শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১
ফেনীতে ছড়িয়ে পড়েছে ডায়রিয়া ঠাঁই মিলছে না হাসপাতালে

বন্যাকবলিত ১১ জেলায় মৃতু্য বেড়ে দাঁড়াল ৬৭ জনে

যাযাদি ডেস্ক
  ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
২৫০ শয্যার ফেনী জেনারেল হাসপাতালে জায়গা না পেয়ে খোলা চত্বরে এভাবেই সেবা নিচ্ছেন রোগীরা -সংগৃহীত

এবারের আকস্মিক বন্যায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ১১টি জেলায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৭ জনে। নতুন করে নিহতদের মধ্যে ফেনী ও কুমিলস্নায় তিনজন এবং নোয়াখালীতে দুজন মারা গেছেন। জেলাগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ২৬ জন মারা গেছেন ফেনীতে। এ ছাড়া কুমিলস্নায় ১৭ জন, চট্টগ্রামে ৬ জন, নোয়াখালীতে ১১ জন, কক্সবাজারে ৩ জন এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া, খাগড়াছড়ি, মৌলভীবাজার ও লক্ষ্ণীপুরে ১ জন করে মারা গেছেন। এর মধ্যে ৪২ জন পুরুষ, ৭ জন নারী ও ১৮ শিশু রয়েছে। সোমবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে।

তথ্য অনুযায়ী, বন্যাকবলিত এলাকার পানি ধীরে নামায় কয়েকটি জেলায় বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল আছে। তবে কয়েকটি জেলায় উন্নতি হয়েছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র থেকে মানুষ বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছেন। এদিকে পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে দুর্গত এলাকাগুলোতে দেখা দিয়েছে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত নানা রোগ। হাসপাতালগুলোতে রোগীর ভিড় বাড়ায় নানাভাবে হাসপাতালের বাইরে গাছের নিচে শুইয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে রোগীদের।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ফেনী, কুমিলস্না, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্ণীপুর ও কক্সবাজারসহ ১১টি জেলার ৬৮টি উপজেলায় ৬ লাখ ৫ হাজার ৭৬৭টি পরিবার এখনো আটকা পড়ে আছে। এ ছাড়া ১১টি জেলার ৫০৪টি পৌরসভা বা ইউনিয়নে আক্রান্ত হয়েছেন ৫১ লাখ ৮ হাজার ২০২ জন।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, হবিগঞ্জ, সিলেট, কক্সবাজার ও খাগড়াছড়ি জেলার বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রয়েছে। মৌলভীবাজারে এর উন্নতি হয়েছে এবং কুমিলস্না, ফেনী, নোয়াখালী ও লক্ষ্ণীপুর জেলার অবস্থাও উন্নতির দিকে।

এরই মধ্যে ৩ হাজার ৬১৫টি আশ্রয় কেন্দ্রে ৩ লাখ ৬ হাজার ৭৪১ জন এবং ৩২ হাজার ৮৩০টি গৃহপালিত পশু রাখা হয়েছে। বন্যাকবলিত এলাকায় মোট ৪৭২টি মেডিকেল টিম চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে।

বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে এ পর্যন্ত ৪ কোটি ৫২ লাখ টাকা বরাদ্দ, ২০ হাজার ৬৫০ টন চাল, ১৫ হাজার পিস শুকনো খাবার বা অন্যান্য খাবার এবং শিশুখাদ্য ও গো-খাদ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ৩৫ লাখ টাকা করে। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছেন আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থানরত মানুষ।

ফেনীতে ডায়রিয়া : ঠাঁই মিলছে না হাসপাতালে

পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে বন্যাকবলিত বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত নানা রোগ। জেলাগুলোর মধ্যে ডায়রিয়ার ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে ফেনীতে। ২৫০ শয্যার ফেনী জেনারেল হাসপাতালে শয্যা সংকুলান না হওয়ায় মেঝেতে, বারান্দায় ও বাগানের গাছতলায় রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে চিকিৎসা পাওয়ার আশায় দিনাতিপাত করছেন বন্যাদুর্গতরা। আক্রান্তদের বেশিরভাগ শিশু।

হাসপাতালের ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ভর্তি রয়েছেন শয্যা সংখ্যার নয় গুণের বেশি রোগী। রোগীরা বলছেন, কাঙ্ক্ষিত সেবা পাচ্ছেন না তারা। অন্যদিকে চিকিৎসকরা বলছেন, স্বল্প জনবলে তারা কুলিয়ে উঠতে না পেরে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসাসেবা দিতে।

হাসপাতালের ১৮ শয্যার ডায়রিয়া ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিতে ভর্তি হয়েছেন ১৭৬ জন রোগী। যেখানে চিকিৎসা নিচ্ছে নবজাতক থেকে শুরু করে ৩০ বছরের মধ্যকার রোগীরা। রোগী, সঙ্গে স্বজনরা সব মিলিয়ে বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে হাসপাতালে। রোগীরা বলছেন, সারা দিনে একবার ডাক্তারের দেখা পেলেও হাসপাতাল থেকে দেওয়া হচ্ছে না ওষুধপত্র।

জেলার বন্যাকবলিত এলাকা ফুলগাজী থেকে এক বছর বয়সি মেয়েকে নিয়ে এসেছেন সালমা বেগম। তিনি বলেন, 'বাধ্য হয়ে বন্যার পানি খেতে হয়েছে। এর পর শরীরে দেখা দিয়েছে নানা ধরনের সমস্যা। বাচ্চাটার কয়েকদিন থেকেই ডায়রিয়া। উপজেলার ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করিয়ে না সারায় আসতে হয়েছে জেলার এ হাসপাতালে। এখানে এসে দেখা দিয়েছে অন্য বিপত্তি। হাসপাতালে জায়গা নেই। বাধ্য হয়ে বাইরে শুয়ে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।'

এদিকে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এখনো চালু করা সম্ভব হয়নি ডায়ালাইসিস, আল্ট্রাসনোগ্রাফি সেবা। ঢাকা থেকে টেকনিশিয়ান আসবে আসবে বলেও আসছে না। হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরে নেই মেডিসিন, চর্ম-যৌন, সার্জারি, অর্থোপেডিক্স ও সার্জারি, রেডিওলজিস্ট চিকিৎসক। জনবল সংকট থাকায় সেবা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক ও নার্সরা।

সোমবার দুপুরে সরেজমিনে দেখা গেছে, ডায়রিয়া রোগী হাসপাতালের সামনের চত্বরে গাছতলায় পাটি বা চাটাই বিছিয়ে থাকছেন। গাছের সঙ্গে স্যালাইন টানিয়ে তা রোগীর শরীরে দেওয়া হচ্ছে। সেখানে কথা হয় ফেনী সদরের আলকরা এলাকার লায়লা বেগমের সঙ্গে। তিনি আজ সকালে আট মাসের শিশু মো. আজহারুলকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। লায়লা বলেন, তিন দিন ধরে ছেলেটা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। সোমবার এখানে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু শয্যা পায়নি। তাই গাছতলায় থেকে চিকিৎসা নিতে হচ্ছে।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, ফেনীর ছয় উপজেলা থেকে ডায়রিয়ার রোগী হাসপাতালে আসছে। মূলত ২৫ আগস্ট থেকে ডায়রিয়া রোগী আসা শুরু হয়েছে। তবে গত দুই দিনে তা মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।

ফেনীর পাঠানবাড়ি থেকে শিশু সাইফুল ইসলামকে নিয়ে চার দিন আগে হাসপাতালে আসেন মা শাহানা বেগম। শয্যা না পাওয়ায় তাকেও খোলা চত্বরে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।

দিনের বেলায় গাছের নিচে থাকলেও রাতে বারান্দায় চলে বলে জানালেন রোগীর স্বজন ও নার্সরা। ডায়রিয়া ওয়ার্ডে কর্তব্যরত নার্স সবিতা রানী জানান, তাদের ওয়ার্ড ১৮ শয্যার। কিন্তু রোগী ১৪০ জন। বাধ্য হয়ে বাইরে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। আর লোকবল সংকটের কারণে সেবাও বিঘ্ন ঘটছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।

এত রোগী সামাল দেওয়ার চিকিৎসক-নার্সের অভাব ও প্রয়োজনীয় ওষুধের সংকট আছে বলে জানান তত্ত্বাবধায়ক আবুল খায়ের মিয়াজী। তিনি বলেন, 'তিন মাস ধরে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ কেউ নেই। এ ছাড়া মেডিকেল অফিসারও পর্যাপ্ত নয়। নার্সের সংকট আছে। ওষুধের সংকটও রয়েছে। কারণ হাসপাতালটি বন্যায় ডুবে গিয়ে কিছু ওষুধ নষ্ট হয়েছে। এ কারণে রোগীদের কিছু ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে