সারাদেশে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত ৬৭২৪০, মৃতু্য ১০১

বন্যায় ভঙ্গুর স্বাস্থ্যব্যবস্থা থেকে উত্তরণের চেষ্টা

প্রকাশ | ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

পাঠান সোহাগ
ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে দেশের উত্তর-মধ্যাঞ্চল ও মধ্য-পূর্বাঞ্চলের অন্তত ১০টি জেলা ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছিল। এর মধ্যে ৭টি জেলার ৯০ শতাংশ এলাকা পুরোপুরি পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। এসব এলাকায় বেশির ভাগ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানও তলিয়ে গিয়েছিল। এতে ভেঙে পড়েছিল ওইসব এলাকার পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থা। পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে পড়া স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক চিকিৎসাসেবা চালুর চেষ্টা চালাচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। এদিকে, সারাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যার পানি কমে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এসব রোগে আক্রান্ত অনেক রোগীর মৃতু্যও হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে বন্যাকবলিত এলাকায় ডায়রিয়া, আরটিআই, চর্মরোগ, চোখের প্রদাহ, সাপে কাটা, পানিতে ডোবা, বন্যাজনিত কারণে আঘাতপ্রাপ্ত ও শ্বাসনালির প্রদাহসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ৬৭ হাজার ২৪০ জন। এছাড়া পানিতে ডুবে, ডায়রিয়া, সাপের কামড় ও বজ্রপাতে ১০১ জনের মৃতু্য হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তরা জানিয়েছেন, দেশের উত্তর-মধ্যাঞ্চলের মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কুমিলস্না, ফেনী, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি ও নোয়াখালী এলাকার জেলা-উপজেলা হাসপাতাল, অনেক কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র পানিতে তলিয়ে যায়। এসব এলাকায় জরুরি সেবা চলমান ছিল। সহস্রাধিক ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা দল কাজ করেছে। ইউনিয়ন, উপজেলাভিত্তিক জরুরি চিকৎসা টিম কাজ করেছে। তারা মানুষের কাছে গিয়ে প্রয়োজনীয় ওষুধ বিতরণ করেছে। খাওয়ার স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেটসহ প্রয়োজনীয় ওষুধ মজুত রাখা হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন যায়যায়দিনকে বলেন, বন্যার্ত এলাকায় আমরা হেলিকপ্টারে করে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও মেডিকেল সার্জিক্যাল আইটেম পাঠিয়েছি। আমাদের চেষ্টার কোনো কমতি ছিল না। আমি নিয়োগ পাওয়ার পর অধিদপ্তরে বসতে পারিনি। স্বাস্থ্য উপদেষ্টার পরামর্শে মন্ত্রণালয়ে বসে সিভিল সার্জনদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। প্রতিটি উপজেলায় খোঁজ রেখেছি। এখনো খোঁজ রাখছি।' স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের ১ জুন থেকে ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশের ৮৪ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ডায়রিয়া, সাপে কাটা, বন্যাজনিত কারণে আঘাতপ্রাপ্ত ও শ্বাসনালির প্রদাহসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন সিলেট বিভাগে ৩৩ হাজার ৩১০ জন। চট্টগ্রাম বিভাগে ৩২ হাজার ২৫৬ জন। এই দুই বিভাগের মধ্যে হাসপাতালে মারা গেছেন চট্টগ্রাম বিভাগে ৬৬ জন এবং সিলেট বিভাগে ১৫ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ডা. মো. জাহিদুল ইসলাম জানান, চট্টগ্রাম বিভাগের কুমিলস্না জেলার বিভিন্ন হাসপাতালে ২০ হাজার ৩৯৮ জন চিকিৎসা নিয়েছে এবং মারা গেছেন ২০ জন। ফেনী জেলায় চিকিৎসা নিয়েছেন ৬ হাজার ৮৪ জন এবং মারা গেছেন ১৫ জন। এছাড়া নোয়াখালীতে চিকিৎসা নিয়েছেন ২ হাজার ২১৮ জন এবং মার গেছেন ১১ জন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুসারে, চলমান বন্যা পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ হয়ে উঠেছে কুমিলস্না ও ফেনীতে। এই দুই জেলার ৯০ শতাংশ এলাকা পানিতে পুরোপুরি তলিয়ে গিয়েছিল। ফেনীর ছয়টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সগুলোর নিচতলায় পানি উঠেছে অন্তত ছয়-সাত ফুট। একই সঙ্গে ফেনী জেলা শহরে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের নিচতলা, কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রগুলো নিম্নাঞ্চলে হওয়ায় সবই পানিতে নিমজ্জিত ছিল। কুমিলস্না জেলার ১৭টি উপজেলার মধ্যে ১০টি পানিতে নিমজ্জিত ছিল। এর মধ্যে চৌদ্দগ্রাম, নাঙ্গলকোট, লাকসাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সের নিচ তলায় চার-পাঁচ ফুট পানি উঠেছে। একই সঙ্গে মনোহরগঞ্জ, তিতাস, বুড়িচং, সদর দক্ষিণ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সের কার্যক্রমও ব্যাহত হয়েছে। এছাড়া জেলার বেশির ভাগ ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিক পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। এছাড়া লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী ও ফেনীর সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সের নিচতলা পানিতে নিমজ্জিত ছিল। তাছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্স পানির নিচে ছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসানের সই করা এক নির্দেশনায় জানা গেছে, সম্ভাব্য স্বাস্থ্যঝুঁকি যেমন ডায়রিয়া, সর্প দংশনসহ বন্যাসংক্রান্ত অন্যান্য রোগের চিকিৎসার জন্য যথোপযুক্ত প্রস্তুতি রাখতে বলা হয়েছে জেলা হাসপাতালগুলোতে। সব ধরনের যন্ত্রপাতি যেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেগুলো মেরামতের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, বন্যাদুর্গত এলাকায় বিভিন্ন রোগে আক্রান্তদের মধ্যে ১৩ হাজার ৩৩৩ জন ডায়রিয়া রোগী। এছাড়া আরটিআইএ ২ হাজার ৩০৭ জন, চর্মরোগে ১১ হাজার ১৩৮ জন এবং অন্য রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ৩৮ হাজার ৫৪৭ জন।