প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে ফখরুল
প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচনের রূপরেখা ঘোষণা করবে সরকার
প্রকাশ | ৩০ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি রিপোর্ট
অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির আলোচনা ফলপ্রসূ হয়েছে বলে জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, প্রয়োজনীয় সংস্কার করে নির্বাচনের রূপরেখা ঘোষণা করবে অন্তর্র্বর্তী সরকার। দ্রম্নত সময়ের মধ্যে সরকার দেশকে স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে আসবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন 'যমুনা'র বাইরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে খোলাসা করে বলেননি ফখরুল। অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রতি নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা, রাজনৈতিক সংলাপ আয়োজনের বিষয়ে আহ্বান রেখে কয়েকটি সভায় ফখরুলসহ বিএনপি নেতারা কথার মধ্যে বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার ডাক পায় বিএনপি।
সাংবাদিকদের ফখরুল বলেন, 'প্রধান উপদেষ্টা আলোচনার জন্য ডেকেছিলেন। আমাদের মধ্যে প্রায় সোয়া এক ঘণ্টা আলোচনা হয়েছে। অত্যন্ত ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে।'
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনাকে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিকাল ৪টায় সেখানে বিএনপি নেতাদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠক হয়।
ফখরুল বলেন, 'আমরা আশাবাদী এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার নেতৃত্বে আছেন প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস, তাদের আন্তরিকতা, দেশপ্রেম ও যোগ্যতা দিয়ে খুব দ্রম্নত তারা দেশকে একটা স্টেবল অবস্থায় নিয়ে আসতে পারবেন এবং একই সঙ্গে তারা নির্বাচনের দিকেও যেতে পারবেন। প্রয়োজনীয় সংস্কারসমূহ পূরণ করবেন বলে আমরা মনে করি।'
বিএনপির মহাসচিবের সঙ্গে ছিলেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সালাহউদ্দিন আহমেদ। বৈঠকে পরিকল্পনা ও শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ ও আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলও ছিলেন।
নির্বাচন নিয়ে তাগিদ দিয়ে ফখরুলের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় তাড়াহুড়া না করার পক্ষে অবস্থান তুলে ধরেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। অবশ্য ফখরুলও সে বিষয়ে জবাব দিয়ে বলেন, যাদের সরকার পরিচালনার সক্ষমতা নেই, তারাই এসব কথা বলে থাকেন। অবশ্যই এই পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে দুই নেতা কেউ পরস্পরের নাম ধরে কথা বলেননি।
সাংবাদিকদের প্রশ্নে মির্জা ফখরুল বলেন, 'রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হবে পর্যায়ক্রমে।'
নির্বাচনের কোনো সম্ভাব্য তারিখ নিয়ে আলোচনা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমরা কোনো তারিখ নিয়ে আলোচনা করিনি। আমরা কোনো তারিখ বলব না। এটা উনারা (অন্তর্র্বর্তী সরকার) বলবেন।'
অধ্যাপক ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেওয়ার পর গত ১২ আগস্ট বিএনপি মহাসচিবের নেতৃত্বে দলটির স্থায়ী কমিটির সাত সদস্য যমুনায় গিয়ে প্রথমবার বৈঠক করেন।
গণআন্দোলন ও জনরোষের মুখে ৫ আগস্ট পতন হয় শেখ হাসিনা সরকারের। তিন দিন বাদে গঠন হয় অন্তর্র্বর্তী সরকার। আওয়ামী লীগকে বাদ রেখে অন্যান্য দল ও সেনাবাহিনী আলোচনা করে এই সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। অন্তর্র্বর্তী সরকারের কাছে অন্যান্য দলের চাওয়া, প্রয়োজনীয় রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ শেষ করে দ্রম্নত সময়ের মধ্যে তারা একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করবেন।
সংসদ ভেঙে যাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নতুন নির্বাচন দেওয়ার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তবে রাষ্ট্র সংস্কারের তাগিদে গঠিত অন্তর্র্বর্তী সরকার কবে নির্বাচন করতে পারবে, সে বিষয়ে এই সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো তারিখ নির্ধারণ করা হয়নি। এ নিয়ে পরিষ্কার বার্তা চাইছিল বিএনপি। সেই ধারায় বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দলটির প্রতিনিধিদের বৈঠক হলো।
'যৌক্তিক সময়ে নির্বাচন হলে সবার জন্য ভালো'
এদিকে, বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ?'অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের নির্বাচনও করতে হবে, আবার জনগণের জন্য কাজও করতে হবে। এই কাজগুলো যদি যৌক্তিক সময়ের মধ্যে হয় সেটা সবার জন্য ভালো।'
বৃহস্পতিবার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার মান্টিতস্কির সঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সাক্ষাৎ শেষে তিনি এসব কথা বলেন।
আমীর খসরু সাংবাদিকদের বলেন, রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনের দিনক্ষণ জানতে চেয়েছেন। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট, নির্বাচন ইত্যাদি বিষয়ে তারা জানতে চেয়েছেন। আমরা বলেছি, ইতোমধ্যে আমরা আমাদের অবস্থান পরিষ্কার করেছি যে, যত শিগগিরই অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যাবে। তারা টাইম ফ্রেম জানতে চেয়েছে, আমরা কোনো টাইম ফ্রেম বলিনি। আমরা বলেছি যে, আমরা এই অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারকে এবং তাদের কার্যক্রমে আমরা পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রিফর্মগুলো- যে রিফর্মগুলো নিয়ে আলোচনা হবে, সেগুলো তাড়াতাড়ি করে একটা নির্ধারিত সময়ে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে।'
এছাড়া দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, জ্বালানি, বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে জানান আমীর খসরু।
আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে আমীর খসরু বলেন, 'উনারা (রাশিয়া) জানতে চাচ্ছেন, বর্তমান অবস্থা এবং ভবিষ্যতে এই সংকট উত্তরণ নিয়ে আমরা কী চিন্তা করছি। আমাদের তরফ থেকে পরিষ্কার বলা হয়েছে যে, বিএনপি সবার সঙ্গে সম্পর্কে বিশ্বাসী। কোনো বিশেষ দেশ বা আলাদাভাবে আমরা কাউকে দেখি না। সব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে এবং বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে রাশিয়ার মানুষের সম্পর্ক থাকবে, দুই দেশের সম্পর্ক থাকবে। সহযোগিতার ক্ষেত্রে আমি যেটা বলেছি, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।'
পর্যটন খাতে রাশিয়ার সঙ্গে সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে আমীর খসরু বলেন, 'রাশিয়া একটি বিশাল দেশ। সেখানে টুরিজমের সুযোগ আছে। তারা এখানে বোধহয় একটা অফিসও খুলতে চাচ্ছে, ভবিষ্যতে ব্যাংকের শাখা করতে চাচ্ছে, আমরা স্বাগত জানিয়েছি। ভবিষ্যতে রাশিয়াতে বাংলাদেশকে কীভাবে তুলে ধরা যায়, রাশিয়ার বাজারে বাংলাদেশের প্রোডাক্টের একটা জায়গা আমরা তৈরি করতে তাদের সহযোগিতার কথা বলেছি। সুতরাং সার্বিকভাবে দুই দেশের যে সম্পর্ক তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে, যেভাবে আমরা অন্যান্য দেশের সঙ্গে করছি।'
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খসরু বলেন, 'স্বাভাবিকভাবে সবাই আজকের (বৃহস্পতিবার) অবস্থান জানতে চায়, আগামী দিনের অবস্থান জানতে চায়। সেই বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। আজকে যে সম্পর্ক আছে, আগামী দিনে সেই সম্পর্ক থাকবে কি না; আমাদের বক্তব্য- পুরোপুরি সম্পর্ক থাকবে। আমাদের সম্পর্ক এগিয়ে যাবে, সব দেশের সঙ্গে থাকবে। আমরা সিলেক্টিভলি কোনো দেশকে আগে বা পরে সেইভাবে দেখি না।'
বিএনপির পররাষ্ট্রনীতি তুলে ধরে তিনি বলেন, 'আমরা সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে যে দুই দেশের মধ্যে যে কম্পারেটিভ অ্যাডভানটেজগুলো আছে, সেগুলোর সুযোগ নিতে হবে। ... দুই দেশের সম্পর্ক এমন হতে হবে যাতে পরস্পর লাভবান হয়, পরস্পরের প্রতি সম্মানবোধ থাকতে হবে, মিচুয়াল রেসপেক্ট থাকতে হবে, মিচুয়ালি বেনিফিটেড হতে হবে, সেই বিষয়গুলো আমাদের আলোচনায় উঠে এসেছে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের যেখানে সম্ভাবনা আছে রাশিয়াতে, রাশিয়ার যদি সম্ভাবনা থাকে এখানে, বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করে- বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থ রক্ষা করে সম্পর্ক গড়ে উঠবে। বন্ধুত্ব হয় দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান মিচুয়াল রেসপেক্ট ও মিচুয়াল ইন্টারেস্টের ভিত্তিতে। সুতরাং রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের সেভাবে সম্পর্ক হবে।'
বৈঠকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আন্তর্জাতিকবিষয়ক কমিটি সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, শামা ওবায়েদ ছিলেন।
'শেখ হাসিনাকে এক দিনের জন্য আয়নাঘরে রাখা হোক'
এদিকে, বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উদ্দেশে বলেছেন, 'শেখ হাসিনা অনেক নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে। আপনার কাছে দাবি থাকবে, তাকে দেশে এনে আইনের মাধ্যমে বিচার করা হোক। একদিনের জন্য তাকে আয়নাঘরে রাখা হোক, এক-দুই দিনের জন্য হলেও তাকে জেলে রাখা হোক।'
বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী মোটর চালক দলের উদ্যোগে শেখ হাসিনার ফাঁসির দাবিতে এক অবস্থান কর্মসূচিতে এসব কথা বলেন তিনি।
শেখ হাসিনার উদ্দেশে ফারুক বলেন, 'সাঈদের মৃতু্যর পর আপনি বলেছিলেন এরা রাজাকারের সন্তান। মুগ্ধ, মিন্টুর মৃতু্যর পর আপনি বলেছিলেন কারও ক্ষমতা নাই আমাকে এখান থেকে সরানো, আমি লৌহমানব, আমি শেখ মুজিবের কন্যা, আমাকে দেশ থেকে কেউ বিতাড়িত করতে পারবে না। কোথায় শেখ হাসিনা? আপনি বাংলাদেশে নাই।'
তিনি বলেন, 'বাংলাদেশের মানুষ খেতে পায় না। আর শেখ হাসিনা হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে তার নিরাপত্তার জন্য বিদেশ থেকে গাড়ি আমদানি করে। বিদু্যতের বিল বাড়িয়েছে রিকশাচালক গরিব মানুষ বিদু্যতের বিল দিতে পারে না। এই বিদু্যতের বিলের হাজার হাজার কোটি টাকা এখনো নসরুল হামিদের কাছে আছে।'
তিনি বলেন, 'ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন শেখ হাসিনার অত্যাচারের কথা বললেও শেষ হবে না।'
অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের উদ্দেশে তিনি বলেন, 'আমরা আপনার কাছে কিছুই চাই না। আমরা যেন দুমুঠো ভাত খেয়ে জীবন যাপন করতে পারি। ঘরের দরজা খুলে নিশ্চিন্তে রাতে ঘুমাতে পারি। আমাকে যেন বিদু্যতের অতিরিক্ত বিল না দিতে হয়। আপনার কাছে এটাই চাই।'
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী মোটর চালক দলের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক মো. সমীর দেওয়ানের সভাপতিত্বে অবস্থান কর্মসূচিতে আরও বক্তব্য রাখেন বিএনপির শিশুবিষয়ক সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ সিদ্দিকী, নির্বাহী কমিটির সদস্য মাওলানা নেসারুল হক, কৃষকদলের সহ-সভাপতি ভিপি ইব্রাহিম, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী মোটর চালক দলের সভাপতি সেলিম রেজা বাবু, সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শিপন বকাউল প্রমুখ।