সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতিসহ বন্যপ্রাণী ও মাছের প্রজনন নিশ্চিত করতে জেলে-বনজীবীসহ দেশি-বিদেশি পর্যটকদের তিন মাসের প্রবেশ নিষেধাজ্ঞা ছিল। সেটি শেষ হচ্ছে আজ শনিবার। বন বিভাগের কাছ থেকে বৈধ পাস-পারমিট নিয়ে আগামীকাল রোববার থেকে সুন্দরবনে যেতে পারবেন জেলে-বনজীবীসহ পর্যটকরা।
সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী ও মৎস্যসম্পদ রক্ষায় ইন্টিগ্রেটেড রিসোর্সেস ম্যানেজমেন্ট পস্ন্যানসের (আইআরএমপি) সুপারিশ অনুযায়ী ২০১৯ সাল থেকে প্রতি বছরের ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত এই তিন মাস বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থান (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইড) ম্যানগ্রোভ এই বনে প্রবেশ নিষেধাজ্ঞা জারি করে থাকে বন বিভাগ।
সুন্দরবনসংলগ্ন মোংলা উপজেলার চিলার জয়মনি গ্রামের জেলে লিয়াকত আকন, দিলিপ বর্মন, সেলিম আকন ও আব্দুর রহমান বলেন, 'আমরা ৩০-৪০ বছর ধরে বংশপরম্পরায় সুন্দরবনে মাছসহ বনজ সম্পদ আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছি। সুন্দরবনে এই তিন মাসের নিষেধাজ্ঞার সময়ে আমাদের অনেক কষ্ট করে পরিবারসহ জীবিকা নির্বাহ করতে হয়েছে। খুশির খবর হচ্ছে রোববার থেকে আবারও আমরা পাস-পারমিট নিয়ে সুন্দরবনে মাছ আহরণ করতে যাব। আমরা সুন্দরবন থেকে মাছ আহরণ করে বেঁচে থাকতে পারব।'
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক (সিএফ) মিহির কুমার দো বলেন, 'জুন, জুলাই ও আগস্ট মাস হচ্ছে মৎস্য প্রজননের জন্য উপযুক্ত মৌসুম। এই সময় সাধারণত সব মাছ ডিম ছাড়ে। তাই ২০১৯ সাল থেকে সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী ও মৎস্যসম্পদ রক্ষায় ইন্টিগ্রেটেড রিসোর্সেস ম্যানেজমেন্ট পস্ন্যানসের (আইআরএমপি) সুপারিশ অনুযায়ী প্রতি বছর ১ জুলাই থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত তিন মাস সব প্রকার মৎস্য আহরণ বন্ধ থাকে।'
তিনি আরও বলেন, 'এ ছাড়া এই সময়টিতে সুন্দরবনের বন্যপ্রাণীদেরও প্রজনন মৌসুম। সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতি ঘুরে দাঁড়াতে জেলে বনজীবীসহ দেশ-বিদেশের সব পর্যটকদের প্রবেশ বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী স্থানসহ (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইড) ২৫ ফুটের কম প্রশস্ত সব খালে সারা বছর মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকে। সারা বছর ২৫ ফুট প্রশস্তের ঊর্ধ্বের নদী-খালে উপকূলীয় এলাকার হাজার হাজার জেলে-বনজীবীরা বন বিভাগের কাছ থেকে পাস-পারমিট নিয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করে। এই তিন মাস ছাড়া সারা বছরই দেশি-বিদেশি পর্যটকরা (ইকো টু্যরিস্ট) সুন্দরবন ভ্রমণ করে থাকেন। নিষেধাজ্ঞা শেষে ১ সেপ্টেম্বর থেকে বৈধ পাস-পারমিট নিয়ে জেলে-বনজীবীসহ দেশি-বিদেশি পর্যটকরা আবারও সুন্দরবনে যেতে পারবেন।'
পূর্ব সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন ও পর্যটনকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাওলাদার আজাদ কবির বলেন, 'মাছ, বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদের প্রজননের জন্য জুন, জুলাই ও আগস্ট এই তিন মাস সুন্দরবনে জেলে ও পর্যটকদের প্রবেশ বন্ধ রাখা হয়। এ সময় বনের বিভিন্ন প্রান্তে ময়লা-আবর্জনা জমেছে। সেগুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে সুন্দরবনকে নতুনভাবে সাজানো হয়েছে। এর মধ্যে ছবি কর্নার, উঁচু ওয়াচ টাওয়ার, ঝুলন্ত ব্রিজসহ নানা স্থাপনা নতুনভাবে সংস্কার করে সাজানো হয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'পর্যটকরা আগামীকাল থেকে সুন্দরবনে আসলে যেন ভ্রমণ ও বিনোদন সুন্দরভাবে উপভোগ করতে পারে তার সব রকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।' তবে বন এবং পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কাজ থেকে বিরত থাকতে বলেন এই বন কর্মকর্তা।
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে পুরো সুন্দরবন ডুবেছিল ৩৮ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে। এত দীর্ঘ সময় জোয়ারের পানি থাকায় বন্যপ্রাণীদের ব্যাপক ক্ষতি ও প্রাণহানি ঘটেছে। মারা যায় ৪০টি হরিণ এবং ১টি বন্য শূকর। সাগরের নোনাপানি ঢুকে তলিয়ে যায় বন্যপ্রাণীর জন্য তৈরি করা মিঠাপানির পুকুরসহ শতাধিক জলাশয়। সে সময় জীবিত উদ্ধারের পর ১৭টি হরিণকে অবমুক্ত করা হয়।
সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগের (খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলা) বিভাগীয় বন কর্মকর্তারা জানান, এই এলাকায় জলোচ্ছ্বাসে ১৪টি পুকুরের পাড় ভেঙে গেছে। ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ গোলপাতার বাগান পস্নাবিত হয়ে গেছে। ১৮টি জেটি, ২৬৩০ ফুট রাস্তা ও বাঁধ, ৯টি সড়ক ও বনরক্ষীদের ৩টি ব্যারাক মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দুটি ওয়াচ টাওয়ার। একটি পন্টুন ভেসে গেছে। এতে ২ কোটি ৬১ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো গণমাধ্যমকে বলেন, 'প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী সুন্দরবনে বন বিভাগের ৬ কোটি ২৭ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।'