সিলেটের সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় আটক হওয়া সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে স্থানীয় লোকজন প্রথমে চেনেননি। একজন ব্যক্তিকে ভারতে অবৈধ পথে পাঠানো হচ্ছে- শুধু এ তথ্য পেয়ে এলাকাবাসী ঠেকাতে তৎপর হন। বিষয়টি বিজিবি ক্যাম্পেও জানান স্থানীয় লোকজন। এরপরই সীমান্তের একটি জঙ্গল থেকে তিনি আটক হন। আটকের পর বিজিবি-জনতার জেরায় তার পরিচয় প্রকাশ পায়।
স্থানীয় বাসিন্দা, প্রত্যক্ষদর্শী ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে এসব বিষয় জানা গেছে। শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টায় সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার সীমান্তবর্তী ডনা এলাকা থেকে স্থানীয় জনতার সহায়তায় শামসুদ্দিন চৌধুরীকে আটক করে বিজিবি। পরে শনিবার সকালে তাকে কানাইঘাট থানায় হস্তান্তর করা হয়।
এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক আপিল বিভাগের বিচারপতি ছিলেন। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি অবসরে যান। এরপর তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও টেলিভিশনের টকশোতে কথা বলতেন। তিনি আওয়ামী লীগপন্থি হিসেবে পরিচিত এবং পদত্যাগী শেখ হাসিনা সরকারের পক্ষে সরব ছিলেন। এ ছাড়া সম্প্রতি তিনি এক টকশোতে নারী উপস্থাপকের সঙ্গে আক্রমণাত্মক আচরণ করে সমালোচনার মুখে পড়েন।
যেভাবে আটক হলেন
স্থানীয় একাধিক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২১ আগস্ট শামসুদ্দিন চৌধুরী কানাইঘাট উপজেলার আটগ্রামে অবস্থান নেন। নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে সীমান্ত পার করে দেওয়ার জন্য তিনি স্থানীয় দালালদের সহযোগিতা নেন। পরে তাদের সঙ্গেই গত বৃহস্পতিবার বিকালে সীমান্ত পাড়ি দিতে হেঁটে রওনা হন।
প্রায় ২০ মিনিট হাঁটার পর সীমান্তের একটি জঙ্গলে দালালরা শামসুদ্দিন চৌধুরীকে রেখে চলে যান। ওই রাতে তিনি জঙ্গলে একাই ছিলেন। শুক্রবার সকালে তাকে ভারতে পাঠানোর কথা
জানিয়েছিলেন দালালরা। তবে স্থানীয় মানুষের তৎপরতায় সেটি আর হয়নি।
শামসুদ্দিন চৌধুরীকে আটকের সময় ঘটনাস্থলে ছিলেন সীমান্তবর্তী ডনা খাদিমপাড়া গ্রামের বিলাল আহমেদ। পুরো ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বিলাল জানান, এক ব্যক্তিকে অবৈধভাবে ভারতের সীমান্ত পাড়ি দেওয়ানো হচ্ছে- এমন তথ্য এলাকাবাসী পান ২১ আগস্ট। কিন্তু বিষয়টির সত্যতা তারা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। পরে জানতে পারেন, দালালরা ওই ব্যক্তিকে ভারতের সীমান্তবর্তী একটি জঙ্গলে নিয়ে রেখে এসেছেন বৃহস্পতিবার। সেটি জানতে পেরে তারা সীমান্ত এলাকায় খোঁজাখুঁজি করে শুক্রবার বিকালের দিকে এক ব্যক্তির অস্তিত্ব জঙ্গলে পান। তবে দালালদের পরিচয় তখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী ও বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় লোকজন জঙ্গলে গিয়ে দেখেন, এক ব্যক্তি কলাপাতার ওপর শুয়ে আছেন। এরপর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে স্থানীয় লোকজন জানতে পারেন, তিনি পালিয়ে অবৈধভাবে ভারতে চলে যেতে চাইছেন। তবে দালালরা তাকে মারধর করে সঙ্গে থাকা প্রচুর টাকা নিয়ে পালিয়েছেন। পরে বিজিবিকে বিষয়টি জানানো হয়। স্থানীয় লোক মারফত খবর পেয়ে সন্ধ্যার দিকে বিজিবির টহল দলের সদস্যরা ঘটনাস্থলে আসেন। রাত সাড়ে নয়টার দিকে শামসুদ্দিন চৌধুরীকে আটক করে বিজিবির ডনা ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়। ততক্ষণে ডনা ক্যাম্পের আশপাশে উৎসুক মানুষ ভিড় জমান।
ডনা বিজিবি ক্যাম্পের নায়েক সুবেদার মহিবউলস্না জানান, ক্যাম্পে এনে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর শামসুদ্দিন চৌধুরীর পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়। এরপরই বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ে।
আটকের দুটি ভিডিও ভাইরাল
শামসুদ্দিন চৌধুরীকে আটকের সময়ের দুটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। এর মধ্যে সীমান্তবর্তী এলাকায় ধারণ করা একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, জঙ্গলের মতো একটি স্থানে শামসুদ্দিন ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত অবস্থায় কলাপাতায় শুয়ে আছেন। তার পরনে গাঢ় নীল চেকের হাফহাতা শার্ট আর মাটিমাখা ময়লা-ভেজা প্যান্ট।
শামসুদ্দিন চৌধুরীকে আটক করার পরের আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, একজন ব্যক্তি শামসুদ্দিনের গলায় থাকা গোলাপি রঙের মাফলার ধরে আছেন। তাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করা হচ্ছে। শামসুদ্দিনকে তখন আতঙ্কিত, ভীত ও হতাশ দেখাচ্ছিল। ওই ভিডিওতে একজনকে বলতে শোনা যায়, 'আপনার বাড়ি কোথায়?' উত্তরে তিনি বলেন, 'বাড়ি মুন্সীগঞ্জ।' এরপর নাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমার নাম বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক।'
তখন একজনকে বলতে শোনা যায়, 'বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক? ওই মানিককা..., যে কয়দিন আগে একজন উপস্থাপককে ইয়ে করছে? চ্যানেল আইতে?' তখন শামসুদ্দিন বলেন, 'হঁ্যা।' প্রশ্নকর্তা এবার পিতার নাম জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'পিতার নাম মরহুম আবদুল হাকিম চৌধুরী।' প্রশ্নকর্তা এরপর বলেন, 'আবদুল হাকিম চৌধুরী। গুড। আফনে ইন্ডিয়া পালাইতেছিলেন কেনে? বলেন?' শামসুদ্দিন বলেন, 'ভয়ে পালাইতেছি।'
প্রশ্নকর্তা 'কার ভয়ে' জিজ্ঞাসা করলে উত্তরে শামসুদ্দিন বলেন, 'প্রশাসনের ভয়ে।' প্রশ্নকর্তা এবার বলেন, 'ওই যে একটি মেয়েকে (উপস্থাপক) বলেছিলেন ইয়ের বাচ্চা।' পাশ থেকে আরেকজন বলেন, 'দীপ্তি চৌধুরীকে বলেছিলেন।' শামসুদ্দিন তখন বলেন, 'তার জন্য আমি ক্ষমাও চেয়েছি। আমি বলি আপনারে, আমি ইয়ের রোগী...'। শার্ট তুলে শামসুদ্দিন তখন বুকের অস্ত্রোপচারের ক্ষত দেখানোর চেষ্টা করলে তাকে থামিয়ে দিয়ে প্রশ্নকর্তা বলেন, 'কত রোগী...মিডিয়াতে তো খুব সুন্দর কথা বলেন।' এ সময় আরেকজন প্রশ্নকর্তা বলেন, 'আচ্ছা আচ্ছা শোনেন, আপনাকে যখন ধরেছে, তখন কী কী ছিল আপনার সাথে?'
শামসুদ্দিন চৌধুরী বলেন, 'আমার সাথে ছিল ব্রিটিশ পাসপোর্ট, বাংলা পাসপোর্ট, টাকা, কয়টা ডেবিট কার্ড আর ক্রেডিট কার্ড।' এরপর প্রশ্নকর্তা আবার প্রশ্ন করেন, 'কালকে যে টাকাগুলো ছিল, আজকে কি কোনো টাকা ছিল সাথে?' শামসুদ্দিন এর জবাবে বলেন, 'আজকে টাকা ছিল না। কত জানি, ৪০ হাজার টাকা ছিল।' প্রশ্নকর্তা এরপর জানতে চান, 'কালকে যে দুজন টাকা নিয়েছিল, ওদের কাছে কত টাকা ছিল?' শামসুদ্দিন বলেন, 'ধরেন ৬০-৭০-এর মতো। ওরা নিয়ে গেছে।' প্রশ্নকর্তা জানতে চান, '৬০-৭০ লাখ?' শামসুদ্দিন বলেন, 'হঁ্যা।'
প্রশ্নকর্তা জানতে চান, 'নৌকাওয়ালাও সাথে নিয়ে গেছে?' শামসুদ্দিন চৌধুরী বলেন, 'না, ওই দুই ছোঁকড়া নিছে। আর কেউ ছিল না।' প্রশ্নকর্তা এবার বলেন, 'ওনাদের ফোন নম্বর আছে আপনার কাছে? যারা নিছে?' শামসুদ্দিন বলেন, 'না, কিচ্ছু নাই। আমার ফোন নম্বরটম্বর সব নিয়ে গেছে।' প্রশ্নকর্তা এবার জানতে চান, 'আপনি কত টাকা কন্ট্রাক্টে আসছেন?' শামসুদ্দিন জবাবে বলেন, 'আমি ১৫ হাজার টাকা ওদের বলছিলাম। ওইটা আমি দিছি। কিন্তু পরে ওই দুই ছেলে আমারে মাইরাধইরা টাকা নিয়ে গেছে।'
তখন অন্য আরেক ব্যক্তি জানতে চান, 'এই মাইরটা কোন জায়গাত মারছে, ভাইয়া? বর্ডারে আইনা মারছে, না?' শামসুদ্দিন জবাবে বলেন, 'না, ভিতরে।' ওই প্রশ্নকর্তার এবার জিজ্ঞাসা, 'তারার ভিতরে? ইন্ডিয়ার ভিতরে।' শামসুদ্দিন বলেন, 'ইন্ডিয়ার ভিতরে।' এবার আরেকজন প্রশ্ন করেন, 'আপনে তো আমাদের বাংলাদেশের অনেকের নামে অনেক অন্যায় করেছেন, জুলুম করেছেন। এটা সঠিক?' শামসুদ্দিন উত্তরে বলেন, 'আমি জুলুম করি নাই। বিচারপতি হিসেবে যেগুলো রায় করার, সেগুলো দিছি।'
তখন একজন বিজিবি সদস্য বাধা দিয়ে বলেন, 'এইগুলো আইনি প্রক্রিয়ায় চলবে। এ কথা বলতে পারি না। বাকি যা জিজ্ঞাসা করার আমাদের ঊর্ধ্বতনরা জিজ্ঞাসা করবেন। চলেন আমরা যাই।'
আদালতে ডিম-জুতা নিক্ষেপ
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিককে আদালতে নেওয়া হয়েছে। শনিবার বিকাল ৪টা ১০ মিনিটে সিলেটের জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট-১ আলমগীর হোসেনের আদালতে তোলা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সাবেক বিচারপতি মানিককে আদালতে তোলার সময় অনেকে তার দিকে ডিম ও জুতা নিক্ষেপ করেন। এসময় কয়েকজন হামলার চেষ্টাও চালান। পরে কঠোর নিরাপত্তা দিয়ে তাকে আদালতে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে আদালত তাকে সিলেট কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়।