মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

বন্যাকবলিত এলাকায় মৃতু্য বেড়ে ৫৯ জন

ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করা হবে : ত্রাণ উপদেষ্টা
যাযাদি ডেস্ক
  ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হলেও এখনো পানিবন্দি রয়েছে প্রায় ৭ লাখ পরিবার। ছবিটি শুক্রবার লক্ষ্ণীপুর সদর উপজেলার লাহারকান্দি ইউনিয়ন থেকে তোলা -ফোকাস বাংলা

ভয়াবহ আকস্মিক বন্যায় দেশের ১১ জেলায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫৯ জনে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। পাঁচ জেলায় বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও ফেনীসহ চার জেলায় উন্নতি হয়েছে উলেস্নখ করে মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, বন্যাকবলিত জেলাগুলোর ৬ লাখ ৯৬ হাজার ৯৯৫টি পরিবার এখনো পানিবন্দি রয়েছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ জানিয়েছে, বন্যাকবলিত এলাকায় প্রায় ৯৯ শতাংশ মোবাইল নেটওয়ার্ক ইতোমধ্যে সচল হয়েছে। বন্যার কারণে গত ৯ দিন ধরে কুমিলস্নার বুড়িচং উপজেলার শতাধিক পরিবারের আশ্রয় হয়েছে খোলা আকাশের নিচে। বুড়বুড়িয়া-গোমতীর সড়ক বাঁধে আশ্রয় নেওয়া এসব মানুষের চোখে-মুখে আতঙ্ক। এছাড়া বন্যাকবলিত জনপদে সুপেয় পানি সংকটের কারণে পানিবাহিত রোগের মহামারির ঝুঁকিতেও কাটছে বন্যার্ত মানুষের দিন।

এদিকে, শনিবার বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন শেষে অন্তর্বর্তী সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম (বীর প্রতীক) বলেছেন, আপাতত বন্যার্ত মানুষকে বাঁচানোই প্রধান কাজ। পরে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করা হবে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের 'চলমান বন্যার সার্বিক পরিস্থিতি' নিয়ে শনিবার প্রকাশিত তথ্য বিবরণীতে বলা হয়েছে, এখনো দেশের বন্যা আক্রান্ত জেলা ১১টি। সেগুলো হলো ফেনী, কুমিলস্না, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্ণীপুর এবং কক্সবাজার। আর চট্টগ্রাম, হবিগঞ্জ সিলেট, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজার জেলার বন্যা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক রয়েছে। আর মৌলভীবাজার ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে এবং কুমিলস্না, ফেনী, নোয়াখালী ও লক্ষ্ণীপুর জেলার বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হচ্ছে।

এখনো দেশের ৬৮টি উপজেলা বন্যা পস্নাবিত রয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়ন বা পৌরসভা রয়েছে ৫০৪টি বলেও জানিয়েছে মন্ত্রণালয়। বর্তমানে পানিবন্দি ৬ লাখ ৯৬ হাজার ৯৯৫টি পরিবার পানিবন্দি উলেস্নখ করে মন্ত্রণালয়ের বিবরণীতে বলা হয়েছে, বর্তমানে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকসংখ্যা ৫৪ লাখ ৫৭ হাজার ৭০২ জন।

বন্যায় ৫৯ জনের মৃতু্যর তথ্য জানানো হয়েছে। তাদের মধ্যে পুরুষ ৪১ জন, নারী ছয়জন এবং শিশু ১২ জন। এদের মধ্যে কুমিলস্নায় মারা গেছেন ১৪ জন, ফেনীতে ২৩ জন, চট্টগ্রামে ছয়জন,

খাগড়াছড়িতে একজন, নোয়াখালীতে ৯ জন, ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় একজন, লক্ষ্ণীপুরে একজন ও কক্সবাজারে তিনজন এবং মৌলভীবাজারে একজন। এছাড়া এই সময়ে মৌলভীবাজারে একজন নিখোঁজ রয়েছেন বলেও জানানো হয়েছে।

বন্যায় পানিবন্দি বা ক্ষতিগ্রস্তদের আশ্রয়ের জন্য মোট ৩ হাজার ৯২৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মোট ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৩০৫ জন লোক এবং ৩৬ হাজার ১৩৯টি গবাদিপশুকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে বলেও বিবরণীতে জানানো হয়।

বিবরণীতে বলা হয়, ১১টি জেলার ক্ষতিগ্রস্তদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের জন্য মোট ৫১৯টি মেডিকেল টিম চালু রয়েছে।

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিতরণের জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে ৪ কোটি ৫২ লাখ নগদ টাকা এবং ২০ হাজার ৬৫০ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছে মন্ত্রণালয়। এ ছাড়া ৩৫ লাখ টাকা শিশু খাদ্যের জন্য এবং ৩৫ লাখ টাকা গো-খাদ্যের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলেও উলেস্নখ করা হয়।

কুমিলস্নার বন্যার্তদের চোখেমুখে আতঙ্ক

গোমতী নদীর পারে কুমিলস্নার বুড়িচং উপজেলার বুড়বুড়িয়া এলাকায় সড়কবাঁধে আশ্রয় নিয়েছে শতাধিক পরিবার। বন্যার কারণে গত ৯ দিন ধরে ত্রিপল টানিয়ে তার নিচেই চলছে তাদের ঘুম-খাওয়া। কেউ কেউ পাশে গরু-ছাগল বেঁধে রেখেছেন। বাঁধের ওপর দু-একজন নারীকে মাটির চুলা বানিয়ে রান্না করতেও দেখা যায়।

বুড়বুড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা আবদুল হালিমের পরিবার বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে। তিনি পেশায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চালক। সেই রাতের কথা মনে করে আঁতকে ওঠেন আবদুল হালিম। তিনি জানান, যখন গোমতীর পানি বেড়েছিল, তখন থেকে ভয়ে অটোরিকশা চালানো বন্ধ করে গোমতীর পাড়ে অবস্থান নেন। বৃহস্পতিবার রাতে যখন গোমতীর পানি বাঁধ ছুঁইছুঁই করে, সেদিন তিনি পরিবারসহ এই বাঁধে অবস্থান নেন।

যখন মাইকে শুনেছেন, নদীর বাঁধ ভেঙে গেছে, তখন আবদুল হালিম দৌড়ে বাড়ি যান। তিনি বলেন, 'গাঙ ভাঙছে হুইন্না দৌড় দিয়া ঝি-পুত আর বউয়েরে লইয়া গাঙের পার আইছি। এই ৯ দিন আমরা গাঙের পার আছি। বাইত এহন ফেককাদা। আরও এক সাপ্তাহ লাগবো বাইত যাইতে।'

বাঁধে আশ্রয় নেওয়া রফিকুল ইসলাম বলেন, 'আমার চোহে হেই রাইতের কথা ভাইস্যা ওডে। গাঙডা যখন ভাইঙা যায়, হেই সময় পানির কী ডাক আইছিলো! মনে হইছে দুনিয়াডা ডুবাইয়া লাইবো।'

বাড়ির মায়ায় শনিবার সকালে বাড়ি গিয়েছিলেন মো. সেলিম। গিয়ে দেখেন, তার ঘরে এখনো কোমরপানি। তিনি বলেন, 'হেই রাতে পিন্দনে যা আছিলো, তা লইয়া কোনো রহম জানডা বাঁচাইছি। আইজ বাইত গেছিলাম। বাইত যাইয়া দেহি, আমার ঘরের ভিত্রে কোমরপানি। আর কয় দিন লাগে পানি কমতে, আলস্নাই জানেন।'

৯৯ শতাংশ মোবাইল নেটওয়ার্ক সচল

বন্যার পানির পরিমাণ কমে যাওয়ায় ফের সচল হতে শুরু করেছে অচল মোবাইল টাওয়ার। বর্তমানে কবলিত এলাকার প্রায় ৯৯ শতাংশ টাওয়ারই সচল করা সম্ভব হয়েছে।

শনিবার বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) অস্থায়ী পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে এসব তথ্য জানানো হয়েছে। সংস্থাটির হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, এখন বন্যাকবলিত ১১টি জেলায় ২৫৪টি টাওয়ার সাইট অচল হয়ে আছে। যার শতকরা পরিমাণ ১ দশমিক ৭ শতাংশ। এর মধ্যে নোয়াখালী জেলায় ৪৩টি, লক্ষ্ণীপুর জেলায় ১১টি, ফেনী জেলায় ৭২টি, কুমিলস্না জেলায় ৯টি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় ২৪টি, চট্টগ্রাম জেলায় ১৮টি, খাগড়াছড়ি জেলায় ১৪টি, হবিগঞ্জ জেলায় ১৫টি, মৌলভীবাজার জেলায় ৮টি, সিলেট জেলায় ৩২টি ও কক্সবাজার জেলায় ৮টি মোট ২৫৪টি টাওয়ার অচল হয়ে আছে। এর বিপরীতে এই ১১টি জেলার মোট টাওয়ার রয়েছে ১৪ হাজার ৫৫১টি। যার মধ্যে এখন সচল রয়েছে ১৪ হাজার ২৯৭টি। অর্থাৎ অচল টাওয়ারের পরিমাণ ১ দশমিক ৭ শতাংশ।

ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করা হবে : ত্রাণ উপদেষ্টা

হাটহাজারী (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি জানান, শনিবার দুপুরে বন্যায় ভেঙে যাওয়া নাজিরহাট নতুন ব্রিজ সংলগ্ন বাঁধ পরিদর্শনে এসে অন্তর্বর্তী সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম (বীর প্রতীক) বলেছেন, এই মুহূর্তে বন্যার্তদের বাঁচানোটাই প্রধান কাজ। ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলে তিনি জানান, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন করা হবে।

এ সময় উপদেষ্টার সঙ্গে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তয়ন কুমার ত্রিপুরা, হাটহাজারীর ইউএসও এবিএম মশিউজ্জামান, সহকারী কমিশনার (ভূমি) মেহরাজ শারবীন, জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা সাইফুলস্নাহ মজুমদার, কৃষি কর্মকর্তা আল মামুন শিকদার, প্রকৌশলী জয়শ্রী দে, পিআইও নিয়াজ মোর্শেদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

পানিবাহিত রোগের মহামারির ঝুঁকি

বন্যাকবলিত এলাকায় দেখা দিয়েছে সুপেয় পানির সংকট। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বন্যার পানি নামলেও ঝুঁকি এখনো কমেনি। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা আন্তর্জাতিক একটি সংবাদমাধ্যমকে সতর্কতা দিয়ে বলেছেন, বন্যাকবলিত অঞ্চলগুলোতে পানিবাহিত রোগের মহামারি দেখা দিতে পারে। এখনই সুপেয় পানির ব্যবস্থা না করা হলে পানিবাহিত রোগ খুব দ্রম্নত ছড়িয়ে পড়তে পারে।

শনিবার সংবাদমাধ্যমকে স্বাস্থ্যসেবার মহাপরিচালক জানিয়েছেন, গত ২৪ ঘণ্টায় বন্যাকবলিত অঞ্চলগুলোতে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে অন্তত ৩ হাজার মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এখনো অনেক জায়গা পানির নিচে থাকায় সেখানকার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা নিতেও আসতে পারছেন না।

লক্ষ্ণীপুরে বন্যায় প্রাণিসম্পদের

ক্ষতি ৮ কোটি ৬৫ লাখ টাকা

লক্ষ্ণীপুর জেলার প্রাণিসম্পদ বিভাগের দেওয়া ক্ষয়ক্ষতির প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, ভয়াবহ বন্যায় অবকাঠামো ও খাদ্য বিনষ্টসহ খামারি-গৃহস্থদের পশুপাখি মারা গিয়ে ৮ কোটি ৬৫ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকার ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া এখনো ৫ লাখ ১১ হাজার ১১০টি পশু-পাখি বন্যাকবলিত আছে। এতে খামারিসহ গৃহস্থরা বড় ধরনের আর্থিক বিপর্যয়ে পড়েছেন।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে, বন্যার অতিরিক্ত পানির কারণে লক্ষ্ণীপুর জেলার বিভিন্ন স্থানে খামার ও গৃহস্থদের ১ লাখ ৬০ হাজার ২১৩টি পশুপাখি মারা গেছে। এর মধ্যে ৩৫টি গরু, ১৭৫টি ছাগল, ১৭টি ভেড়া ও একটি মহিষ এবং ১ লাখ ৫৯ হাজার ১০টি মুরগি ও ৯৭৫টি হাঁস মারা গেছে। এতে ২ কোটি ৮৬ লাখ ৩ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে। গবাদিপশুসহ ৩০৩টি খামারের অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে ৭৩ লাখ ১৫ হাজার টাকার এবং হাঁস-মুরগিসহ ৪২৩টি খামারের অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে ৩ কোটি ৪৮ লাখ ৮৩ হাজার টাকা। এছাড়া ১ কোটি ৫৭ লাখ ১১ হাজার ৫০০ টাকার পশুপাখির খাদ্য বন্যায় বিনষ্ট হয়েছে।

জেলা প্রাণিসম্পদ কার্যালয় থেকে আরও জানানো হয়, ৯০০ গবাদিপশু ও ১২ হাজার ৯০০ হাঁস-মুরগিকে টিকা দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে ৮৪১টি গবাদিপশু ও ৩০ হাজার ৩৬৫টি হাঁস-মুরগিকে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে