মিয়ানমারের রাখাইনের মংডুতে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে দেশটির সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির মধ্যে চলমান যুদ্ধের তীব্রতা আরও বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে বিমান হামলার পরিমাণও। এতে একদিনে রাখাইনে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, অন্যদিকে সীমান্তের এপারে বাংলাদেশে সীমান্তবর্তী বসবাসকারী মানুষের মধ্যেও বাড়ছে আতঙ্ক।
বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার ভোর পর্যন্ত রাখাইনের মংডুতে তুমুল সংঘর্ষে কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তজুড়ে বারবার কেঁপে ওঠে। এমন পরিস্থিতিতে সেখানকার (মংডুতে) রোহিঙ্গারা টিকতে না পেরে প্রাণে বাঁচতে এদিক-সেদিক যাওয়ার চেষ্টা করেছে। আবার অনেকে সীমান্ত দিয়ে এপারে প্রবেশের অপেক্ষা করছে। তবে রোহিঙ্গারা যাতে নতুন করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে পারে, সে জন্য সীমান্ত-নাফনদে বিজিবি-কোস্ট গার্ড সতর্ক অবস্থায় রয়েছে।
এ বিষয়ে টেকনাফ-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত কাছাকাছি হওয়ার কারণে বড় বিকট শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। সেদেশে চলমান যুদ্ধের কারণে সীমান্তে বিকট শব্দ ভেসে আসছে। তবে সীমান্ত অনুপ্রবেশ ঠেকানোর পাশাপাশি যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিজিবি সদস্যরা প্রস্তুত রয়েছেন।
এদিকে খারাংখালী, টেকনাফ, পৌরসভা, হ্নীলা, জাদিমুড়া, দমদমিয়া, নাইট্যংপাড়া, পৌরসভার জালিয়াপাড়া, নাজিরপাড়া, সাবরাং, শাহপরীর দ্বীপ, নাফ নদীর মোহনা ও নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত থেকে ভেসে আসছে বিস্ফোরণের বড় বড় শব্দ। সীমান্তের লোকজন বলছে, দীর্ঘদিন বন্ধের পর এই প্রথম কোনো বড় ধরনের মর্টার শেল বিস্ফোরণের বিকট শব্দে কাঁপছে টেকনাফ।
টেকনাফ সীমান্তের বাসিন্দা মুহাম্মদ জাকির বলেন, 'মিয়ানমারের যুদ্ধ বিমানের হামলার কারণে রাত থেকে ভোর পর্যন্ত ঘুমাতে পারিনি। ভয়ে রাতে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি। মনে হয়েছে এপারে বিমান হামলা হচ্ছে। কারণ এমন বিকট শব্দ আগে কখনো শুনিনি।'
হ্নীলা ওয়াব্রাং এলাকার সীমান্ত বাসিন্দা কামাল জানান, মিয়ানমারের অভ্যন্তর থেকে ১০-১৫ মিনিট পরপর মর্টার শেল বিস্ফোরণের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। যার কারণে তারা আতঙ্কিত হয়ে রাত জেগেছিলেন। এতদিন বন্ধ থাকলেও বুধবার রাতে নতুন করে বেশি বিস্ফোরণ হয়েছে। রাত ১২টার পর থেকে বজ্রপাতের মতো বিকট শব্দ আর কালো ধোঁয়া দেখা গেছে।
গত মঙ্গলবার অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রম্নপের (আইসিজি) এক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে রয়টার্স বলছে, ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তাকে পরাজিত করে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মধ্য ও উত্তরাঞ্চলের বেশিরভাগ এলাকা দখলে নিয়েছে সশস্ত্র সংগঠন আরাকান আর্মি। এই সংগঠনের নেতৃত্বে খুব শিগগির আরাকান রাজ্য সার্বভৌমত্ব অর্জন করতে পারে। এ বছরের প্রায় পুরো সময়জুড়ে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নিরবচ্ছিন্ন হামলার মুখে পাল্টা জবাব দিতে হিমশিম খেয়েছে সামরিক সরকার (জান্তা)। নিরুপায় হয়ে একপর্যায়ে তারা রোহিঙ্গা মুসলিমদের যোদ্ধা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হয়নি। আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করলে একটি উদীয়মান আধা-রাষ্ট্র (পুরোপুরি সার্বভৌম নয় এমন) সৃষ্টি হবে এবং এ রাজ্যের বাসিন্দারা মানবিক সংকটে পড়বে।
মিয়ানমার ও দেশের সীমান্ত এলাকার স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি সময় দেশটির সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি রাখাইনের মংডু শহর নিয়ন্ত্রণে নিতে সামরিক বাহিনীর ওপর হামলা চালিয়ে শক্ত অবস্থা নেয়। দেশটির সামরিক বাহিনীও শহরটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আরাকান আর্মিকে লক্ষ্য করে আকাশপথসহ ত্রিমুখী হামলা চালায়। এই গৃহযুদ্ধ রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের সুদাপাড়া, হাদিবিল, নুরুলস্না পাড়া, হাইর পাড়া, মুন্নী পাড়া, সাইরা পাড়া, ফাতনজা, ফেরানপ্রম্ন, সিকদার পাড়া, হাঁড়ি পাড়া, হেতিলস্না পাড়ার বাসিন্দারা গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছে। এদের মধ্য অনেকে সীমান্ত দিয়ে এপারে অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় জড়ো হয়ে রয়েছে। ফলে মিয়ানমার সীমান্ত পেরিয়ে টেকনাফে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চেষ্টা বাড়তে পারে। একই সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) সদস্যদের অনুপ্রবেশের ঘটনাও বৃদ্ধি পেতে পারে।
কুতুপালং শরণার্থী শিবিরের নেতা মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, 'মূলত যুদ্ধের নামে রাখাইনে যেসব রোহিঙ্গা রয়েছে তাদের নিশ্চিহ্ন করতে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে দেশটির সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির মধ্যে নাটক চলছে। আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অনুরোধ করব, রোহিঙ্গাদের জন্য নিজ দেশে সেফজোন গড়ে তুলে তাদের সেখানে বসবাসের উপযোগী করা হোক।'
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, 'মিয়ানমারে অভ্যন্তরীণ সংঘাতে আবারও বিস্ফোরণের বিকট শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। আমরা সীমান্তের মানুষের খোঁজখবর রাখছি। তবে কোনো অনুপ্রবেশ যেন না হয় সেজন্য সীমান্তে বিজিবি ও কোস্ট গার্ডের টহল জোরদার রয়েছে।'