গত ৫ আগস্টের আগে সরকার পতনের আন্দোলনের সময় বেশকিছু পণ্যের দাম বেড়েছিল। যার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য চাল। যা এরপর কেটে যাওয়া একমাসেও কমেনি। বরং নতুন করে চালের দাম বাড়ার শঙ্কার কথা বলছেন ব্যবসায়ীরা।
প্রধান এই খাদ্যপণ্যটির চড়া দাম নিয়ে বিপাকে নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ। তারা বলছেন, নতুন সরকার অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম কমাতে যেমন উদ্যোগ নিচ্ছে, চালের ক্ষেত্রেও তা প্রয়োজন। তারা বাজারে গিয়ে চাল কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন।
শুক্রবার সকালে রাজধানীর হাজীপাড়া বউবাজারে চাল কিনতে এসে খালেক হোসেন নামের একজন বলেন, সংসারে প্রতিদিন দেড় কেজি চালের জন্য ১০০ টাকা লাগে। দাম কমছে না। এরমধ্যে ওএমএস বন্ধ। এখন আর তিন বেলা রান্না হয় না। এক কেজি চালে দিন পার করতে হয়।
তিনি বলেন, শাক-সবজি ও মুরগির দাম কমল, কিন্তু চালের দাম তো আগে কমা দরকার। কারণ, ভাত না জুটলে এগুলো দিয়ে কী হবে।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, আগের কয়েক সপ্তাহের মতোই মোটা চালের কেজি ৫৫ থেকে ৫৬ টাকা বিক্রি হচ্ছে। এরমধ্যে আবার অধিকাংশ দোকানেই মিলছে না মোটা জাতের চাল। যে কারণে অনেক ক্রেতাকে বাধ্য হয়ে মাঝারি মানের চাল কিনতে হচ্ছে।
এদিকে, মাঝারি চাল বিআর-২৮ ও পাইজাম বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকা কেজি দরে। পাশাপাশি মানভেদে সরু চালের কেজি ৭০ থেকে ৭৮ টাকা।
মাস দেড়েক আগেও মোটা চাল ৫০ থেকে ৫২ ও মাঝারি চালের কেজি ছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। আর সরু চাল বিক্রি হতো কেজিপ্রতি ৬৫ থেকে ৭৬ টাকায়। অর্থাৎ, চালের দাম গত এক মাসের ব্যবধানে কেজিতে ৪ থেকে ৬ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
বৃহস্পতিবার পেঁয়াজ ও আলুর শুল্ক কমিয়েছে সরকার। তবে একদিনের ব্যবধানে এসব পণ্যের দামে তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। প্রকৃতপক্ষে এর প্রভাব পড়তে কিছুটা সময়েরও প্রয়োজন।
এ অবস্থায় গত সপ্তাহের মতো প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়। এছাড়া দেশি পেঁয়াজ ১১০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে।
এদিকে, সপ্তাহ ব্যবধানে রাজধানীর বাজারগুলোতে সবজির দাম স্থিতিশীল রয়েছে। সরবরাহ বাড়ায় বাজারে ইলিশের দাম কিছুটা কমেছে। তবে চলতি সপ্তাহে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ১০ টাকা বেড়েছে। শুক্রবার রাজধানীর শেওড়াপাড়া ও তালতলা বাজার ঘুরে দেখা গেছে এমন চিত্র।
রাজধানীর এসব বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সপ্তাহ ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগি কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে ১৭৫ থেকে ১৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে, যা গত সপ্তাহে ১৬৫ থেকে ১৭৫ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। বাজারগুলোতে সোনালি মুরগি কেজিতে ২০ টাকা কমে ২৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সোনালি হাইব্রিড কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে ২৪০ টাকা, দেশি মুরগি ৩০ টাকা কমে ৫২০ টাকা, লেয়ার লাল মুরগি ১০ টাকা কমে ৩০০ টাকা ও সাদা লেয়ার কেজিতে ১০ টাকা বেড়ে ২৯০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
সরবরাহ বাড়ায় সব ধরনের সবজির দাম স্থিতিশীল রয়েছে। বাজারগুলোতে গ্রীষ্মকালীন সবজি কচুরমুখী কেজি ৫০ থেকে ৬০ টাকা, বেগুন ৬০ থেকে ৮০ টাকা, করলা ৬০ থেকে ৮০ টাকা, কাঁকরোল ৭০ টাকা, পটল ৪০ থেকে ৫০ টাকা, ঢেঁড়স ৪০ টাকা, বরবটি ৬০ টাকা, পেঁপে ৩০ থেকে ৪০ টাকা, ধুন্দল ৫০ থেকে ৬০ টাকা, চিচিঙ্গা ৬০ টাকা, কচুর লতি ৭০ থেকে ৮০ টাকা, ঝিঙা ৬০ টাকা, শসা ৪০ থেকে ৫০ টাকা ও কাঁচামরিচ ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
বাজারগুলোতে শীতকালীন সবজি সিম ২০০ টাকা কেজি, ফুলকপি ৪০ থেকে ৫০ টাকা পিস, পাকা টমেটো প্রকার ভেদে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা ও গাজর ১৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
এসব বাজারে লেবুর হালি ১৫ থেকে ৩০ টাকা, ধনেপাতা কেজি ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া কলা হালি বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা, মিষ্টি কুমড়া কেজি ৪০ থেকে ৫০ টাকা। তবে গত সপ্তাহের চেয়ে কেজিতে ৮০ টাকা কমে ২০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে কাঁচামরিচ।
বাজারগুলোতে লাল শাক ১৫ টাকা আঁটি, লাউশাক ৪০ টাকা, মুলাশাক ১৫ টাকা, পালংশাক ১৫ থেকে ২০ টাকা, কলমি শাক ১০ টাকা, পুঁইশাক ৩০ টাকা ও ডাঁটাশাক ২০ টাকা আঁটি দরে বিক্রি করতে দেখা গেছে।
এসব বাজারে গরুর মাংস প্রতি কেজি ৬৫০ থেকে ৭৮০ টাকা, গরুর কলিজা ৭৮০ টাকা, গরুর মাথার মাংস ৪৫০ টাকা, গরুর বট ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা ও খাসির মাংস প্রতি কেজি ১১৫০-১২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বাজারগুলোতে এক ডজন লাল ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৫৫ টাকা, হাঁসের ডিম ১৮০ টাকা ও দেশি মুরগির ডিমের হালি ৮৫ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে।
ইলিশের সরবরাহ বাড়ায় সপ্তাহ ব্যবধানে বাজারগুলোতে সব ধরনের মাছের দাম কমেছে। এসব বাজারে ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ মাছ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে ১০০০ টাকা, ৭০০ থেকে ৮০০ গ্রামের মাছ ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকা, ১ কেজি ওজনের ইলিশ ১৪০০ থেকে ১৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি শিং মাছ চাষের (আকার ভেদে) বিক্রি হচ্ছে ৩২০ থেকে ৪৫০ টাকা, প্রতি কেজি রুই মাছের দাম বেড়ে (আকার ভেদে) ৩৩০ থেকে ৫০০ টাকা, দেশি মাগুর মাছ ৮০০ থেকে ১১০০ টাকা, মৃগেল মাছ ৩২০ থেকে ৪০০ টাকা, চাষের পাঙাস ২০০ থেকে ২২০ টাকা, চিংড়ি প্রতি কেজি ৭০০ থেকে ১৪০০ টাকা, বোয়াল মাছ প্রতি কেজি ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা, কাতল মাছ ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, পোয়া মাছ ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা, পাবদা মাছ ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা, তেলাপিয়া ২২০ টাকা, কই মাছ ২২০ থেকে ২৩০ টাকা, মলা ৫৫০ টাকা, বাতাসি টেংরা ১৩০০ টাকা, টেংরা মাছ ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা, কাচকি মাছ ৫০০ টাকা, পাঁচ মিশালি মাছ ২২০ টাকায়, রূপচাঁদা ১২০০ টাকা, বাইম মাছ ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকা, দেশি কই ১২০০ টাকা, সোল মাছ ৬০০ থেকে ৯০০ টাকা, আইড় মাছ ৬৫০ থেকে ৮০০ টাকা, বেলে মাছ ৮০০ টাকা ও কাইকলা মাছ ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
চট্টগ্রামে বন্যার অজুহাতে
চড়া সবজির দাম
এদিকে চট্টগ্রাম বু্যরো জানায়, চট্টগ্রামে বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও স্বস্তি মিলছে না সবজির বাজারে। বন্যার অজুহাতে দাম বেড়েছে ধনেপাতাসহ লাউ, বেগুন, করলা, ঢেঁড়স ও পটলের এবং সপ্তাহের ব্যবধানে কমেছে বরবটি, কাকরল, মিষ্টি কুমড়া, পেঁপে ও শসার। এছাড়া বাজারে চালের দামও বাড়তি। তবে অপরিবর্তিত রয়েছে মাছ-মাংসের দাম।
শুক্রবার চট্টগ্রাম নগরের কাজীর দেউড়ি, রেয়াজউদ্দিন বাজার, চকবাজার, বহদ্দারহাট, কর্ণফুলী কাঁচাবাজার ঘুরে সংশ্লিষ্ট বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সবজি ব্যবসায়ীরা বলছেন, টানা বৃষ্টিতে ক্ষেতে পানি জমে সবজি ও কাঁচা মরিচের ক্ষতি হয়েছে। বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যার কারণেও নষ্ট হয়েছে সবজি। তবে সরবরাহ স্বাভাবিক হলে দাম কমে যাবে।
সাধারণ ক্রেতারা বলছেন, বাজার এখনো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। বাজারে সব কিছুর দাম ঊর্ধ্বমুখী। তাই দাম নিয়ন্ত্রণে বাজার মনিটরিং জরুরি।
বাজারে দেখা যায়, ধনেপাতা দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২৩০ টাকা। যা গত সপ্তাহে ২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। লাউ ১০ টাকা বেড়ে ৬০ টাকায়, বেগুন ৩০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়, করলা ২০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়, ঢেঁড়স ২০ টাকা বেড়ে ৮০ টাকা, পটল ১০ টাকা বেড়ে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া বরবটির দাম ২০ টাকা কমে ১০০ টাকায়, কাকরোলে ১০ টাকা কমে ৯০ টাকায়, মিষ্টি কুমড়া ১০ টাকা কমে ৫০ টাকায়, পেঁপে ১০ টাকা কমে ৫০ টাকায় ও শসা ৩০-৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এখনো অপরিবর্তিত রয়েছে কাঁচা মরিচ ও টমেটো। কাঁচা মরিচ ও টমেটো ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া ২০ টাকার নিচে মিলছে না শাকের আঁটি।
বন্যার অজুহাতে দাম বাড়ানো পেঁয়াজের দাম এখনো অপরিবর্তিত রয়েছে। ১২০ থেকে ১২৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতিকেজি রসুন ২২০ টাকা দরে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা।
কর্ণফুলী কাঁচাবাজারের ব্যবসায়ী মো. আনোয়ার বলেন, বন্যার প্রায় সব সবজির ক্ষেতই নষ্ট হয়ে যায়। এতে সবজি সরবরাহ বন্ধ ছিল গত সপ্তাহের আগে পর্যন্ত। কিন্তু এখন কিছু সবজির সরবরাহ বেড়েছে। যেসব সবজির সরবরাহ বেড়েছে সেগুলোর দাম একটু কমেছে। এছাড়া ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন অজুহাতে কমছে না অন্যান্য সবজির দাম।
বাজারে অপরিবর্তিত রয়েছে মাছ-মাংসের দাম। বাজারে আকারভেদে রুই ২৮০ থেকে ৪০০, কাতলা ৩৪০ থেকে ৪০০, মৃগেল ২২০-২৬০, আকার ভেদে পাঙাস ১৮০-২২০, তেলাপিয়া ২০০-২২০, স্যালমন ফিশ ৪৫০, বাগদা চিংড়ি ৮০০, রূপচাঁদা জাত ও আকার ভেদে ৫৫০ থেকে ৭০০, পোয়া মাছ ২৫০, পাবদা ৪০০, সুরমা ৩৫০ থেকে ৫৫০, টেংরা ৩৭০ এবং নারকেলি মাছ ২৫০ টাকা এবং কৈ ৪৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। মাংসের বাজারে গিয়ে দেখা যায়, গরুর মাংস ৮৫০ থেকে ১ হাজার টাকা এবং ছাগলের মাংস ১ হাজার ৫০ থেকে ১ হাজার ১৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
এছাড়া বাজারে চালের দামও বাড়তি। খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি চালের দাম দুই থেকে ছয় টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। পাশাপাশি বেড়েছে ফার্মের ডিমের দাম। প্রতি ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৫৫ থেকে ১৬০ টাকায়। ফার্মের মুরগির সাদা ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকা দরে
জেলা মৎস্য বিভাগের তথ্যমতে, টানা বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম জেলার মীরসরাই, ফটিকছড়ি, হাটহাজারী, রাউজান, সীতাকুন্ডের বিভিন্ন উপজেলার মৎস্য চাষের পুকুর, দিঘি ও হ্যাচারির মাছ ভেসে গিয়ে ২৯০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। ৫ হাজার ৫৪১ হেক্টর জমির ১৬ হাজার ৮৬৪টি মাছ চাষের পুকুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ১৬ হাজার ৫৯৫ টন মাছ ভেসে যাওয়ার পাশাপাশি ১৪ লাখ বিভিন্ন মাছের পোনা এবং ২ লাখ চিংড়ি পোনা ভেসে গিয়ে মৎস্য খাতের বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
সাম্প্রতিক বন্যায় চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলার মধ্যে মীরসরাই, ফটিকছড়ি, সীতাকুন্ড, লোহাগাড়া, সাতকানিয়া, বাঁশখালী ও চন্দনাইশ উপজেলায় তলিয়ে যায় ১ হাজার ৯২২ হেক্টর সবজি বাগান। এছাড়া প্রাণিসম্পদ খাতে ক্ষতি হয়েছে ২০ কোটি ৯৭ লাখ ২৬ হাজার টাকা। এর প্রভাব পড়ে চট্টগ্রামের বাজারগুলোতে।
কর্ণফুলী কাঁচাবাজারে বাজার করতে আসা মো. মারজুক যায়যায়দিনকে বলেন, বাজারে আগের চেয়ে কিছু সবজির দাম কমলেও অনেক জিনিসের দাম পূর্বের দামে এখনও আসেনি। সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়াসহ বাজারগুলোতে নিয়মিত নজরদারিতে বাড়াতে নতুন সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
\হরেয়াজউদ্দিন বাজার কাঁচামাল আড়ত মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শিবলী ফারুক বলেন, সবজির বাজার শুরুতে চড়া ছিল। তবে এখন ধীরে ধীরে কমছে। মনে হয় দাম আরও কমবে। খুচরা বাজারে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াচ্ছে। এসব বিষয়ে প্রশাসনের তদারকি বাড়াতে হবে।