তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের মামলায় মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের সাবেক সম্পাদক আদিলুর রহমান খান ও বর্তমান পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিন এলানকে দেওয়া সাজার রায় বাতিল ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট।
বর্তমান অন্তর্র্বর্তী সরকারের একজন উপদেষ্টা আদিলুর রহমান। তিনি শিল্প মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব আছেন। ছাত্র-জনতার অভু্যত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে গঠন করা হয় এই অন্তর্র্বর্তী সরকার।
মামলায় বিচারিক আদালতের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আদিলুর রহমান ও নাসির উদ্দিনের করা আপিল মঞ্জুর করে বিচারপতি আবদুর রবের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ বৃহস্পতিবার রায় দেন।
রায়ের পর আদিলুর রহমান ও নাসির উদ্দিনের আইনজীবী রুহুল আমিন ভূঁইয়া বলেন, 'হাইকোর্ট আদিলুর রহমান
ও নাসির উদ্দিনের আপিল মঞ্জুর করেছেন। নিম্ন আদালতের দেওয়া সাজার রায় বাতিল করেছেন। ফলে তারা মিথ্যা ওই মামলার দায় থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত, তথা খালাস পেলেন। সত্যের জয় হয়েছে। মিথ্যা পরাজিত হয়েছে।'
এক দশকের বেশি সময় আগের ঘটনায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের (আইসিটি) ৫৭ ধারায় মামলায় গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর আদিলুর রহমান ও নাসির উদ্দিনকে দুই বছর করে কারাদন্ড দেন ঢাকার সাইবার ট্রাইবু্যনাল। একই সঙ্গে তাদের ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা অনাদায়ে আরও এক মাসের কারাদন্ড দেওয়া হয়।
সাইবার ট্রাইবু্যনালের এই রায়ের বিরুদ্ধে একই বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টে আপিল করেন আদিলুর রহমান ও নাসির উদ্দিন। তখন তারা কারাগারে ছিলেন।
গত বছরের ১০ অক্টোবর হাইকোর্ট আদিলুর রহমান ও নাসির উদ্দিনের করা আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন। একই সঙ্গে জরিমানা স্থগিত করে তাদের জামিন মঞ্জুর করেন। গত বছরের ১৫ অক্টোবর তারা জামিনে কারামুক্তি পান। অন্যদিকে এই মামলায় আদিলুর রহমান ও নাসির উদ্দিনের সাজা বৃদ্ধি চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ হাইকোর্টে আপিল করে।
আদিলুর রহমান ও নাসির উদ্দিনের করা আপিলের ওপর শুনানি শেষে তা মঞ্জুর করে রায় দেন হাইকোর্ট।
আদালতে আদিলুর রহমান ও নাসির উদ্দিনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী রুহুল আমিন ভূঁইয়া। সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী মো. আহসানুজ্জামান ফাহিম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অনীক আর হক।
আদিলুর রহমান ও নাসির উদ্দিনের পক্ষে আইনজীবী মো. ইউসুফ আলী, আকমল খান, দেলোয়ার হোসেন খান, চন্দন চন্দ্র সরকার, উজ্জ্বল পাল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিলের বিষয়ে আইনজীবী রুহুল আমিন ভূঁইয়া বলেন, সাজা বৃদ্ধি চেয়ে করা আপিলের গ্রহণযোগ্যতার ওপর শুনানি হয়নি। গত বুধবার শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষ আপিলটি না চালানোর কথা জানিয়ে তা তুলে নেয়।
২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান নিয়ে অসত্য-বিকৃত তথ্য প্রচারের অভিযোগে আদিলুর রহমান ও নাসির উদ্দিনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিল। এই মামলায় আদিলুর রহমানকে ২০১৩ সালের ১০ আগস্ট গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। সে সময় তিনি ৬১ দিন কারাভোগ করেন। ২০১৩ সালের ১১ আগস্ট আদালতের অনুমতি নিয়ে অধিকারের কার্যালয়ে তলস্নাশি চালিয়ে দুটি কম্পিউটার ও দুটি ল্যাপটপ জব্দ করা হয়। সে বছরের ৪ সেপ্টেম্বর আদিলুর রহমান ও নাসির উদ্দিনের বিরুদ্ধে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেয় ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)।
পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, আদিলুর রহমান ও নাসির উদ্দিন ৬১ জনের মৃতু্যর 'বানোয়াট, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও মিথ্যা' তথ্যসংবলিত প্রতিবেদন তৈরি ও প্রচার করে জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি করেন। আইনশৃঙ্খলা বিঘ্নের অপচেষ্টা চালান। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সরকার ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি দেশ-বিদেশে চরমভাবে ক্ষুণ্ন করেন।
মামলায় আইসিটি আইনের ৫৭ (২) ধারায় ২০১৪ সালের ৮ জানুয়ারি আদিলুর রহমান ও নাসির উদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছিল।
আদিলুর রহমান ও নাসির উদ্দিনের কারাদন্ডের ঘটনায় দেশ-বিদেশ থেকে উদ্বেগ জানানো হয়েছিল।
'অধিকারের নিবন্ধন বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ'
এদিকে এনজিও বিষয়ক বু্যরো কর্তৃক বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা অধিকারের নিবন্ধন বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। এ বিষয়ে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করে বৃহস্পতিবার বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি শশাঙ্ক শেখর সরকারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রায় দেন। আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট রুহুল আমিন ভূঁইয়া।
অধিকারের নিবন্ধনের মেয়াদ ২০১৫ সালের ২৫ মার্চ শেষ হয়। সংস্থাটি নিবন্ধন নবায়নের আবেদন করলেও তা দীর্ঘদিন ঝুলে ছিল। ২০১৮ সালে নির্বাচন পর্যবেক্ষক হিসেবেও অধিকারের নিবন্ধন বাতিল করে নির্বাচন কমিশন।
অধিকারের নিবন্ধন বাতিল করা হয় ২০২২ সালের ৬ জুন। বু্যরোর এক আদেশে সংস্থাটির নিবন্ধন নবায়ন আবেদন নিষ্পত্তি করা হয়। দীর্ঘদিন সুরাহার অপেক্ষায় থাকার পর অবশেষে সংস্থাটি নিবন্ধন হারায়। পরে তারা প্রতিকার চেয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন।
এনজিও বু্যরো সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করাসহ বেশ কয়েকটি কারণে অধিকারের নিবন্ধন বাতিল করা হয়। এ ছাড়া আমলে নেওয়া হয় প্রতিষ্ঠানটির কাছে বিভিন্ন সময় তলব করা তথ্য তারা যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে না পারার বিষয়টিও।