আশুলিয়ায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৪৬ জনকে গুলি করে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী, ২১ পুলিশ সদস্যসহ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ৩৬ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনালের তদন্ত সংস্থায় গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
গত ৫ আগস্ট আশুলিয়ায় মানারাত ইউনিভার্সিটির ইইই বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র নিহত আহনাফ আবীর আশরাফুলস্নাহর বোন সাইয়েদা আক্তারের পক্ষে বৃহস্পতিবার আবেদনটি করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আবদুস সাত্তার পালোয়ান। এনিয়ে ট্রাইবু্যনালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ৯টি অভিযোগ দেওয়া হলো।
এদিকে, স্বামী হত্যার ৯ বছর পর রাজশাহীর পুঠিয়ায় হত্যা মামলা করেছেন এক বিএনপি কর্মীর স্ত্রী। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৩৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। অন্যদিকে, ফেনীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় গুলিতে নিহতের ঘটনায় আওয়ামী লীগ সভাপতির নামে আরও একটি হত্যা মামলা হয়েছে। এতে আরও ৬৬৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। এছাড়া নীলফামারীতে বিএনপি কার্যালয় ভাংচুরের অভিযোগে একটি মামলা হয়েছে। এতেও শেখ হাসিনাকে আসামি করা হয়েছে।
এর আগে ঢাকায় সাতটি এবং চট্টগ্রামে একটি গণহত্যার অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ বিভিন্নজনের বিরুদ্ধে তদন্ত সংস্থায় অভিযোগ দায়ের করা হয়। যেগুলোর ওপর তদন্ত চলমান রেখেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনালের তদন্ত সংস্থা।
৪৬ পোড়া লাশের ঘটনায়
যাদের আসামি করা হয়েছে
আশুলিয়ায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ৪৬ জনকে গুলি করে হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনালের তদন্ত সংস্থায় যে আবেদন করা হয়েছে, তাতে আসামি করা হয়েছে- সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক, সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মাদ আলী আরাফাত, সাভার-আশুলিয়ার সাবেক সংসদ সদস্য মো. সাইফুল ইসলাম, তৎকালীন সরকারের কতিপয় মন্ত্রী, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুলস্নাহ আল মামুন, সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি হারুন অর রশিদ, সাবেক ডিবিপ্রধান হারুন অর রশিদ, সাবেক ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম, ঢাকা জেলার অতিরিক্ত এসপি মোবাশ্বিরা জাহান, সাবেক এসপি আব্দুলস্নাহহিল কাফি, ঢাকা জেলা উত্তরের সাবেক ডিবি পরিদর্শক আরাফাত হোসেন, আশুলিয়া থানার ওসি (তদন্ত) নির্মল চন্দ্র, ওসি এএফএম সায়েদ আহমেদ, এসআই আফজালুল, এসআই জলিল, এসআই মো. রাকিবুল এসআই আবুল হাসান, এসআই হামিদুর রহমান, এসআই নাসির উদ্দিন, এসআই আব্দুল মালেক, এএসআই সুমন চন্দ্র গাইন, এএসআই বিশ্বজিৎ রায়, কসস্টেবল মুকুল, কনস্টেবল রেজাউল করিমসহ কতিপয় পুলিশ সদস্য, আশুলিয়া থানার আওয়ামী লীগ সভাপতি ফারুক হাসান তুহিন ওরফে তুহিন কুলু, ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি নাদিম হোসেন, যুবলীগের আহ্বায়ক কবির হোসেন সরদার, ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মো. শামীম হোসেন, যুবলীগের আলমগীর হোসেন, ছাত্রলীগ সভাপতি সোহাগ, সেক্রেটারি টিটু, সাভার ছাত্রলীগের সভাপতি আতিকুর রহমান আতিক, সাভার আওয়ামী লীগের আলী হায়দারসহ ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্যরা।
অভিযোগে বলা হয়েছে, ৫ আগস্ট আশুলিয়ার বাইপাইলে ছাত্র-জনতার মিছিলে ১ থেকে ১২ নম্বর আসামির নির্দেশে ১৩ থেকে ৩৬নং আসামি নির্বিচারে গুলি চালালে আহনাফসহ ৪৬ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। গুলিবিদ্ধ লাশগুলো ১৩ থেকে ১৬নং আসামিসহ অজ্ঞাতনামা পুলিশ সদস্য ময়লার বস্তার মতো করে ভ্যানে তোলেন। থানার পাশে পুলিশের একটি গাড়িতে পেট্রোল দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে লাশগুলো পুড়িয়ে দিয়ে গণহত্যার নির্মম ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন।
রাজশাহীতে ৯ বছর
পর হত্যা মামলা
আমাদের রাজশাহী অফিস জানায়, স্বামী হত্যার ৯ বছর পর পুঠিয়া থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেছেন এক বিএনপি কর্মীর স্ত্রী। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৩৯ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে।
উপজেলার নামাজ গ্রামের বিএনপিকর্মী নিহত মজির উদ্দিনের স্ত্রী মোসা. মাছুফা বুধবার রাতে পুঠিয়া থানায় মামলাটি করেন বলে জানিয়েছেন পুঠিয়া থানার ওসি কবির হোসেন।
মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম ও সাবেক স্থানীয় সরকার, পলস্নী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী আব্দুল ওয়াদুদ দারাকে আসামি করা হয়েছে।
উলেস্নখযোগ্য অন্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেন- রাজশাহী-৬ আসনের সাবেক এমপি রায়হানুল হক, চারঘাট উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফখরুল ইসলাম, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের পিতা সামছুদ্দিন, পুঠিয়া উপজেলার সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুস সামাদ, পুঠিয়া উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান জিএম হিরা বাচ্চু, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী সিরাজুল, চারঘাট পৌরসভার সাবেক মেয়র একরামুল হক, পুঠিয়া পৌরসভার সাবেক মেয়র রবিউল ইসলাম রবি, বাঘার আড়ানী পৌরসভার সাবেক মেয়র মুক্তার আলী।
এছাড়া পুঠিয়া, চারঘাট, বাঘা উপজেলা ও রাজশাহী মহানগরীর বোয়ালিয়া থানা এলাকার ২৬০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে।
মামলার এজাহারে উলেস্নখ করা হয়েছে, ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি রাজশাহী বানেশ্বর বাজারে গণতন্ত্ররক্ষা দিবস উপলক্ষে ২০ দলীয় জোটের কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগ সন্ত্রাসীদের হামলা ও গুলিবর্ষণে বিএনপির কর্মী মজির উদ্দিন নিহত হন।
নিহত মজির উদ্দিনের ছেলে মাসুদ রানা বলেন, '২০ দলের সমাবেশে মাথায় গুলি লেগে ঘটনাস্থলে আমার বাবা মারা যান। ওই সময় আমাদের মামলা গ্রহণ করা হয়নি। বর্তমান সরকারের অধীনে ন্যায়বিচার পাওয়ার আশায় মামলাটি দায়ের করেছি। আশা করছি আমার পিতার হত্যার বিচার পাব।'
ওসি কবির হোসেন জানান, মামলার এজাহার গ্রহণ করা হয়েছে। তদন্ত করে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ফেনীতে আরেক হত্যা মামলা
ফেনী প্রতিনিধি জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় গুলিতে নিহতের ঘটনায় আরও একটি হত্যা মামলা করা হয়েছে। মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। নিহত শিক্ষার্থী মাহবুবুল হাসান মাসুমের ভাই মাহমুদুল হাসান বাদী হয়ে বুধবার রাতে ফেনী মডেল থানায় হত্যা মামলাটি করেন বলে জানিয়েছেন থানার ওসি মো. রুহুল আমিন।
মাহবুবুল হাসান মাসুম ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার চরচান্দিয়া ইউনিয়নের নোমান হাসানের ছেলে। তিনি ছাগলনাইয়ার আবদুল হক চৌধুরী ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন।
ওসি জানান, মাসুম হত্যা মামলায় আসামিদের তালিকায় দুই নম্বরে রয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সড়ক পরিবহণ ও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, এরপর রয়েছেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
ফেনী-৩ আসনের সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য ও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী এবং ফেনী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারীকে যথাক্রমে চার ও পাঁচ নম্বর আসামি করা হয়েছে। এছাড়া মামলায় ১৬২ জনের নামোলেস্নখসহ অজ্ঞাত আরও ৫০০ জনকে আসামি করা হয়।
মামলার এজাহারে উলেস্নখ করা হয়, গত ৪ অগাস্ট ফেনীর মহিপালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের গুলিবর্ষণে মাহবুবুল আলম মাসুমের মাথা, বুকে ও পিঠে গুলিবিদ্ধ হন। এরপর তাকে ফেনী জেনারেল হাসপাতাল হয়ে চট্টগ্রামের পার্কভিউ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৭ আগস্ট তার অবস্থা আশঙ্কাজনক দেখে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সেদিন সন্ধ্যায় তার মৃতু্য হয়।
এজাহারে বাদী উলেস্নখ করেন, প্রথম চারজন আসামির প্ররোচণা, উসকানি এবং নির্দেশে ৫ নম্বর আসামি অপরাপর আসামিদের নিয়ে শহরের মহিপালে শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচিতে নির্বিচারে গুলি এবং হামলা করে মাসুমকে হত্যা করে।
নীলফামারীতে ১২৫ জনের নামে মামলা
স্টাফ রিপোর্টার, নীলফামারী জানান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সড়ক পরিবহণ মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন এবং নীলফামারী-২ সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূর, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দেওয়ান কামাল আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মমতাজুল হকসহ ১২৫ জনের নাম উলেস্নখ করে আদালতে মামলা হয়েছে।
জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবকদল জেলা শাখার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আব্দুস সালাম বাবলা বাদী হয়ে নীলফামারী আমলি আদালত-১ এ বৃহস্পতিবার মামলাটি দায়ের করেন। মামলায় অজ্ঞাত আরও অন্তত ৩শ' জনকে আসামি করা হয়েছে।
জেলা স্বেচ্ছাসেবকদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আব্দুস সালাম বাবলা জানান, গত চার আগস্ট শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাদ্দাম হোসেনের অনলাইন নির্দেশনায় নীলফামারী জেলা বিএনপি ও তার অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালায় স্থানীয় নেতারা।