বন্যার্তদের জন্য রাস্তায় রাস্তায় ছাত্র-জনতার অর্থ সংগ্রহ

বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ত্রাণ সংগ্রহ সেল স্থাপন

প্রকাশ | ২৬ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

গাফফার খান চৌধুরী
বন্যার্তদের সহায়তায় রাস্তায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে অর্থ সংগ্রহ করছে ছাত্র-জনতা। এ ছাড়া প্রায় প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে খোলা হয়েছে ত্রাণ সংগ্রহ সেল। একই ধরনের সেল খোলা হয়েছে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানেও। বিশেষ করে ঢাকার প্রতিটি মসজিদে মসজিদে ত্রাণের জন্য অর্থ সহায়তা করতে বাক্স রাখা হয়েছে। সংগৃহীত অর্থের পরিমাণ সন্তোষজনক হওয়ামাত্রই ত্রাণসামগ্রী কিনে ছাত্র-জনতা ছুটছে বানভাসি মানুষের কাছে। রোববার সকালে মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজের সামনে বাস স্টেশনে বেশ কয়েকজন ছাত্র বন্যার্তদের সহায়তায় অর্থ-সহায়তা করতে অনুরোধ করতে দেখা গেছে। ছাত্রদের এমন আহ্বানে সাড়া দিয়ে প্রায় অধিকাংশ মানুষই অর্থ-সহায়তা করছেন। যদিও পথচারীরা যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী সহায়তা করছিলেন। ছাত্রদের সেই সহায়তার হাত ফিরিয়ে দেননি খোদ গার্মেন্টস শ্রমিকরাও। তারা যে যার যার সাধ্যমতো অর্থ-সহায়তা করেছেন। এমন দৃশ্য পুরো এলাকার পথচারীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহের সৃষ্টি করে। সকাল দশটা নাগাদ ছোট আকারের বাক্সটি পূর্ণ হয়ে যায়। বানভাসিদের জন্য ত্রাণ সংগ্রহকারীদের একজন কলেজটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী অনিক হাসান বলছিলেন, অতীতেও আমরা বিভিন্ন সময় নানা ইসু্যতে ত্রাণ সংগ্রহ করেছি। তবে এবার যেভাবে সাড়া পাচ্ছি, অতীতে কোনোদিনই পাইনি। তিনি বলেন, এটি সম্ভবত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের কারণে হয়েছে। সরকারের পতনের পর দেশবাসীর মধ্যে ছাত্রদের সম্পর্কে শ্রদ্ধাবোধ ও ভক্তি বেড়েছে বহুগুণ। আগে ত্রাণ সংগ্রহ করতে গেলে অনেকেই সাহায্যের প্রকৃত কারণ জানতে চাইতেন। কোথায় পড়াশোনা করি বা আদৌ ছাত্র কিনা সেসব নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু এবারের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। কোনো প্রকার প্রশ্নই করছেন না দানকারীরা। তারা নিশ্চিন্তে এবং কোনো প্রকার দ্বিধা ছাড়াই সাধ্যমতো সহায়তা করছেন। যেটি দেখে সত্যিই খুবই আনন্দ অনুভব করছি। তিনি আরও বলেন, মানুষের মনে যাতে শিক্ষার্থী সম্পর্কে কোনো ধরনের সংশয় না থাকে, এজন্য সবাইকে যার যার পরিচয়পত্র গলায় ঝুলিয়ে ত্রাণের অর্থ সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে। কলেজের প্রতিটি সেশনের ছাত্ররা আলাদা আলাদা গ্রম্নপ খুলেছেন। প্রত্যেক বর্ষের ছাত্ররা আলাদা আলাদাভাবে ত্রাণের টাকা সংগ্রহ করছেন। এ ছাড়া বন্যার্তদের সহায়তায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গ্রম্নপ খোলা হয়েছে। দেশ-বিদেশ থেকে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াতে মানুষ ব্যাপকভাবে সাড়া দিচ্ছেন। তিনি বলেন, গত ২১ আগস্ট থেকে আচমকা অসময়ে বন্যা শুরু হয়। পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করার বিষয়টি ওই রাতেই নিশ্চিত হই আমরা। রাতেই কলেজের শিক্ষার্থীদের তরফ থেকে শিক্ষকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করি। বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ২২ আগস্ট থেকেই অর্থ সংগ্রহের কাজ শুরু করি। ২৫ আগস্ট পর্যন্ত শুধু নগদ টাকাই সহায়তা পাওয়া যায় প্রায় দুই লাখ টাকা। এ ছাড়া অনেকেই জামাকাপড়, শুকনো খাবার, ট্রাকসহ নানা কিছু দিয়ে সহায়তা করেছেন। একটি ট্রাকভর্তি হলেই ছাত্ররা চলে যাচ্ছেন বন্যার্তদের পাশে। যতদিন বন্যা থাকবে ততদিন এমন সহায়তা অব্যাহত থাকবে। প্রয়োজনে বন্যার পরও এমন সহায়তা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হবে। কলেজটির আরেক শিক্ষার্থী শিহাব আহমেদ জানান, শুধু বাঙলা কলেজ নয়, ঢাকার প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই এমন তৎপরতা চলছে। শুধু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খুদে শিক্ষার্থীরা এমন কর্মযজ্ঞের বাইরে রয়েছে। তারপরও ক্লাস ফোর ও পঞ্চম শ্রেণির অনেক শিক্ষার্থী ত্রাণ হিসেবে অর্থ সহায়তা চাইছেন অনেক জায়গায়। অনেক শিক্ষার্থীর অভিভাবকরা পর্যন্ত নেমেছেন রাস্তায় ত্রাণের অর্থ সংগ্রহে। ঢাকার ফুলবাড়িয়া মার্কেটের সভাপতি আব্দুর রহমান জানান, বন্যার্তদের সহায়তায় মার্কেটের সব দোকান মালিক স্বেচ্ছায় নগদ অর্থ, কাপড়চোপড়, শুকনো খাবারসহ প্রয়োজনীয় নানা জিনিসপত্র দিয়েছেন। সেসব জিনিসপত্র ব্যবসায়ীদের নিয়ে গঠিত স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে বানভাসি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে কয়েক লাখ টাকার ত্রাণ পাঠানো হয়েছে বন্যার্তদের জন্য। এদিকে ঢাকার প্রতিটি মসজিদে রাখা হয়েছে ত্রাণ বাক্স। বাক্সের গায়ে লেখা 'বন্যাদুর্গতদের সহায়তায় এগিয়ে আসুন'। প্রতিদিন সকালে ত্রাণের বাক্স খোলা হচ্ছে। সেখানে মিলছে যথেষ্ট পরিমাণে অর্থ সেই অর্থ দিয়ে ত্রাণসামগ্রী কিনে বন্যার্তদের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে। রোববার ঢাকার ৬০ ফুট আমতলা মোড়ে এক টন ধারণা ক্ষমতাসম্পন্ন একটি মিনিট্রাক নিয়ে একদল মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মাইকিং করে বন্যার্তদের সহায়তায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানাতে দেখা গেছে। গায়ের দুই পাশে দুটি বিশাল ব্যানার ঝোলানো। তাতে লেখা 'বন্যাদুর্গতের পাশে দাঁড়ান।' আর্তমানবতার সেবায় এগিয়ে আসুন। ভ্রাম্যমাণ দলটির অনেকের হাতেই ত্রাণ সহায়তার বাক্স দেখা গেল। তারা বাক্স নিয়ে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে বন্যার্তদের জন্য অর্থ সহায়তা চাইছেন। আবার দলের অনেক সদস্য বাক্স হাতে বিভিন্ন দোকানে দোকানে গিয়ে অর্থ সহায়তা চাইছেন। তারা দশজন সেখানে কাজ করছেন। তাদেরই একজন নাম প্রচার না করার শর্তে বলছিলেন, বন্যা শুরুর পর থেকেই তারা ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় এভাবেই ট্রাক নিয়ে ত্রাণের জন্য অর্থ সংগ্রহ করছেন। মূলত তারা যেখানে মানুষের সমাগম বেশি হয়, সেখানেই অবস্থান নেন। ট্রাকের চালক ও হেলপারও তাদের সঙ্গে ত্রাণ সংগ্রহে যোগ দিয়েছেন। ছোট বা বড় একটি ট্রাকভর্তি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার মতো টাকা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা মালামাল কিনে আরেকটি দলকে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াতে পাঠিয়ে দেন। ত্রাণ বহনকারী ট্রাকগুলোও ভাড়া নিচ্ছে না। গাড়ির মালিক ট্রাক ও ট্রাক চলার তেল দিয়ে সহায়তা করছেন। ইতোমধ্যে তারা দুটি বড় ট্রাকভর্তি মালামাল কিনে তারা ফেনীতে বন্যার্তদের সহায়তায় পাঠিয়েছেন। যতদিন বন্যার্তরা স্বাভাবিক অবস্থায় না ফিরতে পারবেন, ততদিন তাদের ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালিত হবে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর নানা ধরনের রোগবালাই ছড়িয়ে পড়তে পারে। রোগবালাই নিরাময়ে চিকিৎসক দল নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র নিয়ে যাওয়া হবে। এ ছাড়া বন্যায় সব ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। নতুন করে ফসল আবাদ না করতে পারলে, বন্যাকবলিত এলাকায় খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। এজন্য বনার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষেতে ধানের চারা লাগানো, রাস্তাঘাট পরিষ্কার করা, বাড়িঘর নির্মাণসহ নানা কাজে তারা অংশ নেবেন। এজন্য তাদের আগাম প্রস্তুতি রয়েছে। প্রসঙ্গত, দেশের প্রায় ১৪টি জেলায় বন্যা হচ্ছে। পানি বন্দি হয়ে পড়েছেন প্রায় ৫০ লাখ মানুষ। দেশের সর্বস্তরের মানুষ, বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক, পেশাজীবী সংগঠন, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), বাংলাদেশ কোস্টগার্ড বাহিনী, পুলিশ ওর্ যাবসহ অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরা বন্যাকবলিত এলাকায় কাজ করছে।