চার জেলার হাসপাতালে তিল ধারণের ঠাঁই নেই

বন্যাকবলিত এলাকায় ডায়রিয়ার প্রকোপ নোয়াখালীতে এ পর্যন্ত তিনজনের মৃতু্য সড়কে-গাছতলায় শয্যা পেতে চিকিৎসা

প্রকাশ | ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
দেশের পূর্বাঞ্চলের বন্যাকবলিত চার জেলায় শুরু হয়েছে ভয়াবহ ডায়রিয়ার প্রকোপ। জেলাগুলো হচ্ছে- ফেনী, নোয়াখালী, কুমিলস্না ও লক্ষ্ণীপুর। বন্যার পানি নামার পরপর এসব জেলায় ডায়রিয়ার পাশাপাশি ছড়িয়ে পড়েছে পানিবাহিত নানা রোগ। তাতে নতুন করে ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ। ডায়রিয়ার প্রকোপ বাড়ায় হাসপাতালেও বেড়েছে রোগীর চাপ। ওয়ার্ডে শয্যা না পেয়ে অনেকে হাসপাতালের মেঝে, গাছতলা ও সড়কে শয্যা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে চিকিৎসকদের। স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, এরই মধ্যে নোয়াখালীতে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তিনজনের মৃতু্য হয়েছে। প্রতিদিনই শত শত রোগী চার জেলার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্স ও জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে শিশুর সংখ্যাই বেশি। চার জেলার স্বাস্থ্য বিভাগ ও হাসপাতাল থেকে জানানো হয়েছে, বন্যাকবলিত এলাকায় তাদের চিকিৎসক দল দিন-রাত কাজ করছেন। তাদের কাছে পর্যাপ্ত ওষুধ ও স্যালাইন রয়েছে। হাসপাতালে রোগীর চাপ থাকলেও ওষুধের বা সেবার কোনো ঘাটতি নেই। বন্যায় ত্রাণ ও উদ্ধারে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবীরা বলছেন, যারা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন, সরকারিভাবে শুধু তাদের তথ্যই পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে। তাদের তথ্য সরকারিভাবে নেই। ফলে আক্রান্তের সংখ্যা সরকারিভাবে যা জানা যাচ্ছে প্রকৃতপক্ষে তা আরও অনেক বেশি। তারা বলছেন, ত্রাণ দিতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, অনেক মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন কিন্তু তারা বাড়িতেই আছেন। অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রে এসেও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন। কিন্তু সব জায়গায় তারা চিকিৎসা পাচ্ছেন না। পরিস্থিতি খারাপ হলেই তারা হাসপাতালে যাচ্ছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বন্যায় টিউবওয়েল ডুবে যাওয়ায় সুপেয় পানির অভাবে চার জেলার গ্রামীণ জনপদের অনেক জায়গায় মানুষ বেশি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছেন। এছাড়া চারদিকে পানি থাকায় অনেকে বের হতে না পেরে বাড়িতেই প্রাথমিকভাবে চিকিৎসা নিচ্ছেন। যখন পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে তখন তারা হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সগুলোতে ভর্তি হচ্ছেন। এতে মৃতু্যর শঙ্কা বাড়ছে। ফেনীতে সড়কে-গাছতলায় শয্যা পেতে চিকিৎসা ফেনীর স্বাস্থ্য কমপেস্নক্স ও হাসপাতালগুলোতে বেড়েছে ডায়রিয়া রোগের সংখ্যা। এর সঙ্গে শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, জ্বর ও আমাশয়সহ বিভিন্ন পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। জেলার ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ডায়রিয়া ওয়ার্ডে শয্যার বিপরীতে অতিরিক্ত রোগী থাকায় হাসপাতালের মেঝে, বারান্দা ও ওয়ার্ডের বাইরে সড়কে, গাছতলায় চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন ডায়রিয়া রোগীরা। জেলা সিভিল সার্জন মোহাম্মদ শিহাব উদ্দিন বলেন, 'ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। ফেনীর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালসহ জেলার আরও পাঁচটি উপজেলায় স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সগুলোতে প্রতিনিয়ত ডায়রিয়া রোগী ভর্তি হচ্ছে। ওয়ার্ডে শয্যা সংখ্যার ১০ গুণ রোগী বেশি থাকায় চিকিৎসকরা সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন।' জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ফেনী জেনারেল হাসপাতালে ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ১৮টি বেডের বিপরীতে ভর্তি রয়েছেন ১৮৪ জন, যার মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছেন ৭৬ জন। এ ছাড়া সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন ১৯ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন নয়জন। ছাগলনাইয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন ৩৬ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন ভর্তি হয়েছেন ১৫ জন। দাগনভূঞা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন ৩২ জন। ২৪ ঘণ্টায় নতুন ভর্তি হয়েছেন ১৭ জন। ফুলগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন ১৪ জন। ২৪ ঘণ্টায় নতুন ভর্তি হয়েছেন ১২ জন। পরশুরাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে ভর্তি রয়েছে ১৩ জন। ২৪ ঘণ্টায় নতুন ভর্তি হয়েছেন আটজন।' ফেনী জেনারেল হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে শিশু রোগীদের বাইরের রাস্তায় ও বাগানে বিছানা পেতে খোলা আকাশের নিচে চিকিৎসাসেবা নিচ্ছেন অভিভাবকরা। একই চিত্র শিশু ওয়ার্ডেও। ফেনীর বেতাগাঁও এলাকা থেকে ডায়রিয়া আক্রান্ত মেয়েকে নিয়ে এসেছেন হাজেরা আক্তার। এক ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর নার্সরা স্যালাইন লাগিয়ে গেলেও ভেতরে জায়গা না পেয়ে রাস্তার পাশে মাদুর পেতে বসে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তিনি। মোসলেহ উদ্দিন নামে আরেক রোগীর অভিভাবক বলেন, 'ডায়রিয়া ওয়ার্ডে শিশু রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। ওয়ার্ডের ভেতরে যতজন রোগী তার থেকে কয়েকগুণ বেশি বাইরে খোলা আকাশের নিচে চিকিৎসা নিচ্ছেন। মাত্র ৩-৪ নার্স রোগীদের সেবা দিচ্ছেন, যা অপ্রতুল। এখানে নার্স ও চিকিৎসক বাড়ানো প্রয়োজন।' ফেনী জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) মোহাম্মদ নাজমুল হাসান সাম্মী বলেন, 'বিপুলসংখ্যক রোগীকে স্বল্প পরিসরে সেবা দেওয়া আমাদের জন্য খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এ কারণেই মূলত রোগীরা কেউ মেঝেতে কেউ বাইরে অবস্থান করে চিকিৎসা নিচ্ছেন।' নোয়াখালীতে শয্যার ১০ গুণ বেশি রোগী নোয়াখালীতে ডায়রিয়া আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। সরকারি হাসপাতালে রোগীর চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক, নার্সরা। বেডে জায়গা না হওয়ায় মেঝেতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে অনেক রোগীকে। জেলা সিভিল সার্জন মাসুম ইফতেখার জানিয়েছেন, 'নোয়াখালীর আট উপজেলার স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে বুধবার পর্যন্ত ২২০ জন এবং নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে ২৮০ জন রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ পর্যন্ত ডায়রিয়ায় তিনজনের মৃতু্য হয়েছে।' নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) সৈয়দ মহিউদ্দিন আবদুল আজিম জানান, তাদের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে শয্যা ১৬টি। চিকিৎসা নিচ্ছেন এর কয়েকগুণ বেশি রোগী। বেডে জায়গা না হওয়ায় মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেকে। ডায়রিয়া ওয়ার্ডে স্থান সংকুলান না হওয়ায় হাসপাতালের নির্মাণাধীন ভবনের দ্বিতীয় তলায় জরুরি ভিত্তিতে একটি ডায়রিয়া ওয়ার্ড খোলা হয়েছে। সেখানেও জায়গা সংকুলান না হওয়ায় মেঝেতে রোগী রেখে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। কাদির হানিফ ইউনিয়নের কৃষ্ণরামপুর এলাকার মো. আল আমিনের সাত মাসের ছেলে সন্তান ও ছোট বোনের এক বছরের ছেলে মঙ্গলবার ভর্তি হয়েছে। তিনি বলেন, 'পর্যাপ্ত নার্স, ডাক্তার না থাকায় চিকিৎসা ঠিকমত পাচ্ছি না।' বেগমগঞ্জের পূর্ব হাজিপুরের সায়েদুল হক (৭০) চৌমুহনীতে একটি বেসরকারি হাসপাতালে দুইদিন চিকিৎসা নিয়ে সেখানে অবস্থার উন্নতি হচ্ছে না দেখে মঙ্গলবার রাতে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে এসে ভর্তি হয়েছেন। তার স্বজনরা বলছিলেন, বন্যার মধ্যে তিনি গ্রামের বাড়িতে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হন। প্রাথমিকভাবে খুব অসুস্থ না হওয়ায় তাকে উপজেলাতেই চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু আরও দুর্বল হয়ে পড়ায় শেষ পর্যন্ত তাকে জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। কুমিলস্নার ৩ উপজেলায় বাড়ছে রোগীর চাপ কুমিলস্না জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তবে বিষয়টি নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। সার্বিকভাবে কুমিলস্নার পরিস্থিতি ভালো রয়েছে। কুমিলস্নার ডেপুটি সিভিল সার্জন মুহাম্মদ নাজমুল আলম বলেন, '২১ আগস্ট থেকে কুমিলস্না জেলার ১৭টি উপজেলায় ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৯৭৭ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে এসে চিকিৎসা নিয়েছেন ৮১ জন ডায়রিয়া রোগী। বন্যার পানি কমতে শুরু করায় ডায়রিয়া ও বিভিন্ন চর্মরোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। তবে এ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। আমাদের প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সে পর্যাপ্ত পরিমাণে ওষুধ ও স্যালাইন রয়েছে। তিনি জানান, আশ্রয়কেন্দ্রসহ বন্যাদুর্গত এলাকায় তাদের ২২৫টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। প্রতিটি এলাকায় মানুষকে অসুস্থ হলে দ্রম্নত হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার জন্য পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। চৌদ্দগ্রাম উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. গোলাম কিবরিয়া টিপু বলেন, 'বন্যার পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বর্তমানে আমাদের হাসপাতালে ১৫ জন ডায়রিয়া রোগী ভর্তি রয়েছেন। এই হাসপাতালে প্রতিদিনই আট থেকে ১০ জন করে ডায়রিয়ার রোগী আসছেন। বানভাসি মানুষদের সচেতন করতে আমাদের মেডিকেল টিম কাজ করছে।' নাঙ্গলকোট উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা দেবদাস দেব বলেন, 'মানুষকে পানি বিশুদ্ধকরণের পর্যাপ্ত পরিমাণে ট্যাবলেট দেওয়া হচ্ছে। ওষুধ ও খাবার স্যালাইন পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। সার্বিকভাবে অন্যান্য উপজেলার চেয়ে আমাদের পরিস্থিতি ভালো রয়েছে।' লক্ষ্ণীপুরে ১০৭ রোগীর ৭৬ জনই শিশু ভয়াবহ বন্যায় বুধবার পর্যন্ত লক্ষ্ণীপুরে ৯০৫ জন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। জেলা সিভিল সার্জন আহমেদুল করিম জানান, ২২ জুলাই থেকে বুধবার পর্যন্ত তারা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। আর গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত হয়েছেন ১১৮ জন। লক্ষ্ণীপুর ১০০ শয্যা সদর হাসপাতালে যত ডায়রিয়া রোগী ভর্তি আছেন, তার বেশিরভাগই বন্যাকবলিত এলাকা থেকে এসেছেন। আশ্রয়কেন্দ্রে অসুস্থ হয়েও অনেকে এসেছেন। আছিয়া খাতুন তার সাত বছরের ছেলে আরমানকে নিয়ে কয়েকদিন ধরেই ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ভর্তি। তিনি বলেন, 'বন্যার সময় আমরা পানিবন্দি ছিলাম। আমাদের ঘরে হাঁটুপানি ছিল, আমাদের টিউবওয়েল পানির নিচে ছিল। খাওয়ার পানির সমস্যা ছিল তখন। ত্রাণের সঙ্গে পানির বোতল দিছিল। আমরা ঘরে রান্না করে খেয়েছি। তারপরও আমার ছেলে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে।' লক্ষ্ণীপুর সদর হাসপাতালে ডায়রিয়া ওয়ার্ডে তিল ধারণের জায়গা নেই। হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) অরূপ পাল বলেন, '১০ শয্যার ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ১০৭ রোগীকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। ১০০ শয্যার হাসপাতালে বুধবার রোগী ভর্তি রয়েছেন ৩৮০ জন। চিকিৎসা সেবা দিতে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।'