ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরি, কাজ না করেই বিল উত্তোলন
উপজেলা চেয়ারম্যান ও প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে এডিপির অর্থ লুটের অভিযোগ
প্রকাশ | ২৩ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
ইমরান হোসাইন লিখন, বগুড়া
কাগজে-কলমে লাখ লাখ টাকা বরাদ্দ থাকলেও বাস্তবে তার চিত্র ভিন্ন। অপ্রয়োজনীয় কাজ দেখিয়ে ও মালামাল ক্রয়ের নামে ভুয়া ভাউচার তৈরি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বগুড়ার সোনাতলা উপজেলা প্রকৌশলী ও উপজেলা চেয়ারম্যান। এসব নানামুখী অনিয়ম করে ইতোমধ্যে দেশে-বিদেশে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহার। অন্যদিকে নিজ দলের নেতাকর্মীদের বিপদে ফেলে ইতোমধ্যে গা ঢাকা দিয়েছেন এসব অনিয়মের 'মাস্টার মাইন্ড' বগুড়া-১ আসনের সাবেক সাংসদ শাহাদারা মান্নান শিল্পী ও সোনাতলা উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট মিনহাদুজ্জামন লিটন। এতে এই এডিপি প্রকল্পের বেশকিছু কাজ ঝুলে আছে। তবে কাজ ঝুলে থাকলেও এসব প্রকল্পের সমুদয়
অর্থ অনেক আগেই উত্তোলন করা হয়েছে।
অ্যানুয়েল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (এডিপি) প্রকল্পের কাজ বেশকিছু নিয়মনীতি অনুসরণ করতে হয়। কী ধরনের কাজ করা যাবে আর কী ধরনের যাবে না- তাও উলেস্নখ করা আছে এই প্রকল্পের নির্দেশিকা বইটিতে। তবে এসব নিয়মনীতির তোয়াক্কা কখনোই করা হয়নি বগুড়ার বেশকিছু উপজেলায়। এর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য রয়েছে সোনাতলা উপজেলা। কারণ দীর্ঘদিনের আওয়ামী শাসনামলে সবকিছুই নিজেদের করে ফেলেছে বগুড়া-১ সোনাতলা সারিয়াকান্দি আসনের সাবেক সাংসদ সাহাদারা মান্নান শিল্পী। তার নানা ধরনের কৌশলে গত কয়েক বছরে লুটপাট হয়েছে কোটি কোটি টাকা। লুটপাটের রাস্তা পরিষ্কার করতে ভোট ডাকাতির মধ্যদিয়ে নিজের ছেলে ও ভাইকে সোনাতলা ও সারিয়াকান্দি উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেছেন তিনি। ছেলে ও ভাই নির্বাচিত হয়ে শপথ গ্রহণের পর থেকেই তিনজনে মাঠে নেমে পড়েন বিভিন্ন অনিয়মে। এর মধ্যে নিয়োগ বাণিজ্য, ঠিকাদারি, ভুয়া বিল-ভাউচার তৈরি, বিভিন্ন ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে টাকা উত্তোলনসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন।
দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে সরকারি খাতে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য (এডিপি) অর্থাৎ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। কিন্তু সোনাতলায় করা হয়েছে তার উল্টো। এই প্রকল্পের সমুদয় অর্থ ব্যয় করা হয়েছে দলীয় কর্মকান্ড ও নিজেদের পকেট ভারী করতে। ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে কিছু নিম্নমানের বিতরণ সামগ্রী ক্রয় করা হলেও সেগুলো বিতরণ হয়েছে দলীয় নেতাকর্মীদের মাঝে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে বিগত ৬ বছরে বিতরণকৃত সামগ্রী কখনোই দলের বাইরে কেউ পায়নি।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের বরাদ্দ থেকে যে কাজগুলো করা হয়েছে সরেজমিন এসব দেখে চোখ কপালে ওঠার মতো। আড়াই লাখ টাকা ব্যয়ে বালুয়া ইউনিয়নের জুয়েলের বাড়ির তিনমাথা মোড় থেকে শাহিদুলের বাড়ি পর্যন্ত যে রাস্তার বর্ণনা দেওয়া আছে সেখানে মাত্র ৯০ ফিট রাস্তা সিসি ঢালাই করা হয়েছে। যাতে সর্বোচ্চ ব্যয় হয়েছে ৬০-৭০ হাজার টাকা। ১ লাখ টাকা ব্যয়ে শিহিপুরের রাস্তা, ২ লাখ টাকা ব্যয়ে গণসারপাড়ায় ইটের সোলিং, ১ লাখ টাকা ব্যয়ে গড়চৈতন্যপুর কমারবাড়ীতে সিসি ঢালাইকরণ, ১ লাখ টাকা ব্যয়ে দিগদাইর উত্তরপাড়া মসজিদের কাছে সিসিকরণ, আড়াই লাখ টাকা ব্যয়ে রংরারপাড়া দুলুর বাড়ির মোড়ে প্যালাসাইডিংকরণ, উত্তর আটঘরিয়ায় আড়াই লাখ টাকা ব্যয়ে সিসিকরণ, আড়াই লাখ টাকা ব্যয়ে মহিচরণ বুলবুলের স'মিলের পাশে সিসিকরণ, ১ লাখ টাকা ব্যয়ে হড়িখালি টেকনিক্যাল কলেজ রোডে সিসিকরণ, দেড় লাখ টাকা ব্যয়ে ফুলবাড়িয়ায় ফাইদুলের বাড়ির মোড়ে সিসিকরণ, আড়াই লাখ টাকা ব্যয়ে পূর্ব তেকানী বড় মসজিদের পাশে প্যালাসাইডিং, আড়াই লাখ টাকা ব্যয়ে পাকুলস্নায় এনামুলের বাড়ি-টুটুলের পুকুর পাড়ে প্যালাসাইডিং করা হয়েছে। এসব কাজে ৩ ভাগের এক ভাগ অর্থও ব্যয় হয়নি। এছাড়া ৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ে সোনাতলা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা কলেজ সংস্কারের নামে পুরোটাই পকেটে তোলা হয়েছে। ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা ব্যয়ে উপজেলা পরিষদের ভেতরে জয়বাংলা ফোয়ারা নির্মাণ কাজটি কিছুটা হয়ে আটকে আছে। আড়াই লাখ টাকা ব্যয়ে বঙ্গবন্ধু চত্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিটি একটু হয়ে আটকে আছে। সাড়ে ৪ লাখ টাকা ব্যয়ে আব্দুল মান্নান বাস্কেট বল গ্রাউন্ড নির্মাণের নামে কিছু ইট বিছানো হয়েছে। পাকুলস্না উত্তরপাড়া ব্রিজের পাশে ২ লাখ টাকা ব্যয়ে আরসিসিকরণের নামে নামমাত্র সিসিকরণ, শিহিপুর সরকারপাড়া মসজিদের কাছে সিসিকরণ উক্ত কাজগুলোর নামে লাখ লাখ টাকা পকেটে তুলেছেন উপজেলা প্রকৌশলী ও উপজেলা চেয়ারম্যান। এছাড়া গরিব-দুস্থদের মাঝে সেলাই মেশিন, নলকুপ, পস্নাস্টিকের চেয়ার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেঞ্চ বিতরণের নামেও করা হয়েছে লুটপাট।
প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে স্প্রে মেশিন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্টিলের আলমারি, গরু খামারিদের মাঝে গামবুট, বিভিন্ন ক্লাবে ক্রীড়া সামগ্রী, ডেস্কটপ কম্পিউটার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মার্কার পেন-কলম, মেধাবী শিক্ষার্থীদের মাঝে ক্রেস্ট বিতরণসহ বিভিন্ন সামগ্রী বিতরণ দেখানোর শতকরা ৮০ ভাগই ভুয়া। তবে যেটুকু বিতরণ হয়েছে এসব সামগ্রীগুলোর ওপরে স্টিকার সাটিয়ে দেওয়া হয়েছে যাতে লেখা রয়েছে উপজেলা চেয়ারম্যানের পক্ষ থেকে কিংবা, নৌকায় ভোট দিন অথবা সাহাদারা মান্নান শিল্পীর পক্ষ থেকে। আবার বিভিন্ন সভা-সমাবেশে কিংবা বিতরণকালে ঘোষণা করা হয়েছে, উপজেলা চেয়ারম্যানের ব্যক্তিগত অর্থ দিয়ে এসব দেওয়া হচ্ছে।
উক্ত প্রকল্পগুলোর জন্য যেসব কমিটি করা হয়েছে সেগুলো সম্পূর্ণই ভুয়া। কারণ যাদের কমিটিতে রাখা হয়েছে তারা জানেই না যে এডিপি প্রকল্পের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সদস্য তারা। এই কমিটিগুলোর সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বললে তারা যেন আকাশ থেকে পড়েন। কারণ এসবের তারা কিছুই জানেন না। উক্ত প্রকল্পের সদস্যরা দাবি তোলেন 'আমাদের নাম ভাঙিয়ে যারা লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছে তাদের বিচারের আওতায় আনা হোক।'
উপজেলা আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতাকর্মী বলেন, 'আমরা সারাজীবন দল করে কিছুই পাইনি বরং এমপির পরিবারতন্ত্রের কাছে জুলুম-অত্যাচার-নিপীড়ন ও বৈষম্যের শিকার হয়েছি। আজ এই বিপদের সময়ে তারা আত্মগোপনে চলে গেছেন।'
এ বিষয়ে সোনাতলা উপজেলা প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, 'বুঝেন তো, বাধ্য হয়ে এসব অনিয়মকে সায় দিতে হয়েছে। এমপি উপজেলা চেয়ারম্যান যেসব করতে চাইছে আমাকেও তাই করতে হয়েছে।' তিনি আরো বলেন, অসম্পূর্ণ যেসব কাজ রয়েছে সেগুলো করতে ইতোমধ্যে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয়েছে। বরাদ্দকৃত অর্থ উত্তোলন করে পকেটে রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো সদোত্তর দিতে পারেননি।
উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা আয়েসা সিদ্দিকা বলেন, 'আমার চাকরিজীবনে এমন অনিয়মের উপজেলা কখনোই দেখিনি। এখানে কাজ না করলেও বিল দিতে হয়, ভুয়া প্রকল্প দেখানো লাগে। তবে আমি আমার সঠিক সিদ্ধান্তেই ছিলাম, কখনোই ভুয়া বিল দেইনি। বরং ২৩-২৪ অর্থবছরে ৬৪ লাখ টাকা সরকারকে রিটার্ন করেছি। এসব নানাবিধ কারণে বিভিন্ন সময় হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। মিথ্যা অভিযোগে দীর্ঘদিন সাময়িক বরখাস্ত করে রাখা হয়েছিল। এখন সময় এসেছে সত্যের। আমি এসবের বিচার চাই।'
সাবেক সাংসদ সাহাদারা মান্নান শিল্পী ও উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মিনহাদুজ্জামান লিটন আত্মগোপনে থাকার কারণে তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
উলেস্নখ্য, সোনাতলা ও সারিয়াকান্দি উপজেলা দুটি অনিয়মের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছিল। একক আধিপত্য বিস্তারে সাহাদারা মান্নান তৈরি করেছিলেন নামে-বেনামে নানা ধরনের পেটুয়া বাহিনী। তাদের পরিবারতন্ত্র রাজনীতির কাছে অসহায় হয়ে পড়েছিল সাধারণ মানুষ। এখন এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষগুলোর দাবি দীর্ঘদিনের অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ অনুসন্ধান করে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করার।