা থেকে সাড়ে তিনটার মধ্যে মিছিল মাওনা ওয়াপদা মোড়ে আসতেই বিজিবি সদস্যরা বাধা দেন। শিক্ষার্থী ও উৎসুক জনতা সামনের দিকে এগুতে চাইলে, যেতে না পেয়ে ইট মারতে থাকলে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যায়। এ সময় বিজিবি ও পুলিশ সদস্যরা গুলি চালায়।'
সেদিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে রায়হান বলেন, 'সামনে থেকে গুলি পায়ে লাগে, পেছন দিয়ে গুলি বের হয়ে যায়। আমি সঙ্গে সঙ্গে পড়ে যাই। তখন আমার জ্ঞান ছিল। সব কিছু বুঝতে পাচ্ছি। তখন বুঝতে পারিনি পায়ের হাড্ডি ভেঙ্গে গুড়া হয়ে গেছে। হাত দিয়ে পা সোজা করে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। কিন্তুু পারচ্ছিলাম না। উঠতে গিয়ে পড়ে যাই একটা চা দোকানের পচাঁ নোংরা পানির গর্তে। সেখান থেকে হাতে ভর দিয়ে রাস্তার দিকে আসি। তখনো পা লর লর (স্বাভাবিকভাবে কাজ না করা) করছিল।'
তিনি বলেন, '১৫ মিনিট পরে মানুষ জন আমাকে ধরাধরি করে ভ্যানে করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে নিয়ে যান। সেখানেও আমার জ্ঞান ছিল। চিকিৎসকরা বলেছে আমার পা কেটে ফেলতে হবে। আমি না করায় ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে রেফার্ড করে। ওইদিন রাত তিনটার দিকেও আমার চিকিৎসা শুরু হয়নি। সকালে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছিল। সেদিন রোগীর প্রচুর চাপ ছিল। আমার অপারেশন লাগবে। কিন্তু আমার থেকেও সিরিয়াস রোগী অনেকে ছিল। তাদের গুলি ভেতরে আটকে ছিল, কারও হাত, কারও পা কাটতে হবে। পরের দিন আমার একটা অপারেশন হলো।'
রফিকুল ইসলাম রায়হান বলেন, 'হাসপাতালে একদিন থেকে বাড়ি চলে গেলাম। প্রত্যেক দিন ড্রেসিং করতে হতো। বাসায় নার্স নিয়ে ড্রেসিং করাতাম। একদিন দেখি ক্ষতস্থানে পোকা হয়ে গেছে। আমার বাসার পাশে একটা ক্লিনিকে পঙ্গু হাসপাতালের একজন চিকিৎসক বসত। তাকে ফোন দিলে, তিনি বললেন ড্রেসিং করতে ঢাকায় হাসপাতালে আসতে। আবার ১৮ আগস্ট হসাপাতালে ভর্তি হই।'
রফিকুল ইসলাম রায়হানের শাশুড়ি মা আসিয়া খাতুন বলেন, 'সাড়ে তিন বছরে আগে বিয়ে হয়েছে। এখন কোনো সন্তান হয়নি। তবে আমার মেয়ে ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আমি ও আমার মেয়ে ২৪ ঘণ্টা সেবা করে যাচ্ছি। ছেলেটা কবে পুরোপুরি সুস্থ হবে সেটা বলা যাচ্ছে না। ডাক্তাররা বলছে দেড় থেকে দুই বছর লাগবে সুস্থ হতে।'
তিনি বলেন, '৫ আগস্ট থেকে ১৮ আগস্ট পর্যন্ত ১ লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। প্রথমবার হাসপাতালে এসে টাকার অভাবে হাসপাতাল ছাড়তে হয়েছে। পরে এবার ছাত্রদের মাধ্যমে ভর্তি হওয়ায় হাসপাতালে কোনো টাকা লাগেনি। তবে হাসপাতালের চিকিৎসা ছাড়া এখন প্রতিদিন ১ হাজার থেকে দেড় হাজার টাকার খরচ হচ্ছে। ৬ আগস্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধপাতি, অপারেশন করতে টাকা লাগছে।'
রফিকুল ইসলাম রায়হান বলেন, 'চিকিৎসারা বলেছেন, বুলেটের গতিতে পায়ের হাড় এক ফুটের মতো জায়গায় ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়েছে। এ হাড় বাদ দিতে হবে। হাড়ের চিকিৎসা পা ভালো হলে করা হবে।'
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের আহত রোগীদের জন্য বিশেষায়িত ওয়ার্ডে ভলান্টিয়ার ও শ্যামলী আইডিয়াল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউডের শিক্ষার্থী পাপ্পু হোসেন বলেন, এ হাসপাতালে তিন ও চার তালায় ৯৫ জন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। আমরা দেখভাল করছি। আমাদের তত্ত্বাবধানে সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বিভিন্ন কোম্পানির মাধ্যমে সকাল, দুপুর ও রাতের খাবার সরবরাহ করছি। আমরা সব সময় তদারকি করছি। সবাই যেন ভালো চিকিৎসা পায়।