ছাত্র-জনতার আন্দোলন

চট্টগ্রামে আহতদের অধিকাংশই গুলিবিদ্ধ

প্রকাশ | ২১ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

খোরশেদুল আলম শামীম, চট্টগ্রাম
কারও জখম হাত, পা, পেট, ঘাড় ও পিঠজুড়ে। মাথা থেঁতলে গেছে অনেকের। গুলিতে কারও বুক হয়েছে ঝাঁজরা। কারও হাড় ভেঙে চুরমার। শরীরজুড়ে থাকা ছররা গুলি অস্ত্রোপচার করে বের করা হলেও পড়েছে বহু সেলাই। আহত এসব মানুষের কেউ পথচারী, কেউবা দোকানি বা শিক্ষক। তাদের কেউ খাবার খেয়ে ফিরছিলেন কর্মস্থলে, কেউবা নামাজ শেষে ফিরছিলেন বাসায়। পথে সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে ঠাঁই হয় হাসপাতালে। টানা চিকিৎসাধীন থেকে শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও শরীরজুড়ে তৈরি হওয়া এসব ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়াতে হবে তাদের সারাজীবন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাট, মুরাদপুর, লালখানবাজার, নিউ মার্কেটসহ কয়েকটি স্থানে টানা কয়েক দিনের সংঘর্ষ ও গুলিতে আহত হন এসব মানুষ। তাদের অধিকাংশই গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করার পরও থামেনি বিক্ষোভ-সংঘর্ষ। এদিন নগরের জেল রোড, কোতোয়ালি, লালদীঘি, পুলিশ লাইন্স, মনছুরাবাদ, চান্দগাঁও থানা এলাকাসহ কয়েকটি স্থানে গোলাগুলি ও সহিংসতায় গুলিবিদ্ধ হন তিন শতাধিকের বেশি মানুষ। আহত বেশিরভাগের ঠাঁই হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে। সেখান থেকে জানা যায়, টানা কয়েক দিনের সংঘর্ষে আহত পাঁচ শতাধিক মানুষকে চমেক হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ তিন শতাধিকের মধ্যে শুধু ৫ আগস্টই আসে দুই শতাধিক। এখনো তাদের অনেকে হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি, সার্জারি, অর্থোপেডিক, নিউরোসার্জারিসহ কয়েকটি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন। গুলিবিদ্ধদের একজন ১৭ বছরের মো. আকাশ ছিল না আন্দোলনের কোনো পক্ষেই। পেটের দায়ে নগরীর আতুরার ডিপো এলাকার এ কিশোর কাজ শিখছিল মুরাদপুরের একটি গ্যারেজে। দুপুরে বাসা থেকে ভাত খেয়ে গ্যারেজে যাওয়ার পথে গুলিতে ঝাঁজরা হয় তার পেট। প্রাণে বাঁচলেও তার পেটের মাঝ বরাবর পড়েছে অনেক সেলাই। এই ক্ষতচিহ্ন থাকবে আজীবন। গুলিবিদ্ধ আরেকজন শিক্ষক মো. ওসমান (৩৪) পরিবার নিয়ে থাকেন নগরের ষোলশহরে। ঘটনার দিন নামাজ পড়ে বের হওয়ার পরপরই দু'পক্ষের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গুলিবিদ্ধ হন। ছররা গুলিতে ঝাঁজরা হয়েছে তার ঘাড় ও পিঠ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফুসফুসসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শটগানের গুলিতে দুই পায়ের হাড় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৩ বছরের মোমিনুল ইসলামের। নগরের মনছুরাবাদের ঈদগাঁও এলাকায় পরিবারের সঙ্গে থাকা মোমিনুল শেখ হাসিনার পদত্যাগের রাতে উৎসুক জনতার মিছিল দেখতে বাসা থেকে বের হওয়ার পর গুলিবিদ্ধ হয়। এ ছাড়া শ্রমিকদের মজুরির টাকা দিতে যাওয়ার পথে গুলিবিদ্ধ হন রাজমিস্ত্রি মো. রুবেল। বুক, পা ও মাথায় একাধিক গুলি লেগেছে ভাসমান পণ্য বিক্রেতা আবুল বাসারের। গুলির আঘাতে তার পায়ের হাড় গুঁড়া হয়ে গেছে। তাদের মতো গুলিবিদ্ধ হয়েছেন মিনহাজ রনি, আদনান শরীফ, মো. আলাউদ্দিন, মো. সোহরাব, মো. জাহাঙ্গীর, ইয়াস শরীফ, মো. মাঈনউদ্দিন, মো. ফারুক, মো. মনির, এহসান উল্যাহ, মো. ফয়সাল, মাহবুব হোসেন, মো. সিফাত, মাহমুদ রাকিব, মো. শাহেদ, মো. হাসান, সাকিব উদ্দিন, মো. শাহীন, মারুফ, জয়নাল আবেদীনসহ আরও অনেকে। গুলিবিদ্ধ আকাশের বাবা মো. এনাম বলেন, 'গুলিতে ছেলের পেটের মাঝ বরাবর একাধিক সেলাই পড়ায় লম্বা ক্ষতচিহ্ন তৈরি হয়েছে। নিরপরাধ ছেলেটিকে এই ক্ষত বয়ে বেড়াতে হবে আজীবন। আন্দোলনের কোনো পক্ষে না থাকার পরও কেন আকাশের এমন করুণ পরিণতি হলো?' গুলিবিদ্ধ ওসমান বলেন, 'প্রাণে বেঁচে গেলেও ঘাড়, ফুসফুস, পিঠসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শিক্ষকতার সামান্য আয়ে চলে আমার পুরো পরিবার। এখন অসুস্থ হয়ে পড়ায় সংসারে শুরু হয়েছে টানাপড়েন।' রুবেলের মা হাজেরা বেগম বলেন, 'আন্দোলনের ধারেকাছেও ছিল না আমার ছেলে। তার পরও অনেক গুলি লেগেছে তার। পেটসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে তৈরি হওয়া ক্ষতচিহ্ন দেখে প্রায়ই আঁতকে উঠছে ছেলে।' মোমিনুল ইসলামের মা মোহসেনা বেগম বলেন, 'ছেলের দুই পায়ের হাড় এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সে আর স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারবে কিনা সন্দেহ।' চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দীন বলেন, 'বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে কয়েক দিনের সংঘর্ষে শুধু এই হাসপাতালেই পাঁচ শতাধিক আহতকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে তিন শতাধিকই গুলিবিদ্ধ। শেখ হাসিনার পদত্যাগের দিনই দুই শতাধিক গুলিবিদ্ধ এখানে আসেন। তাদের অনেকে এখনো আইসিইউসহ কয়েকটি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন। আর এ পর্যন্ত হাসপাতালে ১১ জনের মৃতু্য হয়েছে।'