বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় সহিংসতায় নিহতের ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নামে আরও ৫টি হত্যা মামলা হয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীর রামপুরায় আমীর হোসেন ও উত্তরায় হাফেজ মাওলানা হাবিবুলস্নাহ বাহার হত্যায় পৃথক দুটি মামলা দায়ের করা হয়। অন্যদিকে ময়মনসিংহের গৌরীপুরে গুলিতে তিনজন নিহতের ঘটনায় দুটি হত্যা মামলা হয়েছে। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে মোটর মেকানিক মোস্তাফা কামাল রাজু ও পোশাক শ্রমিক মিনারুল ইসলাম হত্যার অভিযোগ এনে দুটি মামলা হয়। তবে মিনারুল হত্যা মামলায় শেখ হাসিনার নাম না থাকলেও শামীম ওসমান ও আইভীসহ ১৩০ জনকে আসামি করা হয়েছে। মঙ্গলবার থেকে বুধবার এসব মামলা হয়।
রামপুরা উত্তরায় দুই মামলা : পৃথক দুই ব্যক্তিকে হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ৮০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। বুধবার পৃথক দুই ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নিহতের স্বজনরা মামলা দুটি করেন। এর মধ্যে রাজধানীর রামপুরায় আমীর হোসেন নামে এক ব্যক্তি গুলিতে নিহতের ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২৪ জনের নামে হত্যা মামলা
করা হয়। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আফনান সুমীর আদালতে নিহতের স্ত্রী আন্নী মামলাটি করেন। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে অভিযোগের বিষয়ে পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
অপর আসামিদের মধ্যে রয়েছেন- সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক কামরুজ্জামান (পলাশ), এ বি এম সিদ্দিক।
গত ১৯ জুলাই বিটিভি ভবনের সামনে উপরোক্ত আসামিদের নির্দেশে অন্য আসামিরা আমীর হোসেনকে গুলি করে হত্যা করে বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে।
অন্যদিকে রাজধানীর উত্তরায় হাফেজ মাওলানা হাবিবুলস্নাহ বাহার হত্যা মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকসহ ৫৬ জনকে আসামি করা হয়েছে।
ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট ফারজানা শাকিলা সুমু চৌধুরীর আদালতে হাবিবুলস্নাহ বাহারের প্রতিবেশী চাচা আশরাফ সিদ্দিকী মামলাটি করেন। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে অভিযোগটি উত্তরা পশ্চিম থানাকে এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দেন।
মামলার অপর আসামিদের মধ্যে রয়েছেন- ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুলস্নাহ আল মামুন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ১৯ জুলাই উত্তরা ৯নং সেক্টরে আধুনিক মেডিকেলের পাশে উপরোক্ত আসামিদের নির্দেশে অন্য আসামিরা গুলি ছোড়ে। এতে হাফেজ মাওলানা হাবিবুলস্নাহ বাহার গুলিবিদ্ধ হন। পরদিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
সিদ্ধিরগঞ্জে পৃথক দুই মামলা
আমাদের নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, সিদ্ধিরগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিতে মোটর মেকানিক মোস্তফা কামাল রাজু (৩৫) ও পোশাক কারখানার শ্রমিক মিনারুল ইসলাম (২৯) নিহতের ঘটনায় পৃথক দুটি হত্যা হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় নিহত মোস্তফার স্ত্রী আকলিমা আক্তার এবং নিহত মিনারুলের ভাই নাজমুল হক বাদী হয়ে পৃথক মামলা দুটি করেন।
মোস্তফা নিহতের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানসহ ৪০ জনের নাম রয়েছে। মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে আরও ১৫০ থেকে ২০০ জনকে। আসামিরা আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত।
মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে আকলিমা আক্তারের করা মামলার উলেস্নখযোগ্য আসামিরা হলেন সাবেক সংসদ সদস্য (এমিপ) শামীম ওসমান, তার ছেলে অয়ন ওসমান, ভাতিজা আজমেরী ওসমান ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মজিবুর রহমান। মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নারায়ণগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আমীর খসরু।
নিহত মোস্তফা কামাল সিদ্ধিরগঞ্জের নতুন মহলস্না এলাকায় ভাড়া থাকতেন। তার গ্রামের বাড়ি লক্ষ্ণীপুর জেলার রামগঞ্জের পশ্চিম বিঘা এলাকায়।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, গত ২০ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র-জনতার আন্দোলন শুরু হলে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী নিপীড়ন ও নির্যাতন শুরু করেন। ওইদিন বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে আন্দোলনকারীরা সিদ্ধিরগঞ্জের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ডাচ-বাংলা ব্যাংকের সামনে জড়ো হন। এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র, পিস্তল, বন্দুক, রাইফেল, রড নিয়ে হামলা চালানো হয়। এ সময় ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটে। ছোড়া হয় এলোপাতাড়ি গুলি। এতে মোস্তফা কামালের মাথায় গুলি লাগে। আশপাশের লোকজন তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২২ আগস্ট মোস্তফা কামাল মারা যান।
মিনারুল ইসলাম নিহতের ঘটনায় সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক সংসদ সদস্য শামীম ওসমান, সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীসহ ১৩০ জনকে আসামি করা হয়েছে। সিদ্ধিরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বকর সিদ্দিক মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, ১ নম্বর আসামি ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশে সারাদেশের আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগ ও সন্ত্রাসীদের দ্বারা ছাত্র আন্দোলনকে প্রতিহত করার নির্দেশ প্রদান করলে ২ নম্বর থেকে ৫ নম্বর আসামির নেতৃত্বে ৩ থেকে ৪শ' জন আওয়ামী সন্ত্রাসীরা বন্দুক, সাটারগান, পিস্তল, তলোয়ার, রামদা, চাপাতিসহ অত্যাধুনিক দেশি ও বিদেশি অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ছাত্র-জনতাকে প্রতিহত করার চেষ্টাকালে আদমজী রোডস্থ আল আমিন নগর পাওয়ার হাউসের সম্মুখে তাদের হাতে থাকা ককটেল বোমা বিস্ফোরণ ঘটাতে ঘটাতে সামনের দিকে আগাতে থাকা অবস্থায় আসামিরা তাদের সঙ্গে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে চারদিকে গুলি ছুড়তে থাকে।
সূত্রে আরও জানা গেছে, গত ২০ জুলাই সন্ধ্যা অনুমান ৬টায় মিনারুল ইসলাম মুজিব ফ্যাশনের সামনে এলে ঘটনার সামনে পরে গেলে ২ নম্বর আসামি শামীম ওসমান তার হাতে থাকা আগ্নোয়াস্ত্র দিয়ে তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়লে ওই গুলি মিনারুলের বামদিকের কিডনির নিচে বিদ্ধ হয়। সে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে তার সঙ্গে থাকা মো. সাইদুল ইসলাম, কাওসার ও ডালিম মোলস্না হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে।
গৌরীপুরে পৃথক দুই মামলা
ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলায় গুলিতে তিনজন নিহতের ঘটনায় আলাদা দুটি মামলা হয়েছে। দুই মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানাসহ ৭১১ জনকে আসামি করা হয়েছে। মঙ্গলবার উপজেলার ডৌহাখলা ইউনিয়নের কৃষক দল নেতা আবুল কাশেম বাদী হয়ে ময়মনসিংহ জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে ৯৭ জনের নামসহ অজ্ঞাত পরিচয় ২০০ থেকে ৩০০ আসামি করে মামলার আবেদন করেন।
পরে বিচারক আসমা সুলতানা মামলাটি আমলে নিয়ে গৌরীপুর থানায় পুলিশের করা আরেকটি মামলায় একীভূত করে জেলা গোয়েন্দা শাখা পুলিশকে তদন্তের নির্দেশ দেন বলে জানান আদালতের উপ-পরিদর্শক আনোয়ার হোসেন।
এর আগে ২৯ অগাস্ট ডৌহাখলা ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুর রহিম আকন্দ বাদী হয়ে ৬৪ জনের নাম উলেস্নখসহ অজ্ঞাত পরিচয় ২০০ থেকে ২৫০ জনকে আসামি করে মামলার আবেদন করেন।
পরে বিচারক আসমা সুলতানা মামলাটি আমলে নিয়ে গৌরীপুর থানায় পুলিশের করা মামলা একীভূত করে জেলা গোয়েন্দা শাখা পুলিশকে তদন্তের নির্দেশ দেন।
দুটি মামলাতেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহেনা, সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে আসামি করা হয়েছে।
উলেস্নখযোগ্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেন- ময়মনসিংহ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মোহিত উর রহমান শান্ত, ময়মনসিংহ-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য নিলুফার আঞ্জুম পপি, গৌরীপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সোমনাথ সাহা এবং সাবেক পৌর মেয়র সৈয়দ রফিকুল ইসলাম।
মামলায় বলা হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে ২০ জুলাই গৌরীপুর উপজেলার ডৌহাখলা ইউনিয়নের কলতাপাড়া এলাকায় ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়ে বিপস্নব হাসান (২০), নূরে আলম সিদ্দিকী ওরফে রাকিব (২০) এবং জোবায়ের আহমেদ (২১) মারা যান।
নিহত বিপস্নব কলতাপাড়া বাজার এলাকায় চূড়ালি গ্রামে বাসিন্দা ও স্থানীয় তেলের মিলের শ্রমিক, নূরে আলম সিদ্দিকী রামগোপালপুর ইউনিয়নের দামগাঁও গ্রামের বাসিন্দা ও মাদ্রাসা শিক্ষক এবং জোবায়ের মইলাকান্দা ইউনিয়নের পূর্ব কাউরাট গ্রামের বাসিন্দা ও শম্ভুগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী ছিলেন।
ঘটনার দিন সকালে ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ সড়কের কলতাপাড়া বাজারে তালু স্পিনিং মিলের সামনে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে ওই তিনজন মারা যায়। আহত হয় আরও অন্তত ২০ জন।
ওই তিন তরুণ নিহতের ঘটনায় তাদের পরিবারের সদস্যদের সাক্ষী করে আদালতে মামলা করা হয়েছে।
এর আগে ২২ জুলাই ওই তিন তরুণ নিহতের ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা না করায় গৌরীপুর থানার এসআই মো. শফিকুল আলম বাদী হয়ে একটি মামলা করেন।