পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পরিবহণ সেক্টরে দখলদারি, চাঁদাবাজি ও নৈরাজ্য বন্ধ এবং শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় ইতিবাচক পরিবর্তন চায় জনগণ। জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী সেই পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রাখতে চায় বিএনপি।
দলটি বলছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রে যে ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে, সেই পরিবর্তন আনতে সড়ক পরিবহণ মালিক-শ্রমিকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। আন্দোলনে অংশ নিয়ে শুধু জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলেরই ৩১ জন নেতাকর্মীর মৃতু্য হয়েছে। বিএনপি মনে করে, বর্তমান পরিস্থিতিতে মানুষ চায় পরিবহণ সেক্টরের গত ১৮ বছরের অপরাধচক্র ভেঙে একটি জনবান্ধব এবং বিশৃঙ্খলা-চাঁদাবাজিমুক্ত পরিবহণ সেক্টর গড়ে উঠুক।
বিএনপি ও দলপন্থি শ্রমিক নেতারা বলছেন, ট্রেড ইউনিয়নের প্রচলিত নিয়ম এবং শ্রমিক সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পরিবহণ সংগঠন পরিচালিত হবে। মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের কোথাও কোনো সংকট দেখা দিলে, সেই সংগঠনের সদস্যদের মতামত ও গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সমস্যার সমাধান হবে।
বিএনপিপন্থি পরিবহণ নেতাদের দাবি, তারা কখনই দলের নাম ব্যবহার করে কাউকে চাঁদাবাজি, বিশৃঙ্খলা-অপকর্ম করার নূ্যনতম সুযোগ দেয়নি। দলগতভাবে বিএনপি সবসময় এসব কর্মকান্ড থেকে দূরে থেকেছে। বিশেষ করে ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত পরিবহণ সেক্টরে সব ধরনের বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য, চাঁদাবাজি ও আধিপত্য বিস্তার থেকে তারা দলকে দূরে রেখেছিলেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও তারা পরিবহণ সেক্টরে সব ধরনের বিশৃঙ্খলা-নৈরাজ্য থেকে নিজেদের দূরে রাখতে চান। এর কারণ হিসেবে নেতারা বলছেন, বিএনপি কোনো ধরনের দখল, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, অরাজকতা সমর্থন করে না। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এ ব্যাপারে কঠোরভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন। দলের অজ্ঞাতসারে কেউ কোথাও এই ধরনের কাজ করলে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিএনপির অবস্থান 'জিরো টলারেন্স' বলেও জানান তারা।
ছাত্র-জনতার অভু্যত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। এরপর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্র্বর্তী সরকার গঠিত হয়। অভিযোগ ওঠে, পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রাজধানীর ইস্কাটনে বহুতল ভবন ইউনিক হাইটসের চতুর্থ তলায় বাস মালিকদের সংগঠন ঢাকা সড়ক পরিবহণ সমিতি ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ সমিতির কার্যালয় আওয়ামীপন্থিদের নিয়ন্ত্রণ থেকে বিএনপিপন্থি পরিবহণ নেতাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। রাজধানীর গাবতলীতে বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের কার্যালয়ও বেদখল হওয়ার অভিযোগ ওঠে। ঢাকাসহ সারাদেশের বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে পরিবহণ মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়ন কার্যালয়গুলোর নিয়ন্ত্রণও হাত বদল হওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। এছাড়া পরিবহণসংশ্লিষ্ট মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্বেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। অভিযোগ আছে, বিএনপিপন্থি নেতারাই সেখানে নতুন নেতৃত্বে বসেছেন, গঠন করেছেন আহ্বায়ক কমিটি। তবে বিএনপি ও দলপন্থি শ্রমিক নেতাদের পক্ষ থেকে এসব অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে।
নেতাদের দাবি, বর্তমানে ঢাকা সড়ক পরিবহণ সমিতি, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ সমিতি কার্যালয়, আন্তঃজেলা টার্মিনালভিত্তিক মালিক সমিতি, ঢাকা মহানগর কোম্পানিভিত্তিক বাস মালিক সমিতি, শ্রমিক ইউনিয়নের বিভিন্ন কার্যালয় দখলের যে অভিযোগ উঠেছে, সে সবের সঙ্গেও বিএনপি বা শ্রমিক দল কিংবা বিএনপিপন্থি কোনো শ্রমিক নেতা বা দলপন্থি পরিবহণ ব্যবসায়ীদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পরিবহনসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা স্বেচ্ছায় নিজেরাই কার্যালয়ে যাচ্ছেন না। বিগত ১৮ বছর ক্ষমতার অপব্যবহার করে যারা ফেডারেশন ও বিভিন্ন মালিক-শ্রমিক সংগঠন পরিচালনা ও নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে বিগত সময়ের নানা অপকর্মের কারণে গ্রেপ্তার এড়াতে তারা আত্মগোপনে চলে গেছেন। কেউ কেউ আবার কমিটির পরেরজনকে দায়িত্ব দিয়ে চিকিৎসার নাম করে বিদেশে পালিয়ে গেছেন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে পরিবহণ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ সচল ও চাঁদামুক্ত রাখার লক্ষ্যে ফেডারেশন, ইউনিয়ন ও টার্মিনাল নেতারা এবং সাধারণ মালিক-শ্রমিক ঐক্যবদ্ধভাবে স্বপ্রণোদিত হয়ে টার্মিনালগুলোতে কাজ অব্যাহত রেখেছেন।
বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী এবং জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস। তিনি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশনের সহ-সভাপতিও। জানতে চাইলে শিমুল বিশ্বাস বলেন, বিএনপি কোনো দখল-বেদখলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। কোনো জবরদখল আমরা সমর্থন করি না, বরদাস্তও করব না। বিএনপির পক্ষ থেকে দখল-দলীয়করণ বন্ধে কঠোর নির্দেশনা আছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এ ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর।
তিনি আরও বলেন, ছাত্র-জনতার অভু্যত্থানের মধ্য দিয়ে দেশে ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে। মানুষের প্রত্যাশা, পরিবহণ সেক্টরেও একটা ইতিবাচক পরিবর্তন আসুক। বিএনপি সেটাই করতে চায়। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী, পরিবহণ সেক্টরে গত ১৮ বছর ধরে যে অপরাধ-চক্র ছিল তা ভেঙে শ্রমিক মালিকদের যুক্ত করে একটি জনবান্ধব, বিশৃঙ্খলা-চাঁদাবাজিমুক্ত পরিবহণ সেক্টর গড়ে তোলা হবে। পরিবহণ সেক্টরে বিএনপি সেই ইতিবাচক পরিবর্তন চায়।
এদিকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পরিবহণ সেক্টরে দখলদারিত্ব নিয়ে সম্প্রতি দু-একটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশন। সেখানে সংগঠনটির কার্যকরী সভাপতি আব্দুর রহিম বকস (দুদু) ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির খান বলেন, বিএনপি কিংবা বিএনপিপন্থি কোনো শ্রমিক নেতা বা পরিবহণ সেক্টরে কোনোরূপ দখলবাজিতে যুক্ত নন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভু্যত্থানপরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর দেশের বৃহত্তর স্বার্থে ফেডারেশন, ইউনিয়ন ও টার্মিনালগুলোর নেতারা যাত্রী পরিবহণ, পণ্য পরিবহণ, আমদানি-রপ্তানি পণ্য পরিবহণসহ পরিবহণ ব্যবস্থা সচল ও চাঁদাবাজ মুক্ত রাখতে ফেডারেশন, ইউনিয়ন ও টার্মিনাল নেতারা এবং মালিক-শ্রমিক ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
তারা আরও বলেন, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশন সকল মতাদর্শের সমন্বয়ে একটি নির্দলীয় ও অরাজনৈতিক সংগঠন।