দেশের বন্যা পরিস্থিতি
এখনো পানিবন্দি ৫ লক্ষাধিক পরিবার
প্রকাশ | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
চলমান বন্যায় এখনো ৫ লাখ ৮২ হাজার ১৫৫টি পরিবার পানিবন্দি রয়েছে। তবে পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় আশ্রয়কেন্দ্র থেকে লোকজন বাড়িঘরে ফিরছেন। এখনো আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন ২ লাখ ৮৫ হাজার ৯৯৬ জন মানুষ। বন্যাকবলিত ১১ জেলায় মৃতের সংখ্যা ৭১ জনে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ২৮ জনই মারা গেছে ফেনীতে।
এদিকে, ধীরগতিতে নামতে শুরু করেছে কুমিলস্নায় বন্যার পানি। আর তাতেই
জেগে উঠতে শুরু করেছে বন্যার ক্ষতগুলো। অন্যদিকে, ফেনী শহরের মধুপুর পানিতে তলিয়ে আছে। লক্ষ্ণীপুরে ভারী বৃষ্টিপাতে বন্যার পানির উচ্চতা বেড়েছে। এসব এলাকার মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তবে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের পর দাতা সংস্থাগুলো পুনর্বাসনে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম।
মঙ্গলবার সচিবালয়ে চলমান বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কে এম আলী রেজা জানান, বন্যায় মৃত লোকসংখ্যা ৭১ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৪৫ জন, নারী ৭ জন ও শিশু ১৯ জন। কুমিলস্নায় ১৯, ফেনীতে ২৮, চট্টগ্রামে ৬, খাগড়াছড়িতে ১, নোয়াখালীতে ১১, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১, লক্ষ্ণীপুরে ১, কক্সবাজারে ৩ ও মৌলভীবাজারে ১ জন মারা গেছেন। এখনো মৌলভীবাজারে একজন নিখোঁজ।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, হবিগঞ্জ, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কক্সবাজার জেলার বন্যা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। মৌলভীবাজারের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে এবং ফেনী, কুমিলস্না, নোয়াখালী ও লক্ষ্ণীপুর জেলার বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে।
এখনো ৫ লাখ ৮২ হাজার ১৫৫টি পরিবার পানিবন্দি রয়েছে জানিয়ে অতিরিক্ত সচিব বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত মোট লোকসংখ্যা ৫০ লাখ ২৪ হাজার ২০২ জন।
সার্বিকভাবে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় আশ্রয়কেন্দ্র থেকে লোকজন বাড়িঘরে ফিরছেন। এখনো ৩ হাজার ৬১২টি আশ্রয়কেন্দ্রে মোট ২ লাখ ৮৫ হাজার ৯৯৬ জন লোক এবং ৩১ হাজার ২০৩টি গবাদি পশু রয়েছে বলেও জানিয়েছেন আলী রেজা।
বন্যা উপদ্রম্নত এলাকায় সরকারি-বেসরকারিসহ সব পর্যায়ে থেকে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে জানিয়ে অতিরিক্ত সচিব বলেন, বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণের প্রক্রিয়া চলমান।
কুমিলস্নায় জেগে উঠছে ক্ষত
এদিকে, ১৫ দিনের বেশি সময় পর ধীরগতিতে নামতে শুরু করেছে কুমিলস্নায় বন্যার পানি। আর তাতেই জেগে উঠতে শুরু করেছে বন্যার ক্ষতগুলো। ইতোমধ্যে বন্যাকবলিত জেলার ১৪টি উপজেলায় ছড়িয়ে পড়েছে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগবালাই। দেখা দিয়েছে সুপেয় পানির তীব্র সংকট। দৃশ্যমান হচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাটগুলো। আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা মানুষগুলো ফিরে এসে দেখছেন, ভেঙে পড়েছে অনেকের ঘরবাড়ি।
গোমতীর ভাঙনকবলিত বুড়িচং উপজেলার বেড়িবাঁধ সংলগ্ন অন্তত ছয়টি গ্রামের মানুষের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
কুমিলস্না জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ নাসরুলস্নাহ সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, বিশুদ্ধ পানি সংকট রয়েছে। তড়িৎ ব্যবস্থায় আপাতত উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত এ কার্যক্রম চলমান থাকবে।
লক্ষ্ণীপুরে পানির উচ্চতা বেড়েছে
লক্ষ্ণীপুরে ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। এতে বন্যার পানির উচ্চতা বেড়েছে। সোমবার রাতে জেলাতে টানা ভারী বৃষ্টি হয়। ফলে বন্যা পরিস্থিতি অবনতি হয়েছে।
বন্যাকবলিত এলাকার বাসিন্দারা জানান, লক্ষ্ণীপুরে গত কয়েকদিন ধরে খুব ধীরগতিতে পানি নামা শুরু করে। এতে দিনে এক-দুই ইঞ্চি পানির উচ্চতা কমছে। কিন্তু সোমবার রাতে ভারী বৃষ্টিতে পানির উচ্চতা আরও দুই ইঞ্চির মতো বেড়েছে। বন্যার পানি বাড়ায় দুর্ভোগ আরও বাড়বে।
লক্ষ্ণীপুর রামগতির আবহাওয়া অফিসের সিনিয়র আবহাওয়া অবজারভার সোহরাব হোসেন সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, রামগতিতে ২৪ দশমিক ৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
ফেনী শহরের মধুপুর পানির নিচে
ফেনীতে বন্যা পরিস্থিতি অনেকটা উন্নতির দিকে। এখনো পানিবন্দি রয়েছে লাখো মানুষ। তবে পস্নাবিত বিভিন্ন এলাকা থেকে ধীরগতিতে নামছে পানি। বন্যার সময় যারা বাড়িঘর ছেড়েছেন তারা বাড়িতে ফেরা শুরু করেছেন।
বাড়ি ফেরা মানুষ জানান, তাদের সাজানো সংসারের সব কিছু বন্যা ধ্বংস করে দিয়েছে। কারো বাড়িতেই বর্তমানে কোনো ফার্নিচার ও ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী ব্যবহার উপযোগী নেই। বাড়ির কোনো লেপ-তোষকও আর ব্যবহার করা যাবে না।
এখনো শহরের মধুপুর পানিতে তলিয়ে আছে। সদর উপজেলার মোটবি, শর্শদি, ধলিয়া, পাঁচগাছিয়া, ফাজিলপুর, ধর্মপুর ও ফরহাদ নগরের বিভিন্ন গ্রামের মানুষ এখনো পানিবন্দি রয়েছে। দাগনভূঞার পূর্বচন্দ্রপুরসহ বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের মানুষ পানিবন্দি থেকে এখনো মুক্তি পায়নি। অন্যান্য উপজেলার নিম্নাঞ্চল এখনো পানির নিচে রয়েছে।
ফেনীর জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার সংবাদ মাধ্যমকে জানান, বন্যায় জেলার প্রায় ১০ লাখ মানুষ দুর্যোগের শিকার হয়েছেন।
পুনর্বাসনে সহযোগিতা
করবে দাতা সংস্থাগুলো
এদিকে, বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের পর দাতা সংস্থাগুলো পুনর্বাসনে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম।
মঙ্গলবার সচিবালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে উপদেষ্টা এ কথা জানান। এর আগে তিনি বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের সমন্বয়ক, আইএলওর কান্ট্রি ডিরেক্টর, আইওএম চিব অব মিশন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি, ডবিস্নউএফপির ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর, ইউনিসেফের ডেপুটি রিপ্রেজেন্টেটিভ, ইউএনআরসিও হিউম্যান্টেরিয়ান অ্যাফেয়ার অ্যাডভাইজারের সঙ্গে বৈঠক করেন।
উপদেষ্টা বলেন, 'আমরা বন্যার ত্রাণ পর্যায়টা অতিক্রম করে পুনর্বাসন পর্যায়ের দিকে যাচ্ছি। এক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের যে বিষয়টি, সেটির কাজ খুব দ্রম্নত চলছে।'
বন্যার্তদের পুনর্বাসনে সহায়তার জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এগিয়ে এসেছে জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, 'আমি আজ ইউএন (জাতিসংঘ) বডির আটটি নানা রকমের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সভা করেছি। তারা এই (পুনর্বাসন) কাজে যুক্ত হওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তারা বাংলাদেশের মানুষের অপার স্বেচ্ছাসেবা, অভূতপূর্ব সহযোগিতার জন্য প্রশংসা করেছেন। ত্রাণ কার্যক্রমে সেনাবাহিনী ও জনগণের যে উদ্দীপনা তারা দেখেছেন, ত্যাগ তারা দেখেছেন- এটার প্রশংসা করেছেন।'
তিনি বলেন, 'মাঠপর্যায় থেকে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের পর কোন কোন বিষয়ে তারা সহযোগিতা দিতে পারেন সেটা আমরা নির্ণয় করে দিলে তারা সর্বাত্মক সহযোগিতা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত আশাবাদী যে, আমরা দুর্যোগ যেভাবে সাহসিকতার সঙ্গে সাধারণ মানুষ ও স্বেচ্ছাসেবীদের সহযোগিতায় অতিক্রম করতে পেরেছি, আমরা ভবিষ্যতে পুনর্বাসন কর্মসূচিও সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে পারবো।'
উপদেষ্টা বলেন, 'ডি-ফরমের মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতির তথ্য দেওয়ার একটি সময় রয়েছে। সেটি তিন সপ্তাহের মধ্যে দিতে হয়। আমরা সেটি এক সপ্তাহের মধ্যে করতে বলেছি, যত দ্রম্নত করা যায়।'