বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
কৌশল বদল করে সক্রিয় অসাধু কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেট

তবুও দালালমুক্ত হয়নি পাসপোর্ট অফিস

গাফফার খান চৌধুরী
  ২১ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
তবুও দালালমুক্ত হয়নি পাসপোর্ট অফিস

দালালমুক্ত হয়নি ঢাকার আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিস। আগের মতো অফিসের সামনে অবস্থান না করে কৌশল বদলে সেবাগ্রহীতার ছদ্মবেশে কাস্টমারদের টার্গেট করছেন তারা। পাসপোর্টের অফিসের উল্টো দিকে থাকা বাজার থেকে পরিচালিত হচ্ছে তাদের কার্যক্রম। এদের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন পাসপোর্ট অফিসের অসাধু কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেট।

সোমবার দুপুরে আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের সামনে সেবাগ্রহীতার বেশে অবস্থান নেওয়ার পরই দেখা মিলল দালালের। খানিকটা এদিক সেদিক তাকানোর পরই দালালদের নজরে পড়ে গেলাম। অনেকটা আলাপের ছলে কাছে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, ভাই কাউকে খুঁজছেন। হঁ্যা সূচক জবাব দিতেই বললেন, তার সঙ্গে কি যোগাযোগ হয়েছে? যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। মোবাইলে পাচ্ছি না। এমনটা বলার পরই আনুমানিক পঁয়ত্রিশ বছর বয়সি সেই দালাল সক্রিয় হয়ে উঠলেন। বললেন, তাকে হয়তো আর পাবেন না। পেলেও অনেক সময় লাগবে। আমি সময় কম থাকার বিষয়টি জানানোর পরই দালালের সক্রিয়তা যেন দ্বিগুণ বেড়ে গেল। বলল, 'ভাই তো কোনো খোঁজখবরই রাখেন না, দেখছি।'

কারণ জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বললেন, রোববার শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা পাসপোর্ট অফিসের দালালদের ধরতে অভিযান চালিয়েছে। ছাত্রদের হাতে এক দালাল আটকও হয়েছে। ছাত্ররাই সেই দালালকে সেনা সদস্যদের হাতে দিয়েছেন। এরপর থেকেই সব ফাঁকা। ভয়ে আর দালালরা আসছেন না।

আপনার পরিচয় কি? জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমার বাসা এখানেই। দীর্ঘ সময় ধরে পাসপোর্ট অফিসের কাছাকাছি বসবাস করার কারণে অফিসের অনেককেই চিনি। তবে দালাল না। অনেকেই আছেন, যারা নতুন নতুন পাসপোর্ট অফিসে আসেন। কোনো কিছু সম্পর্কেই ধারণা থাকে না। তাদের সাধ্যমত সহযোগিতা করি।' এজন্য কোনো পারিশ্রমিক নেন কিনা? জানতে চাইতেই তিনি বলেন, 'যদি কেউ খুশি হয়ে দেয়, নেই। যদি কোনো কাজ থাকে নিশ্চিন্তে দিতে পারেন। শতভাগ নিশ্চয়তার সঙ্গে করে দিব।' তিনি যে নামটি বললেন সেটি ছদ্মনাম বলে মনে হলো।

তিনি বলেন, 'রাস্তার উল্টো দিকের বাজারে কম্পিউটারের দোকানগুলোতে গেলে হয়তো আপনি যাকে খুঁজছেন, তাকে পেয়ে যেতে পারেন। তার কথা মতো, সেই বাজারে গিয়েও তাকে পাওয়া গেল না। তবে বাজারের কম্পিউটারের দোকানদারগুলো ওই ব্যক্তির মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তাদের ধারণা ছিল, কাস্টমার ধরে নিয়ে এসেছে। আজ তাকে না পেলে পরে তার সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা বলে সেখান থেকে সরে যাই।'

সেখান থেকে ফিরে পাসপোর্ট অফিস সংলগ্ন ফুটপাতে দাঁড়িয়ে মাঝ বয়সি ওই ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, যে ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয়েছে তিনি একজন দালাল। ছাত্রদের অভিযানের মুখে দালালরা কাস্টমারের মতো ছদ্মবেশ ধারণ করেছে।

তিনি বলছিলেন, পাসপোর্ট অফিসে প্রচন্ড ভিড়। মনে হচ্ছে, পুরো দেশের মানুষ বিদেশ চলে যাচ্ছে। কারণ জানতে চাইতেই তিনি বলেন, 'আমার ধারণা পাসপোর্টের জন্য ভিড় করা ব্যক্তিদের অধিকাংশই কোনো রাজনৈতিক দলের মাঝারি গোছের ও মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মী। অজানা আতঙ্কে তারা হয়তো দেশ ছাড়ার চেষ্টা করছেন।'

তিনি আরও বলেন, এমন সুযোগটিকে পুরোপুরি কাজে লাগাচ্ছে পাসপোর্ট অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা। তারা সুযোগ বুঝে সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে অনৈতিকভাবে বাড়তি সুবিধা নিচ্ছেন। চাহিদা মোতাবেক সুবিধা না দিলেই নানা ঝামেলা করছেন। বিশেষ করে ফরম ঠিকমতো পূরণ হয়নি। আবার ফরম পূরণ করুন। ফরমের সঙ্গে যুক্ত ছবি ও কাগজপত্রে যতসামান্য ভুল থাকলেই তা বাতিল করে দিচ্ছেন। কর্মকর্তারা রীতিমতো রাগারাগি করছেন। বলছেন, কীভাবে ফরম পূরণ করেছেন, এত ভুল কেন। অমুক জায়গা থেকে ফরম পূরণ করে নিয়ে আসুন। আবার অনেক সময় বলছেন, 'পাসপোর্ট সম্পর্কে জানাশোনা কোনো লোকের মাধ্যমে ফরম পূরণ করে নিয়ে আসুন। তার অর্থ স্পষ্ট, অর্থাৎ দালালের মাধ্যমে ফরম পূরণ করে নিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছেন কর্মকর্তারা।'

তিনি বলছিলেন, 'অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যেহেতু ক্ষমতায় আর আমি দরিদ্র মানুষ। যতসামান্য শিক্ষিতও বটে। তাই ভাবলাম নিজে নিজেই পাসপোর্ট করি। খরচ কম হবে। এখানে এসে আমার ধারণা পাল্টে গেছে। দেখলাম নিজে পাসপোর্ট করতে যে পরিমাণে ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে, তার চেয়ে ভালো কিছু টাকা বেশি দিয়ে দালালের মাধ্যমে ফরম পূরণ করা।'

তিনি আরও বলেন, 'সেজন্য বাইরে এসে একজন দালালের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। দালালরা আমার গতিবিধি দেখেই বুঝতে পেরেছেন। একজন দালালের সঙ্গে কথাও হয়েছে। কিছু টাকা বেশি লাগবে। আর কিছুই করতে হবে না। বারবার পাসপোর্ট অফিসেও দৌড়াতে হবে না। শুধুমাত্র ফিঙ্গার প্রিন্ট দেওয়ার সময় আসতে হবে। এরপর দালালই পাসপোর্ট সংগ্রহ করে আমাকে দিয়ে দিবেন।'

তিনি আক্ষেপ করে বলছিলেন, 'পাসপোর্ট অফিসের কিছু কর্মকর্তার পেট কোনোদিনই ভরবে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় থাকার পরও এবং ছাত্রদের অভিযানের মুখেও দালালমুক্ত হয়নি পাসপোর্ট অফিস। কোনোদিনই হবে না। কারণ পাসপোর্ট অফিসের নিম্ন থেকে মাঝারি সারির অধিকাংশ কর্মকর্তার সিন্ডিকেট আছে। সেই সিন্ডিকেটের সঙ্গে দালালরা জড়িত। তাদের সঙ্গে আছে পুলিশের কিছু অসাধু কর্মকর্তা। মাঠপর্যায়ে ভেরিফিকেশন করতে গেলে চাহিদা মোতাবেক টাকা না দিলেই পুলিশের বিশেষ শাখার মাঠপর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তা নেগেটিভ রিপোর্ট দিয়ে দেন। আর রিপোর্ট নেগেটিভ হলে পাসপোর্ট হবে না। পুরো চক্রে পাসপোর্ট অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা, পুলিশের কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও দালালরা জড়িত।

প্রসঙ্গত, বহু বছর ধরে পাসপোর্ট অফিস ঘিরে সক্রিয় দালাল চক্র। চক্রের শত শত সদস্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ করের্ যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে। তারপরও দালালমুক্ত হয়নি আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিস।

সবশেষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও বাজার মনিটরিং থেকে শুরু করে অনেক কিছুই করছে ছাত্রসমাজ।

গত ১৮ আগস্ট তারই ধারাবাহিকতায় দুর্নীতি নিরসনে পাসপোর্ট অফিসে দালালদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায় শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সে সময় সেবাপ্রার্থীরা পাসপোর্ট অফিসে নানা অনিয়ম-দুর্নীতি ও হয়রানির চিত্র তুলে ধরেন। এ সময় ছাত্ররা মনসুর আহম্মেদ নামে এক দালালকে ধরে সেনাবাহিনীর হাতে সোপর্দ করেন।

আটক মনসুরের দাবি, পাসপোর্ট অফিসের নিরাপত্তাকর্মী কাইয়ুম, গাড়িচালক রানা, মিন্টু, আশরাফুল, জসীম, জাহাঙ্গীরসহ প্রায় তিনশ' জনের একটি চক্র রয়েছে। তাদের সঙ্গে জড়িত পাসপোর্ট অফিসের বিভিন্ন লেবেলের অসাধু কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেট। দুই সিন্ডিকেট মিলে নানাভাবে সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে বেআইনিভাবে বাড়তি টাকা হাতিয়ে নেয়। পাসপোর্ট অফিসের উল্টো দিকে থাকা স্টেশনারি, ফটোকপি ও কম্পিউটারের দোকানগুলোর মালিকরাও ওই চক্রের সদস্য।

এসব বিষয়ে পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. নূরুল হুদার সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও, তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে