সুজনের গোলটেবিলে বক্তারা

সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে

প্রকাশ | ৩০ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসানের পর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার একটি নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্র্বর্তী সরকারকে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করে দেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন পদ্ধতি বহাল করে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীতে ডেইলি স্টার ভবনের আজিজুর রহমান সম্মেলনকক্ষে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন আয়োজিত 'বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারে করণীয়' শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এই অভিমত দিয়েছেন। আলোচনার শুরুতেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সব শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন ও আহতদের দ্রম্নত আরোগ্য কামনা করা হয়। গোলটেবিল সঞ্চালনা করেন সুজনের কেন্দ্রীয় সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ১১ আগস্ট সুজনের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে রাষ্ট্র সংস্কারের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় সংস্কারের প্রতিটি বিষয় নিয়ে পৃথক গোলটেবিল আলোচনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। প্রথম বৈঠকটি হচ্ছে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার নিয়ে। সুজনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে করণীয় নিয়ে প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়া নির্বাচন কমিশন গঠন আইন ও প্রার্থীদের হলফনামার নতুন খসড়া তৈরি করা হয়েছে। এসব বিষয়ে গোলটেবিলসহ অনলাইনের মাধ্যমে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে চূড়ান্ত সুপারিশ অন্তর্র্বর্তী সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হবে। কিছুকাল পরপর স্বৈরশাসক আসবে আর তাকে তাড়াতে সাধারণ মানুষ প্রাণ দেবেন, রক্ত দেবেন, এটা হতে পারে না। গোলটেবিল বৈঠকে সাবেক বিচারপতি ও প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) আবদুর রউফ বলেন, 'গণতন্ত্র ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই।' তরুণ শিক্ষার্থী ও জনগণের এ আন্দোলনের ভেতর দিয়ে কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসানে জীবন সায়াহ্নে এসে তিনি আবার আশার আলো দেখতে পাচ্ছেন। উদ্দীপনা বোধ করছেন, ভালো কিছু হবে বলে আশা করছেন। আবদুর রউফ বলেন, কিছুকাল পরপর স্বৈরশাসক আসবে আর তাকে তাড়াতে সাধারণ মানুষ প্রাণ দেবেন, রক্ত দেবেন, এটা হতে পারে না। এবারের আন্দোলনেই যেন এই রীতি চিরতরে শেষ হয়ে যায়। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বিচারপতি রউফ ভোটারদের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার ওপর জোর দেন। একই সঙ্গে মনোনয়ন প্রথা বন্ধের প্রস্তাব দিয়ে বলেন, ২০ কোটি টাকায় দলীয় মনোনয়ন নিয়ে আরও ২০ কোটি টাকা নির্বাচনের মাঠে খরচ করে নির্বাচিত হয়ে পাঁচ বছরে ২০০ কোটি টাকা বানানোর যে প্রক্রিয়া রাজনীতিতে চালু হয়েছে, তা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমদ বলেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না। তত্ত্বাবধায়ক পদ্ধতি কীভাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি আমাদের দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা থাকা প্রয়োজন। তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেই কেউ তাদের ইচ্ছামতো আইন পাস করতে পারবে না। বড় রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে মনে করে, এটা করতে চায় না। তোফায়েল আহমদ বলেন, অনেক সময় দেখা যায়, মাত্র ৩০ শতাংশ ভোট পেয়ে কোনো দল ৬০ শতাংশ বা তার বেশি আসনে জয়ী হয়ে সরকারে যায়। তারা ৭০ শতাংশ মানুষকে শাসন করে। এই পদ্ধতির পরিবর্তন করে নির্বাচিত হতে অন্তত ৫১ শতাংশ ভোট পাওয়ার নিয়ম করা প্রয়োজন। এ ছাড়া দ্বৈত নাগরিকরা ভোট দিতে পারলেও তারা যেন নির্বাচনে প্রার্থী হতে না পারেন, এমন বিধান করা উচিত। ফেমার সভাপ্রধান মনিরা খান বলেন, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে অন্তর্র্বর্তী সরকারে প্রধান কাজ হবে ভালো নির্বাচন কমিশন গঠন করা। জনগণের কাছে নির্বাচন কমিশনের দায়বদ্ধতা, জবাবদিহি, স্বচ্ছতা থাকতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে জনসাধারণের মতামতের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, মাত্র ৩০ শতাংশ ভোট পেয়ে কোনো দল ৬০ শতাংশ বা তার বেশি আসনে জয়ী হয়ে সরকারে যায়। তারা ৭০ শতাংশ মানুষকে শাসন করে। এই পদ্ধতির পরিবর্তন করে নির্বাচিত হতে অন্তত ৫১ শতাংশ ভোট পাওয়ার নিয়ম করা প্রয়োজন। তোফায়েল আহমদ, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ নির্বাচন কমিশনের সাবেক কর্মকর্তা জেসমিন টুলি বলেন, গত ৫৩ বছরে ১২টি জাতীয় নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত চারটি নির্বাচনই কেবল তুলনামূলক স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে। তিনি বলেন, অন্যায় করে পার পাওয়ার একটা রীতি তৈরি হয়েছে। এই পথ সংকুচিত করতে হবে। তাহলে প্রত্যাশিত পরিবর্তন আসবে। নির্বাচন কমিশনের সাবেক কর্মকর্তা ড. আবদুল আলিম নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন পর্যবেক্ষণের প্রক্রিয়াকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেন, নির্বাচন কেমন হয়েছে, তা মূল্যায়ন করতে শক্তিশালী পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক কবি সোহরাব হাসান বলেন, 'আমরা সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করতে পারছি না বলেই গণ-অভু্যত্থান হচ্ছে। গণতান্ত্রিক মানসিকতা তৈরি করতে হবে।' তিনি প্রশ্ন তোলেন, প্রশাসন তত্ত্বাবধায়কের সময় তিন মাস নিরপেক্ষ থাকতে পারলে বাকি চার বছর নয় মাস কেন নিরপেক্ষতা ধরে রাখতে পারছে না? তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ফয়েজ আহমদ তৈয়ব বলেন, ভোটার তালিকা ডিজিটালাইজড করতে হবে। এতে ভোটার ও তার পরিবারের সব সদস্যের জন্মনিবন্ধন, জাতীয়তা সনদসহ অন্য তথ্য দিতে হবে। পাশাপাশি ফলাফল ঘোষণার জন্যও সফটওয়্যার দরকার। ইভিএম থাকবে কি না, থাকলে কীভাবে থাকবে, সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা আমিনুল ইসলাম বলেন, বিদ্যমান নির্বাচনব্যবস্থা অব্যাহত রেখে কোনো নির্বাচন হতে পারে না। নতুন প্রস্তাবনা আনতে হবে। বিজয়ীদের যেন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সমর্থন থাকে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে। আলোচনায় আরও অংশ নেন সাংবাদিক আবু সাঈদ খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস ও সুজনের যুগ্ম সম্পাদক জাকির হোসেন। গোলটেবিলে লিখিত প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার। নির্ধারিত বক্তাদের আলোচনার পর মুক্ত আলোচনা পর্বের মধ্য দিয়ে আয়োজনটি শেষ হয়।