নানা ধরনের অপরাধ বাড়ছে ঘটছে খুনের মতো অপরাধও

পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় অপরাধীরা সক্রিয়!

প্রকাশ | ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

গাফফার খান চৌধুরী
নানা কারণে মাঠপর্যায়ে সক্রিয় হতে পারছে না পুলিশ। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় সক্রিয় হয়ে উঠছে অপরাধীরা। ঘটছে চুরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, দখল, পাল্টা দখল, ছিনতাই, খুনসহ বহুমাত্রিক অপরাধ। অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে অপরাধ সংঘটিত করে প্রতিপক্ষের ঘাড়ে দায় চাপানোরও চেষ্টা চলছে। মূল অপরাধীরা নিজেদের আড়ালে রাখতে ঢাকার বাইর থেকে ভাড়া করা সন্ত্রাসীদের দিয়ে অপরাধ সংঘটিত করছে। এমনকি পুলিশকে নানাভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন জায়গায় পুলিশকে আপাতত দৃশ্যমান দেখা গেলেও তাদের মাঠপর্যায়ে কোনো কার্যক্রম নেই। বাহিনীটির সদস্যদের মন থেকে অজানা আতঙ্ক কাটেনি। তাই পুলিশের কার্যক্রম থানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। অনেক থানায় জ্বালিয়ে দেওয়ার কারণে, ওইসব থানায় কোনো নথিপত্র নেই। এমন সুযোগটিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে ওইসব থানা এলাকার স্থানীয় প্রভাবশালীরা। তারা দীর্ঘ দিনের ক্ষোভ থেকে নানা অপরাধ সংঘটিত করছে। এসব ক্ষেত্রে মূল মাস্টারমাইন্ডরা আড়ালে থাকছেন। তারা ঢাকার বাইরে থেকে ভাড়া করা সন্ত্রাসী এনে নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত করছে। এতে করে ওইসব অপরাধের রহস্য উদ্ঘাটন করা কঠিন হবে। অপরাধীরা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি চতুরতার সঙ্গে অপরাধ সংঘটিত করছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় ঢাকার অধিকাংশ এলাকার রাস্তায় থাকা সিসি ক্যামেরা পরিকল্পিতভাবে নাশকতাকারীরা ভেঙে ফেলেছে। এখনো ঢাকার অর্ধেক এলাকায় সিসি ক্যামেরা আবার বসানো সম্ভব হয়নি। এমন সুযোগও নিচ্ছে অপরাধীরা। তারা যেসব জায়গায় সিসি ক্যামেরা নেই, সেসব এলাকায় অপরাধ সংঘটিত করছে। অভ্যন্তরীণ ও প্রতিপক্ষের সঙ্গে পূর্বশত্রম্নতার জেরে হত্যাকান্ডের মতো অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এসব হত্যাকান্ড সংঘটিত হওয়ার পর মামলা নেওয়ার ক্ষেত্রে মূল অপরাধীরাই পুলিশকে নানাভাবে তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, রোববার বিকালে ঢাকার মোহাম্মদপুর থানা এলাকায় অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে বিলস্নাল ওরফে দাঁত ভাঙ্গা বিলস্নাল ওরফে ফাইটার বিলস্নাল নামে এক যুবককে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ঘটনাটি সন্ধ্যায় ঘটলেও পুলিশ খবর পায় গভীর রাতে। অন্যদের মাধ্যমে রাস্তার একটি গলির ভেতর অজ্ঞাত এক যুবকের রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে বলে বেনামি মোবাইল থেকে ফোন দিয়ে পুলিশকে জানানো হয়। খবর পেয়ে মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ ওই যুবকের লাশ উদ্ধার করে। পুরো রাত চলে গেলেও তার পরিচয় শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। সকালে ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে পরিবারের সদস্যরা শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে গিয়ে বিলস্নালের লাশ শনাক্ত করে। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে মোহাম্মদপুর থানার ওসি ইফতেখার হাসান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে যায়যায়দিনকে জানান, গত ৫ আগস্টের পর মোহাম্মদপুর থানায় ছাত্র-জনতার আড়ালে সন্ত্রাসীরা পরিকল্পিতভাবে মোহাম্মদপুর থানায় হামলা করে। থানার সব জিনিসপত্র ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। আগুনে থানায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষসহ সন্ত্রাসীদের তালিকাও পুরোপুরি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। যে কারণে বিলস্নালকে শনাক্ত করতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। প্রাথমিকভাবে তার বাড়ি চাঁদপুর বলে জানা গেছে। বিলস্নাল একজন সন্ত্রাসী প্রকৃতির লোক ছিলেন বলে প্রাথমিকভাবে আমরা জানতে পেরেছি। মাদক ছাড়াও নানা ধরনের অপরাধে জড়িত থাকার কথা জানা যাচ্ছে। তিনি মূলত সাভারে থাকতেন। সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালাতে তিনি মোহাম্মদপুর এসেছিলেন বা ভাড়া করে আনা হয়েছিল বলে বিভিন্ন নূত্রে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। যদিও এসব তথ্যকে নির্ভরযোগ্য বলে আমরা মনে করছি না। তিনি আরও বলেন, সোমবার বিকালে পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। হত্যাকান্ডের ঘটনায় বিলস্নালের পরিবারের তরফ থেকে দায়ের করা মামলাই চূড়ান্ত মামলা বলে ধরে নেওয়া হবে। সেখানে বিলস্নালের পরিবার কাকে আসামি করবে কি করবে না, তা আমাদের দেখার দায়িত্ব না। যদিও নানাভাবে বিলস্নাল হত্যাকান্ডে অনেকেই জড়িত বলে শোনা যাচ্ছে। তবে আপাতত সেসব তথ্য আমরা আমলে নিচ্ছি না। কারণ, এখন পুলিশের জন্য সত্যিকার অর্থেই একটি খারাপ সময় যাচ্ছে। অনেকেই প্রভাব খাটিয়ে পুলিশকে প্রভাবিত করার চেষ্টাও করতে পারে। বিচিত্র কিছুই না। তাই আমরা কোনোভাবেই কারও কোনো তথ্যই আমলে নিচ্ছি না। নিহতের পরিবার যাকে আসামি করবে, সেটিই আপাতত চূড়ান্ত বলে ধরে নিচ্ছি। পরে তদন্তে যাদের নাম আসবে, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। তবে বিষয়টি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে জানা গেছে, মূলত বিলস্নাল অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে খুন হয়েছেন। মোটা অংকের টাকা লেনদেন নিয়ে নিজ দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল চলছিল অনেক বছর ধরে। এরই ধারাবাহিকতায় বিলস্নাল সাভার থেকে এসেছিলেন। মূলত বিলস্নাল তার সহযোগীদের নিয়ে তার প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করতে এসেছিলেন। এসে নিজেই খুন হয়ে গেছেন। বিলস্নালকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। ঘটনাস্থলেই বিলস্নাল মারা যায়। অন্তত ৬ ঘণ্টা লাশ ঘটনাস্থলেই পড়ে ছিল। এমন ঘটনার পর পুলিশকে প্রভাবিত করতে হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িতরা স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ছাড়াও ছাত্র-জনতাকে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে। যদিও সেই চেষ্টা সফল হয়নি। হত্যাকান্ডের মাস্টারমাইন্ডরা আড়ালে থাকতেই এমন কৌশল নিয়েছিল বলে জানা গেছে। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, পুলিশকে মাঠপর্যায়ে দেখা গেলেও তারা কোনো ধরনের অপারেশনাল কর্মকান্ড চালাচ্ছে না। কোনো জায়গায় ঝামেলা হলে সেনাবাহিনী বার্ যাবের পাশাপাশি পুলিশকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকতে দেখা গেছে। গত ৩১ আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসকদের অবহেলায় ছাত্র মৃতু্যর অভিযোগে রীতিমতো তান্ডব চলে হাসপাতালটিতে। এতে করে চিকিৎসা বন্ধ ছিল রোববার রাত ৮টা পর্যন্ত। ওই সময় সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্যদের হাসপাতালের বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান নিতে দেখা গেছে। তবে তাদের কোনো কার্যক্রম লক্ষ্য করা যায়নি। এমনকি অধিকাংশ পুলিশ সদস্যের হাতেই আগ্নেয়াস্ত্র ছিল না। শুধুমাত্র লাঠি হাতে তাদের সেখানে অবস্থান করতে দেখা গেছে। পুলিশের এমন নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নিয়ে চাঁদাবাজরা ছাত্র-জনতার নাম ভাঙিয়ে বিভিন্ন অফিস আদালত, দোকানপাট, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাস টার্মিনাল, টেম্পো, সিএনজি স্টেশনসহ বিভিন্ন জায়গায় গোপনে চাঁদাবাজি করছে বলে অভিযোগ ওঠেছে। ঢাকার যেসব থানায় পুলিশের সব নথিপত্র পুড়ে গেছে, এসব থানা এলাকার সন্ত্রাসীরা নতুন করে সক্রিয় হয়ে উঠছে। আবার পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নিয়ে নতুন নতুন ফর্মেটে অপরাধীরা সংঘটিত হচ্ছে। গড়ে তুলছে নানা ধরনের সন্ত্রাসী গ্রম্নপ। অপরাধী গ্রম্নপগুলো অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজিসহ নানা ধরনের অনৈতিক সুযোগ সুবিধা নিচ্ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, মাঠপর্যায়ে পুলিশের তেমন কোনো তৎপরতা না থাকার সুযোগে মাদক ব্যবসায়ীরা বড় বড় মাদকের চালান পারাপার করছে। এসব মাদক দেশের বিভিন্ন জায়গায় মজুত করা হচ্ছে। গত ২৭ আগস্টর্ যাব-১ ঢাকার উত্তরার আব্দুলস্নাহপুর থেকে গ্যাস সিলিন্ডারে করে আনা বিপুল ফেনসিডিলসহ দুইজনকে গ্রেপ্তার করে। গত ১ সেপ্টেম্বর পিকআপ ভ্যানে করে সবজির আড়ালে লুকিয়ে আনার সময় ৬৫১ বোতল ফেনসিডিল জব্দ করের্ যাব-১। গত ১৬ আগস্ট বিজিবি কক্সবাজারের টেকনাফ ও নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত থেকে ২১ কোটি টাকা মূল্যের ৪ কেজি ক্রিস্টাল মেথ আইস ও ৯০ হাজার পিস ইয়াবা জব্দ করে। প্রসঙ্গত, গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সারাদেশে পুলিশের স্থাপনায় ব্যাপক ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও পুলিশ সদস্য হতাহতের ঘটনা ঘটে। লুট হয়ে যায় পুলিশের বহু অস্ত্র ও গোলাবারুদ। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩ হাজার ৮৮০টি অস্ত্র, ২ লাখ ৮৬ হাজার ৩৫৩ রাউন্ড বুলেট, ২২ হাজার ২০১টি টিয়ার গ্যাস সেল এবং ২ হাজার ১৩৯টি সাউন্ড গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়েছে। দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে জানা গেছে, উদ্ধার হওয়া অস্ত্রের মধ্যে রাইফেলসহ বড় ধরনের অস্ত্রের সংখ্যাই বেশি। সহজেই বহনযোগ্য ছোট আগ্নেয়াস্ত্রের হার তুলনামূলক অনেক কম। বিশেষ করে পিস্তল উদ্ধারের পরিসংখ্যান একেবারেই যতসামান্য। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই আজ ৪ সেপ্টেম্বর থেকে অস্ত্র উদ্ধার অভিযান শুরু হচ্ছে। অভিযান কতটুকু সফল হবে, সেটি নিয়েও নানা অনিশ্চয়তা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের অভিমত। যদিও পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের সহকারী মহাপরিদর্শক ইনামুল হক সাগর যায়যায়দিনকে বলেন, সব বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে অভিযান চালানো হচ্ছে। আশা করা হচ্ছে, অভিযান সফল হবে। অভিযান সফল করার জন্য অনেক আগ থেকেই সারাদেশে গোয়েন্দা কার্যক্রম বাড়ানো হয়েছে। গোয়েন্দা তথ্য ছাড়াও নানা হিসাব-নিকাশ করেই অভিযান শুরু হচ্ছে।