বগুড়ার সারিয়াকান্দির চালুয়াবাড়ি ইউনিয়নের হাটবাড়ির যমুনার ধু-ধু বালুর চর। এখানে ইট-সিমেন্ট ও লাল-সবুজ রঙের টিনের তৈরি ৬৯টি ঘর সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে। এসব ঘরে ১৫টি পরিবারের বসবাস হলেও সদস্যরা আছেন রাখালের ভূমিকায়। ঘরগুলোর অধিকাংশই বিভিন্ন সামগ্রী রেখে তালা দিয়ে রাখা। বাকিগুলোতে ঠাঁই হয়েছে ৫ শতাধিক গবাদিপশুর। ঘরগুলো দেখে মনে হয়, গবাদিপশুর খামারের জন্যই এসব নির্মিত হয়েছে। ঘরগুলো সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে 'মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহার' স্স্নোগানে আশ্রয়ণ প্রকল্প-১ ও ৪-এর আওতায় নির্মাণ করা হয়েছে।
সারিয়াকান্দি অথবা সোনাতলার যমুনার ঘাট থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকাযোগে এ চরে পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় দুই ঘণ্টা। এই চরে সরকারের কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে ঘরগুলো নির্মাণের মূল সহযোগী বগুড়া-১ আসনের সাবেক সংসদ শাহাদারা মান্নান শিল্পী।
স্থানীয়দের অভিযোগ, তিনি জেনে বুঝেই প্রভাব খাটিয়ে সরকারের কাছ থেকে এমন একটি অকার্যকর প্রকল্প পাস করিয়ে নিয়েছিলেন। এসব ঘরে মাদকের চোরাচালান ও অবৈধ নানা সামগ্রী মজুত করা হতো। পরে সুযোগ বুঝে ঢাকাসহ
বিভিন্ন জেলায় তা সরবরাহ করা হতো বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়।
জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে এই চরে ৪টি ঘর নির্মাণের একটি প্রকল্প তৈরি করা হয়েছিল। তবে সেই প্রকল্পের নথি এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। ওই সময় মাটি কাটার জন্য কোটি টাকার বিশেষ বরাদ্দ আনা হয়। কিন্তু দরিদ্র ও অসহায় মানুষদের মাধ্যমে মাটি না কাটিয়ে ড্রেজার দিয়ে মাটি কাটা হয়। অভিযোগ আছে, প্রকল্পের আওতায় মাত্র কয়েক লাখ টাকার মাটি কেটে আত্মসাৎ করা হয় কোটি টাকা।
পরবর্তীতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এখানে ৬৫টি ঘর নির্মাণ করা হয়। ঘরগুলোর কাজ একেবারেই নিম্নমানের ইট, বালু, রড, টিন, কাঠসহ বিভিন্ন সামগ্রী দিয়ে তৈরি হলেও, ধু-ধু যমুনা চরে হওয়ার নির্মাণ কাজে বাঁধা দেওয়ার কোনো সুযোগ কারোরই ছিল না। অন্যদিকে সরকার দলীয় এমপি ও তার ঘনিষ্ঠদের ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পায়নি।
এই চরে গরু লালন-পালন করলে কোনো বাড়তি খাবার দিতে হয় না। সারাদিন যমুনা চরে ঘাস খেয়ে সন্ধ্যায় আপনা-আপনি ঘরে ফেরে গরুগুলো। এগুলো দেখভালের জন্য বেশকিছু রাখাল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মোটা অংকের বেতনও দেওয়া হয় তাদের।
আলামিন নামের এক ঘরের মালিক বলেন, আমি একটা ঘর নিয়েছি ৩০ হাজার টাকা দিয়ে। তবে সেখানে থাকি না। ঘরে ৯টা গরু রাখি। এছাড়া ফসলের সময় এই ঘরটা কাজে লাগে। তিনি আরও বলেন, 'একেকজনের ৩০-৫০টি পর্যন্ত গরু আছে। যেমন মাফু, কান্টু, নাজের, মোয়াজ্জেম- এদের ৪০টির বেশি আছে। এতদিন ৭০০-৮০০ গরু ছিল, কিন্তু কোরবানির ঈদে বিক্রি হয়ে গেছে। এখনো প্রায় ৫০০ গরু আছে।
আলামিন জানান, আমাদের চেয়ারম্যান গরু কিনে দেয়। কোরবানির ঈদের সময় বিক্রি করে টাকা যা হয় তা ভাগ করে নেন।
জাহানারা নামের একজন বৃদ্ধা বলেন, 'এখানে কারোই ১০টির নিচে গরু নেই। গরু পালনের জন্যই এই জায়গায় ঘর করা হইছে।'
আপনারাই দেখেনতো এই রোদের মধ্যে কয় মিনিট টিকে থাকা যায়। এখানে মানুষ কীভাবে থাকবে। সেজন্যই আমরা কয়েকজন খুব কষ্ট করে আছি গরু পালনের জন্য।
জানা গেছে, ২০২১ সালে নির্মিত প্রতিটি ঘরের জন্য বরাদ্দ ছিল এক লাখ একাত্তর হাজার টাকা এবং ২০২৪ সালে নির্মিত প্রতিটির বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। তাতে ৬৯টি ঘর নির্মাণে মোট খরচ ছিল ১ কোটি ৯৪ লাখ ৬৯ হাজার টাকা।
এ বিষয়ে চালুয়াবাড়ি ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম বাদশা বলেন, 'আমি নৌকা প্রতীকে বিজয়ী হলেও আমাকে রাখা হয়েছিল জিম্মি করে। কারণ এমপির মনোনীত চেয়ারম্যান ছিলাম না। আমি ভোট করেই চেয়ারম্যান হয়েছি। আমার নামে যত বরাদ্দ আসত, তা সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক এমপি বণ্টন করত। এখন অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে যদি চেয়ারম্যান থাকি তাহলে এলাকার মানুষের জন্য কিছু করতে পারব।'
এ বিষয়ে সারিয়াকান্দির ইউএনও তৌহিদুর রহমান বলেন, 'আপনার কাছে জানার পরে আমরা যাচাই-বাছাই শুরু করেছি এবং একজন নায়েবকে নির্দেশ দেওয়া আছে। আমরা এগুলোর সত্যতা পাচ্ছি। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে সেগুলো যাচাই করে, বাতিল করে নতুন করে বন্দোবস্ত দেব। অর্থাৎ একটা একটা করে রিপেস্নস করব।'
এ ব্যাপারে সদ্যবিদায়ী জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, 'আপনার কাছে জানার পর আমি সারিয়াকান্দি ইউএনওর মাধ্যমে যা জেনেছি, তাতে বেশ সমস্যা রয়েছে। তবে দ্রম্নতই এসব সমস্যা সমাধান করা হবে।'
জনমানবহীন যমুনার চরে কেন এসব ঘর তৈরি করা হয়েছে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, '১ নম্বর খতিয়ানের কোনো জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল না, এ কারণে হয়তো ওই জায়গায় ঘর নির্মাণ করা হয়েছিল।'
তবে এ বিষয়ে অভিযুক্ত সাবেক এমপি সাহাদারা মান্নান শিল্পী ও সাবেক চেয়ারম্যান সওকত হোসেন আত্মগোপনে থাকায় তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।