বগুড়ায় কোটি টাকা লুটের চিন্তা ভেস্তে গেল সাবেক সাংসদের

প্রকাশ | ২৬ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

ইমরান হোসাইন লিখন, বগুড়া
ভয়াল যমুনার তীরে। অর্থাৎ যমুনা থেকে মাত্র ৫০ মিটার দূরত্বে তৈরি করা হয়েছে মুজিব ঢিবি নামের ভুয়া প্রকল্প। প্রায় ৭০ লাখ টাকার মাটি দিয়ে ৩০ বিঘা জমি সমতল থেকে ৭ ফিট উঁচু করা হয়েছে। কেউ বলছেন, আবাসন প্রকল্প আবার অনেকেই বলছেন বন্যার সময় বানভাসিদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে এলাকার মানুষদের ধারণা পরিষ্কার নয়। কারণ এই মুজিব ঢিবির নিচে পড়েছে অনেক কৃষকের ফসলি জমি। এসব কৃষকের কয়েকজনকে ভয় দেখিয়ে ও ফাঁদে ফেলে নামমাত্র কিছু টাকা দিলেও কিছু কৃষককে প্রশাসনের ভয় দেখিয়ে জোর-জবরদস্তি করে জমিগুলো ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। তবে এসব কৃষককে আশ্বস্ত করা হয়েছে যে, সরকারের পক্ষ থেকে যখন ঘর তৈরি করা হবে তখন নানাভাবে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে এবং ওই সময় ঘর দিতে কোনো টাকা-পয়সা দিতে হবে না। এমন তুঘলকি কান্ড ঘটিয়েছেন সারিয়াকান্দি উপজেলার চালুয়াবাড়ি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান সওকত হোসেন। মুজিব ঢিবি নামের এই উঁচু করেই শেষ নয়। এই ঢিবি থেকে একটি নতুন রাস্তাও তৈরি করা হয়েছে, তবে এটি সারিয়াকান্দি এরিয়ার মধ্যে না করে করা হয়েছে সোনাতলা উপজেলার মধ্যে অর্থাৎ পাকুলস্না ইউনিয়নের খাটিয়ামারি এলাকায়। এমন অস্বাভাবিক কাজ অর্থাৎ এক উপজেলার বরাদ্দের কাজ অন্য উপজেলায় করা কীভাবে সম্ভব, তা নিয়েও স্থানীয়দের মধ্যে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। সাবেক চেয়ারম্যান সওকত এই মুজিব ঢিবিকে নিজের প্রজেক্ট বলে চালিয়ে দেওয়ার নানামুখী ফন্দি আঁটলেও যায়যায়দিনের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে আসল রহস্য। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বরাদ্দের কাজের একটি অংশ এটি। অনুসন্ধানে যানা যায়, বগুড়া- ১ আসনের সাবেক সাংসদ আত্মগোপনে থাকা সাহাদারা মান্নান শিল্পী সওকত চেয়ারম্যানকে এই কাজ করার জন্য উপহার হিসেবে প্রায় ৭০ লাখ টাকা প্রদান করে। এই অর্থ দিয়েই যমুনার তীরে ৩০ বিঘা জমি প্রায় সাত ফিট উঁচু করা ও সেখান থেকে চালুয়াবাড়ির সড়কের সঙ্গে সংযোগ দিয়ে একটি রাস্তা তৈরি করেন। রাস্তাটি শুধু তৈরিই হয়েছে এই প্রজেক্টে যাওয়া-আসার জন্যই। এ বিষয়ে স্থানীয়রা বলেন, সওকত চেয়ারম্যান শিল্পী এমপির ঘনিষ্ঠ মানুষ, সে জন্যই কোটি কোটি টাকার বিভিন্ন প্রজেক্ট তাকে দেন। আর এসব প্রজেক্টের কাজগুলো বানভাসিদের উন্নয়নের কাজে না লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেন তারা। এ সময় তারা আরও বলেন, এ বিষয়ে আমরা কিছু বলতে গেলেই আমাদের ওপর নেমে আসত সাহাদারা মান্নান শিল্পী ও সওকত চেয়ারম্যানের পেটুয়া বাহিনীর নির্মম অত্যাচার। বিগত দিনে অসংখ্য মানুষ তাদের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, সাবেক এই এমপি তার বিভিন্ন বরাদ্দের কাজ করে নিতেন সওকত চেয়ারম্যানের মাধ্যমে। অর্থাৎ লুটপাটের প্রকল্পগুলো পরিচালিত হতো তার দ্বারা। এতে সুবিধা লুটত দুইজনই। এসব লুটপাটে এমপি হয়েছে সহস্রাধিক কোটি টাকার মালিক আর চেয়ারম্যান হয়েছে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। সাবেক এই এমপি ও সওকত চেয়ারম্যানের লুটপাটে অতিষ্ঠ হয়েছিল চরাঞ্চলের সাধারণ মানুষগুলো। লুটপাটের মধ্যে টিআর, কাবিখা, কাবিটা, জিআর, বিশেষ বরাদ্দসহ বিভিন্ন প্রকল্প। এ ছাড়া নিয়োগ বাণিজ্য ছিল তাদের অবৈধ অর্থ জোগানের আসল হাতিয়ার। সরেজমিন অদ্ভুদ এই মুজিব ঢিবিতে গিয়ে দেখা যায়, সওকতের নিজস্ব দুটি ড্রেজার মেশিন দিয়ে যমুনা থেকে অবৈধভাবে দিনরাত বালু উত্তোলন করে প্রায় ৩০ বিঘা জমিতে সাত ফিট উঁচু করার কাজ চলছে। এ ছাড়া আশপাশের বসতবাড়ির কাছ থেকে প্রায় ৩০টি ট্রাক্টরযোগে মাটি কেটে এনে ফেলানো হচ্ছে এখানে। এত করে ওইসব বাড়িগুলোও ভেঙে যেতে শুরু করেছে। মুজিব ঢিবি নামের এই প্রজেক্টে কাজ করছেন প্রায় শতাধিক শ্রমিক। তাদের সঙ্গে কথা বললে উঠে আসে আসল রহস্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শ্রমিক বলেন, 'এটা সরকারের কাজ, কিন্তু চেয়ারম্যান আমাদের বলতে নিষেধ করেছে। এখানে প্রতিদিন প্যান্ট-শার্ট পরা স্যাররা দেখতে আসে। ফিস ফিস করে কি কি জানি বলে। আমরা বাপু গরিব মানুষ ওসবে কান দেইনা। দিন শেষে টাকা নিয়ে বাড়ি চলে যাই। তারা আরও বলেন, এই এলাকার মুনষগুলোকে সর্বশান্ত করে দিছে শিল্পী এমপি ও সওকত চেয়ারম্যান। এখানে যাদের জমি আছে, তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে দখল করে নিছে সব।' সামছুল নামের এক ব্যক্তি বলেন, 'এখানে মাটি কাটা হচ্ছে অনেকগুলো উদ্দেশ্য নিয়ে। শুনেছি এমপি সাহেবের দেওয়া ৭০ লাখ টাকা দিয়ে মাটি কাটা হচ্ছে। মাটি কাটা শেষে হলে প্রথমে মরিচের চাড়া তৈরি করে বিক্রি করবে চেয়ারম্যান। এরপর গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প এনে সেখান থেকে হাতিয়ে নিবে কোটি কোটি টাকা। আবার ঘর তৈরির পর অসহায় মানুষগুলোর কাছে থেকে ৩০-৫০ হাজার করে টাকার বিনিময় বিক্রি করবে এসব ঘর। ইতোপূর্বেও যত ঘর হয়েছে, ওইসব থেকেও লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিছে এমপি ও চেয়ারম্যান।' এ বিষয়ে সওকত নামের সাবেক এই চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বললে তিনি প্রথমে বলেন ভাই, 'এটা আমার নিজের অর্থ দিয়ে তৈরি হচ্ছে। এখানে মরিচের চারা উৎপাদন করব। এর একটু পরই পুনরায় ফোন করে বলেন, ভাই বুঝেনিতো এসব, এগুলো নিয়ে কিছু করিয়েন না আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতেছি। এরপর থেকে বিভিন্ন আওয়ামী লীগ নেতাদের মাধ্যমে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন তিনি।' সারিয়াকান্দি উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা তারিফুল ইসলাম বলেন, যমুনার কোল ঘেঁসে মাটি কেটে যে উঁচু জায়গাটি তৈরি করা হয়েছে, এটির নাম মূলত মুজিব ঢিবি। বন্যার সময় বানভাসি মানুষদের এখানে আশ্রয় দেওয়া হবে। এটি কোন প্রকল্পের এবং কত টাকা ব্যয়ে তৈরি হচ্ছে এ বিষয়ে জানাতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর দিতে পারেননি। বরং বার বার প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যান। তবে পরে তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে চাকরি করেছি, কিন্তু এমন লুটপাটের এলাকায় কখনো চাকরি করিনি। এমপি সাহেব বিভিন্ন সময় অনেক কিছুই আমাদের করতে বাধ্য করেছে। আমার কোনো উপায় ছিল না। সারিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তৌহিদুর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, যমুনার কোল ঘেঁষে সওকত চেয়ারম্যানের মাটি কাটার বিষয়টি আপনার কাছে থেকে জানার পর আমি জায়গাটি দেখেছি। উনি এই মাটি কেটে অন্য একটা প্রকল্পের মধ্যে দেওয়ার পাঁয়তারা করছিল। তবে সাবেক এমপি যেদিন থেকে পালিয়েছে, ওইদিন থেকে আমার অফিসে আওয়ামী লীগ দালালমুক্ত করেছি। আমি যতদিন থাকব এখানে কোনো দালালকে ঢুকতে দিব না। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে এমপি ও সওকত চেয়ারম্যান কি পরিমাণ দাপট খাটিয়েছে, তাতো আমরা সবাই জানি। তবে আমি উপজেলা পিআইওকে বলে রেখেছি, কোনো ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে যেন বিল না হয়। তিনি আরও বলেন, আপনাদের আমি নিশ্চিত করতে পারি, আমার পর এখানে যে কর্মকর্তা আসবে, তারাও কখনোই এসব ভুয়া বিলে স্বাক্ষর করবে না। সদ্য বিদায়ী বগুড়া জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, আমার জানা মতে মুজিব ঢিবি নামে কোনো প্রকল্প নেই। বিষয়টি একটু যাচাই-বাছাই করে দেখে বলতে পারব। উলেস্নখ্য, সদ্য আত্মগোপনে থাকা সাবেক সাংসদ সাহাদারা মান্নান শিল্পী সারিয়াকান্দি ও সোনাতলায় নানা ধরনের উন্নয়নের নামে সহস্রাধিক কোটি টাকা নিজের করে নিয়েছে। এসবের শত শত প্রকল্পের কোনো অস্তিত্যই নেই। মসজিদ-মন্দির, রাস্তা-ঘাট, কালভার্ট, গাইড ওয়াল, বাউন্ডারি ওয়াল, বিভিন্ন গর্ত ও নর্দমা ভড়াট এমনকি নদী ভড়াটের মতো প্রকল্প তৈরি করতে বিন্দু পরিমাণ দ্বিধা করেননি তিনি। তাই অতি দ্রম্নত সময় এসব ভুয়া প্রকল্প শনাক্ত করে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান যমুনা চরের বানভাসি সাধারণ মানুষ।