শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১

শাহীন চেয়ারম্যানের যত অনিয়ম-দুর্নীতি

মাসুম পারভেজ, কেরানীগঞ্জ (ঢাকা)
  ২৬ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
শাহীন চেয়ারম্যানের যত অনিয়ম-দুর্নীতি

ছাত্র-জনতার অভু্যত্থানে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর মুখ খুলতে শুরু করেছে ঢাকার কেরানীগঞ্জের নির্যাতিত সাধারণ মানুষ। নিপীড়ন, নির্যাতন এতদিন মুখ বুজে সহ্য করলেও ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দেশে সুশাসন ফিরে আসায় এখন বিচারের দাবিতে সোচ্চার হচ্ছেন নির্যাতিতরা। দিনের পর দিন মারধর, নির্যাতন, জমি দখল করে নিলেও তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারেনি জীবন শঙ্কায় কেরানীগঞ্জের স্থানীয় বাসিন্দারা। এমনি উপজেলা চেয়ারম্যানের বিশেষ বাহিনীর খোঁজ মিলেছে কেরানীগঞ্জে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতার জোরে টানা চারবারের উপজেলা চেয়ারম্যান ও দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহীন আহমেদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা কয়েক শত সদস্য করে বারোটি ইউনিয়নে একটি করে বাহিনী। যা কেরানীগঞ্জের কোন্ডা-হযরতপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় নীরব চাঁদাবাজি, জমি দখলসহ নানা অপকর্ম চালিয়ে যেত দৈনিক ও মাসিক বেতনের শাহীন বাহিনী নামে সন্ত্রাসীরা।

১৬ বছরের ক্ষমতায় বৈধ-অবৈধভাবে শাহীন আহমেদ কামিয়েছেন শতকোটি টাকা। 'কেরানীগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক' তৈরির নামে হ পৃষ্ঠা ১৫ কলাম ১

শিল্পাঞ্চলের জন্য ধলেশ্বরী নদীর সীমানা পিলার তুলে নদীর জমি ও নতুন সোনাকান্দা খাল ভরাট করে প্রায় ৪৭ একর খাস জমি দখল এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন ফসলি জমি কেটে খাল নির্মাণ করেন শাহীন আহমেদ। এছাড়া ওই এলাকার তিন ফসলি জমি মালিকদের বিভিন্নভাবে হয়রানি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে নামমাত্র মূল্যে ক্রয় ও দখল করা হয়েছে। শিল্পাঞ্চলটি প্রায় ১৫৫ একর জমি নিয়ে নির্মাণ হওয়ার কথা থাকলেও শিল্পাঞ্চলের নামে জমি দখলে নেয় শাহীন আহমেদের প্রধান সহযোগী ইয়ারা গার্মেন্টস গ্রম্নপের চেয়ারম্যান এবং কেরানীগঞ্জ বিসিক শিল্পনগরীর সভাপতি হাজী মো. সেলিম। শিল্পাঞ্চলটি সাবেক বিদু্যৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু পার্টনার হিসেবে ছিলেন বলেও জানা যায়। সে সময় কেরানীগঞ্জ মডেলের সাবেক সহকারী কমিশনার (ভূমি) কামরুল হাসান সোহেল খাস জমি উদ্ধারের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হোন। উপজেলার কদমতলী এলাকায় শাহীন আহমেদ ও তার ভাই দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা যুবলীগের কার্যনির্বাহী সদস্য শিপু আহমেদের মালিকানাধীন কিউট সীট কাটিং ফ্যাক্টরি, কিউট কার হাউসের জন্য ব্যক্তিমালিকানাধীন ৪৭ শতাংশ জমি জোরপূর্বক দখল করে কারখানা স্থাপন করা হয়। ওই জমি এখনো রেজিস্ট্রেশন করতে পারেনি। এ ছাড়া সেখানে ১৫ শতাংশ খাস জমি এবং আব্দুল রাজ্জাক নামে এক নিখোঁজ ব্যক্তির জমি ভুয়া মালিক বানিয়ে দখল করার অভিযোগ রয়েছে। এবং তেঘরিয়া ইউনিয়নে কৃষি জমি দখল করে কিউট হাউজিংয়ের নামে আবাসন প্রকল্প করেন। উপজেলার কালিগঞ্জ গার্মেন্টস পলস্নীর শুভাঢ্যা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম নুরু মিয়ার মার্কেট ২০২০ সালে দখল করার চেষ্টা এবং পরবর্তীতে নুরু মিয়ার স্ত্রী-সন্তানরা ৩৩ কোটি টাকা দিয়ে মার্কেট রক্ষা করারও অভিযোগ রয়েছে।

শাহীন চেয়ারম্যান বা শাহীন বাহিনীর নির্দেশে কেরানীগঞ্জের বোয়ালি, কাজিরগাঁও, দ্বীপপুর এবং সোনাকান্দা মৌজায় ইন্ডাস্ট্রি ও হাউজিং প্রকল্পের জন্য উর্বর ফসলি জমি চিহ্নিত করে বিক্রি ও রেজিস্ট্রেশন বন্ধ করে রাখতেন। এসব জমির মালিকরা কারো কাছে জমি বিক্রি করতে গেলে বা সন্তানদের জমি লিখে দিতে গেলেও উপজেলা চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদের লোকজনের বাঁধার কারণে করতে পারতেন না। একমাত্র চেয়ারম্যান ও তার সমর্থিত লোকজনের কাছেই জমি বিক্রি করতে বাধ্য করা হতো। কেরানীগঞ্জে তার ছত্রছায়ায় ৩০টিরও বেশি হাউজিং গড়ে উঠেছে। যার প্রতি শতাংশ জমির জন্য ১০ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হতো। চাঁদা না দিয়ে কেউ হাউজিং প্রকল্পে জমি ক্রয় ও ভবন নির্মাণ করতে পারত না। এবং কেরানীগঞ্জে ৪টি ড্রেজার রয়েছে। জমি ভরাটের জন্য তার ড্রেজারের মাধ্যমে উচ্চ মূল্যে বালু ফেলতে বাধ্য এবং অন্য ড্রেজার মালিকদের কাছ থেকে প্রতি ফিট বালু ফেলার জন্য পঞ্চাশ পয়সা থেকে ১ টাকা পর্যন্ত চাঁদা নিতেন। এদিকে কেরানীগঞ্জের মালঞ্চ এলাকায় গরুর খামার গড়ে তোলার নামে খাস জমি দখলের অভিযোগ উঠেছে।

এসএসসি পাস হলেও তুখোড় বুদ্ধিদীপ্ত শাহীন আহমেদ ভূমি দখল ও চাঁদাবাজির কর্মকান্ডগুলো পরিচালনা করতেন তার ভাই দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা যুবলীগের কার্যনির্বাহী সদস্য শিপু আহমেদ, ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের নেতা জসিম মাহমুদ, মধুসিটি হাবিবুর রহমান, তারানগর ইউপি চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন ফারুক, জিনজিরা ইউপি চেয়ারম্যান সাকুর হোসেন, আওয়ামী লীগ নেতা আনিসুর রহমান, ঢাকা জেলা দক্ষিণ স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হাজী মো. রাসেল মেম্বার, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মিরাজুর রহমান সুমন, কেরানীগঞ্জ মডেল থানা ছাত্রলীগের সভাপতি ইমাম হাসান, কেরানীগঞ্জ মডেল থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ মাসুদ পাপ্পু, সরকারি ইস্পাহানী কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি শাহজালাল অপুসহ তার ঘনিষ্ঠ স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও স্থানীয় নেতাকর্মীদের মাধ্যমে।

এদিকে নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ওই এলাকার একাধিক ব্যক্তি বলেন, শাহীন আহমেদ যখন চেয়ারম্যান ছিলেন তখন নানা অপকর্ম চালিয়ে যেতেন। তার গুন্ডাবাহিনীর ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পাননি। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকার পতনের পর গাঢাকা দিয়েছে শাহীন আহমেদ, জসিম মাহমুদ, সুমনসহ তার গুন্ডাবাহিনী। তারা বলেন, সাধারণ পরিবারের সদস্য হয়েও উন্নয়ন খাতের কোটি কোটি টাকা কৌশলে হাতিয়ে নিয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ। জমি দখল, হাটবাজার ইজারা চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের দুর্নীতির অর্থ দিয়ে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। আর কেউ তার দুর্নীতিতে বাদ সাধলেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিত তার সন্ত্রাসী বাহিনী। এমনকি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারাও দুর্নীতিতে সহায়তা না করলে বদলি করে দেওয়া হতো। দুর্নীতির কোনো কিছুই বাদ দেননি তিনি। যেদিকে তাকানো যাবে, সেদিকেই তার দুর্নীতির দেখা মিলবে। উপজেলার সরকারি প্রকল্পে বাহানায় হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। চেয়ারম্যান শাহীনসহ তাদের দ্রম্নত আইনের আওতায় এনে ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার দাবি স্থানীয় সচেতন মহলের।

অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ বলেন, দুর্নীতি শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকেই বাধাগ্রস্ত করে না। বৈষম্য ও দারিদ্র্যকেও বাড়িয়ে দেয়। দুর্নীতির প্রধান কারণ নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়। তিনি বলেন, দুর্নীতি রোধে দেশে নীতি আছে; কিন্তু প্রয়োগ নেই। আমরা বলার সময় ঠিকই বলছি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা নীতি অবলম্বন করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই। ফলে একজন দুর্নীতি করে পার পেয়ে যাচ্ছে। আবার তাকে দেখে অন্যরা দুর্নীতি করার সাহস পাচ্ছে। এ কারণেই দেশে দুর্নীতি বেড়েছে। জমি দখল-চাঁদাবাজ ও ক্ষমতা খাটিয়ে অনিয়ম করা এ দুর্নীতিবাজদের রুখতে দুষ্টচক্রকে (সিন্ডিকেট) চিহ্নিত করে তাদের শাস্তির আওতায় আনা এখন জরুরি। পাশাপাশি দুর্নীতি প্রতিরোধে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। সব নাগরিকের জন্য টেকসই উন্নয়ন ও দেশের ন্যায়সংগত অগ্রগতি নিশ্চিতে অবশ্যই শক্তিশালী অর্থনৈতিক নীতি বাস্তবায়ন জরুরি। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বাড়াতে হবে। যাতে আর কেউ ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনিয়ম-দুর্নীতি করতে না পারে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে