সপ্তাহখানেক ধরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে চট্টগ্রামে। দিনরাত হচ্ছে ভারী বর্ষণ। এতে নগরের নিম্ন্নাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। বেশিরভাগ এলাকার রাস্তাঘাট হাঁটু থেকে কোমরসমান পানিতে ডুবে গেছে। বাসা-বাড়িতে ঢুকেছে পানি। সড়কে গণপরিবহণ চলাচল কমে গেছে। এছাড়া চট্টগ্রাম থেকে দেশের সব রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। ফলে কর্মস্থলে যেতে ভোগান্তি পোহাতে হয় সাধারণ মানুষকে।
বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে ১৫৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। এছাড়া বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টায় ৭২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় চট্টগ্রামে।
টানা বৃষ্টিতে ডুবে গেছে নগরের চকবাজার, কাতালগঞ্জ, শুলকবহর, বাদুরতলা, শান্তিনগর, ফুলতলা, বউবাজার, রাহাত্তার পুল, কালামিয়া বাজার, তুলাতলী, রুবি গেট, বায়েজিদ, অক্সিজেন, মুরাদপুর, মোহাম্মদপুর, সুন্নিয়া মাদ্রাসা রোড, ডিসি রোড, বহদ্দারহাট, খাজা রোড, ফরিদারপাড়া, ঘাসিয়াপাড়া, খতিবেরহাট, বারইপাড়া, মাইজপাড়া, খরমপাড়া, বাকলিয়া, মিয়া খান নগর, কে বি আমান আলী সড়ক, সৈয়দ শাহ সড়ক, চাক্তাই, দুই নম্বর গেট, আল ফালাহ গলি, পুরনো চান্দগাঁও থানা এলাকা, চৌধুরী পাড়া, রিয়াজউদ্দিন বাজার, দেওয়ানহাট, মোগলটুলী, পাঠানটুলী, আগ্রাবাদ কমার্স কলেজ রোড, সিডিএ আবাসিক, হালিশহর ওয়াপদা, সাগরিকা, খুলশি, আকবর শাহ, ইপিজেড ও আকমল আলী সড়ক। এসব এলাকার বাসাবাড়ি, মসজিদ, বিপণিবিতান ও দোকানপাট পানিতে ডুবে গেছে।
নগরের আগ্রাবাদ এলাকার বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত সালাহউদ্দিন যায়যায়দিনকে বলেন, চট্টগ্রামে টানা চার-পাঁচদিন ধরে লাগাতার বৃষ্টি হচ্ছে। আর প্রত্যেকদিন জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। বাসা থেকে অফিসে আসার সময় মুরাদপুরে কোমরসমান পানি ছিল। আবার আগ্রাবাদেও পানি। সড়কে যানবাহন তেমন না থাকায় অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে অফিসে আসতে হয়।
চট্টগ্রাম নগরের ফয়'স লেক এলাকার জহিরুল হক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, তিনি প্রবর্তক মোড়ের একটি রোগনির্ণয় কেন্দ্রে অফিস করতে যাবেন। সকাল ৯টার দিকে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। ভারী বর্ষণে স্রোতের মতো পানির প্রবাহ সড়ক আর ফুটপাতে। কোনোমতে একটা দোকানের আশ্রয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন যানবাহনের জন্য। কিন্তু অফিসের এই ব্যস্ত সময়েও প্রায় ৩৫ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে হলো তাকে। সিএনজিচালিত অটোরিকশা তেমন একটা চলছে না। দু-একটা বাস এলেও ওঠা সম্ভব হয়নি তার। শেষে ব্যাটারিচালিত একটা রিকশায় গোলপাহাড় মোড় পর্যন্ত এসে দেখেন, সামনের মোড়ে কোমরসমান পানি। ওই এলাকা থেকে তার অফিসের দূরত্ব সময়ের হিসাবে দুই মিনিটের মতো। তবে কোমরপানি ডিঙিয়ে যেতে লেগেছে প্রায় আধা ঘণ্টা।
ফুলতলা এলাকার বাসিন্দা আসিফ মাহমুদ বলেন, বুধবারের বৃষ্টিতে বাসায় পানি ঢুকেছে। এই পানি পরিষ্কার করতে সারাদিন লেগেছে। আবার বৃহস্পতিবার বৃষ্টিতে আরও বেশি পানি ঢুকেছে বাসায়। এখন প্রতিদিন জলাবদ্ধতার পানি ভোগাচ্ছে।
কানাডার সাসকাচোয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ জানান, ইউরোপিয়ান আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেল অনুসারে বৃহস্পতিবার রাত ১২টার মধ্যে চট্টগ্রাম, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মৌলভীবাজার, কুমিলস্না ও ফেনী জেলায় ২০০ থেকে ২৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।
মোস্তফা কামাল পলাশ জানান, বৃহস্পতিবার সারারাত চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোতে ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টির আশঙ্কা করা যাচ্ছে। ফলে সাঙ্গু নদীতে ভয়াবহ পাহাড়ি ঢল নামার প্রবল আশঙ্কা করা যাচ্ছে। ভারী বৃষ্টিতে শুক্রবার পর্যন্ত উত্তর চট্টগ্রাম, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলায় ভূমিধসের প্রবল ঝুঁকি রয়েছে।
চট্টগ্রাম পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ আবদুল বারেক বলেন, বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত লঘুচাপটি বর্তমানে বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। এর প্রভাবে উত্তর বঙ্গোপসাগর এলাকায় গভীর সঞ্চালনশীল মেঘমালা তৈরি অব্যাহত রয়েছে। এ কারণে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ১৫৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে টানা বৃষ্টি পড়বে না। তবে থেমে থেমে বৃষ্টি পড়বে আরও তিন দিন। এরপর সূর্যের দেখা মিলবে বলে আশা করা যায়।
বন্যাপরিস্থিতির অবনতি হয়ে বিভিন্ন স্থানে রেললাইন ডুবে যাওয়ায় চট্টগ্রাম থেকে দেশের সব রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়। পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত বৃহস্পতিবার দুপুর হতে চট্টগ্রাম রেলস্টেশন থেকে জেলার অভ্যন্তরীণ এবং আন্তঃনগর রুটে কোনো ট্রেন না ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।
জানা যায়, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা, জামালপুর, সিলেট ও চাঁদপুরে প্রতিদিন ১১টি আন্তঃনগর ট্রেন চলাচল করে। এছাড়া কক্সবাজার, নাজিরহাট, চাঁদপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহে লোকাল ও কমিউটার ট্রেন চলাচল করে নিয়মিত।
সংশ্লিষ্টদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার সকালে চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে ঢাকাগামী সুবর্ণ এক্সপ্রেস এবং সিলেটগামী পাহাড়িকা এক্সপ্রেস ছেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু রেললাইন ডুবে থাকায় ট্রেনগুলো গন্তব্যে যেতে পারেনি।
রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম যায়যায়দিনকে বলেন, বন্যার পরিস্থিতি খুবই খারাপ। ফেনীতে রেললাইন ও রেলসেতুর ওপর দিয়ে পানি চলাচল করছে। একই অবস্থা হয়েছে সিলেটের একটি রেলসেতুতেও। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেললাইনেও পাহাড় ধস হয়েছে। এ অবস্থায় ট্রেন চালানো খুবই বিপজ্জনক। তাই
যাত্রীদের নিরাপত্তা এবং রেলের সম্পদ রক্ষায় ট্রেন চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বন্যাপরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ট্রেন চলাচলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
এদিকে চট্টগ্রামে পাহাড়ধস ঝুঁকি, জলাবদ্ধতা ও বন্যা ঝুঁকিজনিত দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত রাখা হয়েছে ২৯০টি মেডিকেল টিম। একইসঙ্গে খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুমও।
চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম জেলার ২০০ ইউনিয়নের প্রত্যেকটিতে একটি করে মোট ২০০, এছাড়া ১৫ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্সের প্রত্যেকটিতে ৫টি করে মোট ৭৫টি, ৯টি আরবান ডিসপেন্সারির প্রত্যেকটিতে একটি করে মোট ৯টি, একটি স্কুল হেলথ ক্লিনিকে ১টি ও জেলা সদর হাসপাতালে (চট্টগ্রাম ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল) ৫টি মেডিকেল টিমসহ সর্বমোট ২৯০টি মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য বাফার স্টক (ওষুধ, স্যালাইন, খাবার স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ইত্যাদি) মজুত রয়েছে। এছাড়া সম্ভাব্য যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় সব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রস্তুত থাকতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ইউএইচএন্ডএফপিওসহ সব চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাধ্যতামূলক কর্মস্থলে উপস্থিত থাকার জন্যও বলা হয়েছে।
জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী বলেন, অতি বর্ষণের কারণে মহানগরসহ উপজেলাসমূহের বিস্তীর্ণ এলাকায় জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। কিছু কিছু এলাকায় যানবাহন চলাচল বন্ধসহ জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ প্রশাসনের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছে। সাপে কাটা রোগীর জন্য অ্যান্টিভেনম মজুত ও অতি বৃষ্টির কারণে যেন জনগণের চিকিৎসা সেবা ব্যাহত না হয় সে বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রয়েছে আমাদের। যেকোনো বিষয়ে অবগত/পরামর্শের জন্য জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কন্ট্রোল রুমের নম্বর-০২৩৩৩৩৫৪৮৪৩ সার্বক্ষণিক চালু থাকবে বলেও জানান তিনি।