স্থানীয়দের তদন্ত দাবি
১০ বছরে তাজুলের সম্পদ বেড়েছে ১০০ কোটি টাকা
প্রকাশ | ২১ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
সাবেক স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম গত ১০ বছরে একশ’ কোটি টাকারও বেশি সম্পদের মালিক হয়েছেন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের হলফনামা থেকে এ তথ্য জানা গেছে। এ ছাড়া অভিযোগ রয়েছে, তাজুল ইসলাম ক্ষমতায় থাকাকালীন তার স্বজনরাও দুর্নীতির মাধ্যমে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়।
তথ্য মতে, ১০ বছর আগে তাজুল ইসলামের মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ১৬ কোটি টাকার কিছু বেশি। বর্তমানে তা ১১৮ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। এদিকে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, এলজিইডি মন্ত্রী থাকাকালীন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার বিভাগ, জেলা পরিষদ, উপজেলা ও পৌরসভায় উন্নয়নের নামে দেওয়া বরাদ্দ থেকে কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তাজুল ইসলাম। এদিকে, স্থানীয়রা ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাজুল ইসলাম ও তার আত্মীয়স্বজনরা যেসব অবৈধ সম্পদ গড়ে তুলেছেন তা তদন্তের দাবি জানান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয়রা জানান, জেলা, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের উন্নয়ন কাজে যে বরাদ্দ দেওয়া হতো, সেসব বরাদ্দ থেকে নির্দিষ্ট অঙ্কের কমিশন দিতে হতো তাজুল ইসলামকে। তার ব্যক্তিগত আদায়কারী ছিল তার ভাতিজা শাহাদাৎ ও এপিএস জাহিদ। কমিশন বাণিজ্যে তার শ্যালক লাকসাম উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান মহব্বত আলী, ভাতিজা মনোহরগঞ্জ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আমিরুল ইসলাম ও তার উন্নয়ন সমন্বয়ক কামাল হোসেন। কমিশন বাণিজ্যের ফলে তারাও এখন একেকজন শতকোটি টাকার মালিক। তাজুল ইসলামের শ্যালক মহব্বত আলী লাকসামে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ধরে এনে নির্যাতনের জন্য ব্যবহার করতেন ব্যক্তিগত টর্চারসেল, সেখানে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের নানাভাবে নির্যাতন করা হতো, অনেকের কাছ থেকে আদায় করা হতো মোটা অঙ্কের চাঁদা। এ ছাড়া মনোহরগঞ্জের তাজুল ইসলামের বাড়িকে টর্চারসেল হিসেবে ব্যবহার করতেন তার ভাতিজা আমিরুল ইসলাম। তাজুল ইসলাম ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে লাকসামের সমবায় ব্যাংকের কয়েক কোটি টাকার জায়গা নামমাত্র মূল্যে কিনে নেন বলে অভিযোগ করেন তারা।
স্থানীয়রা আরও বলেন, মহব্বত আলী ও আমিরুল ইসলামকে দিয়ে তাজুল ইসলাম লাকসাম মনোহরগঞ্জের অনেকের জায়গা-জমি অবৈধভাবে দখল করে নেন। কেউ বাধা দিলে মামলা-হামলা করে এলাকা ছাড়া করা হতো তাকে।
নির্যাতিত কয়েকজন ভুক্তভোগী বলেন, তাজুল ইসলাম, শ্যালক মহব্বত আলী ও তার ভাতিজা আমিরুল ইসলামের বাসাবাড়ি এবং তাদের ঢাকায়, কুমিল্লায় ও চট্টগ্রামের গোপন আস্তানায় তল্লাশি করা হলে বিদেশি মুদ্রাসহ বিপুল পরিমাণ টাকা ও অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার হতে পারে।
লাকসাম মনোহরগঞ্জের সাধারণ মানুষ, ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাজুল ইসলাম ও তার আত্মীয়স্বজনরা যেসব অবৈধ সম্পদ গড়ে তুলেছেন এবং তাদের প্রত্যেকের ব্যাংক হিসাব জব্দ করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার প্রতি দাবি জানান।
এদিকে দশম, একাদশ ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে তাজুল ইসলামের দাখিল করা হলফনামা বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, মন্ত্রী এখন বছরে আয় করেন ৪ কোটি ১৭ লাখ টাকা। ২০১৪ ও ২০১৮ সালেও তার আয় ৪ কোটি টাকার কিছু বেশি ছিল।
তাজুল ইসলাম কুমিল্লা-৯ (লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ) আসন থেকে চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর তিনি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী হন। তিনি কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। মন্ত্রী হওয়ার আগে ২০১৮ সালে তার মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ৪৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। চার বছরের ব্যবধানে সেই সম্পদ দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। শোধ করেছেন ৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকার ঋণও।
হলফনামায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মন্ত্রী তাজুল ইসলামের কৃষি খাত থেকে আয় বেড়েছে। এবার এই খাতে তার বার্ষিক আয় ৩ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। ২০১৮ সালে ছিল ২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এ বছর বাড়িভাড়া বাবদ আয় হয়েছে ১ কোটি ৬৯ লাখ ৯৩৯ টাকা। ২০১৮ সালে ছিল মাত্র ২২ লাখ ৬৫ হাজার টাকা এবং ২০১৪ সালে ছিল ৭ লাখ ৪০ হাজার টাকা।
তবে এবার শেয়ার, সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক আমানত থেকে আয় কমেছে তাজুল ইসলামের। এই খাতে তিনি আয় করেছেন ১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা, যা ২০১৮ সালে ছিল ২ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। ২০১৪ সালে ছিল দেড় কোটি টাকা। ব্যবসা থেকেও আয় কমে ১৬ লাখ থেকে ১৪ লাখে নেমেছে।
তাজুল ইসলাম এবার সংসদ সদস্য হিসেবে সম্মানী দেখিয়েছেন ১৫ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। ২০১৮ সালে উল্লেখ করেছিলেন ২৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা। ফিশিং ও পোলট্রি (মাছ ও মুরগি) খাতে আয় বেড়ে ৪৩ লাখ থেকে ৫১ লাখে দাঁড়িয়েছে। ২০১৪ সালে এই খাতে তার আয় ছিল না।
অস্থাবর সম্পদের ক্ষেত্রে তাজুল ইসলাম বিনিয়োগ বাড়িয়েছেন বন্ডে, যার পরিমাণ ৮০ কোটি টাকা। ৫ বছর আগে যা ছিল ৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা। সঞ্চয়পত্র বা স্থায়ী আমানতে বিনিয়োগেও বড় লাফ দেখা গেছে। ২০১৮ সালে যেখানে ৬১ লাখ টাকার বিনিয়োগ ছিল, এখন তা দাঁড়িয়েছে ৬ কোটি ৭৩ লাখে। ২০১৪ সালে ছিল ৩৩ লাখ।
তবে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ কমিয়ে ৫ বছরে ১৬ কোটি ৬৬ লাখ থেকে ৫ কোটি ২৩ লাখে নামিয়েছেন। মন্ত্রীর হাতে নগদ টাকাও কমেছে। ২০১৮ সালে যেখানে তার হাতে ১ কোটি ৩১ লাখ টাকা ছিল, এখন তা দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ৫২ হাজারে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তার জমা টাকা আছে ১ কোটি ২৩ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে ছিল ৩ কোটি ৮৯ লাখ।
মন্ত্রী তাজুল ইসলামের থাকা গাড়ির মোট মূল্য ৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। ২০১৪ সালে তার ১ কোটি ৮৯ লাখ টাকা মূল্যের একটি জিপ ও একটি কার ছিল, যা তিনি ২০১৮ সালেও উল্লেখ করেছিলেন।
২০১৮ সালের হলফনামায় তাজুল ইসলাম ৭ দশমিক ৬৭ একর কৃষিজমি থাকার কথা বলেছিলেন, যার অর্জনকালীন মূল্য ছিল ২০ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। এবার তিনি জানিয়েছেন, তার ১ কোটি ৫১ লাখ টাকা মূল্যের কৃষিজমি আছে। তবে এবার তিনি জমির পরিমাণ উল্লেখ করেননি।
মন্ত্রীর দালান, বাড়ি, চা বাগান, রাবার বাগান ও মৎস্য খামারের আর্থিক মূল্য ২০ কোটি ৪ লাখ টাকা। ২০১৮ সালে যার পরিমাণ ছিল ৬ কোটি ৫৭ লাখ টাকা এবং ২০১৪ সালে ছিল ২ কোটি ৬৭ লাখ। তিনি ২০১৮ সালে ৮ দশমিক ৬৭ একর অকৃষি জমি থাকার কথা উল্লেখ করেছিলেন। এবার তা নেই।
তাজুল ইসলাম হলফনামায় অগ্রিম বাড়িভাড়া বাবদ নেওয়া ৪ কোটি ৯ লাখ টাকাকে দায় হিসেবে দেখিয়েছেন। ২০১৮ সালে সাউথ ইস্ট ব্যাংকে তার ঋণ ছিল ৬ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। এবার সেই ঋণ নেই।