বিদু্যৎ ও জ্বালানি খাত
বিশেষ আইনে নেওয়া চলমান প্রকল্পের কার্যক্রম স্থগিত
প্রকাশ | ২০ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি রিপোর্ট
বিদু্যৎ ও জ্বালানি সরবরাহ আইন ২০১০ আইনের আওতায় বাস্তবায়িত সব প্রকল্প ও চুক্তি অব্যাহত থাকলে এই আইনের আওতায় চলমান প্রকল্পের কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে। বিদু্যৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, এই বিশেষ আইনের অধীনে চলমান সব ধরনের নেগোসিয়েশন, প্রকল্প যাচাই বা প্রক্রিয়াকরণ এবং ক্রয় পরিকল্পনাকরণ কার্যক্রম আপাতত বন্ধ থাকবে। তবে এ আইনের অধীনে এরই মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির আওতায় গৃহীত সব কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। এ বিষয়ে উপদেষ্টা পরিষদকে অবহিত করে নেওয়া হবে পরবর্তী সিদ্ধান্ত।
জ্বালানি বিশ্লেষকরা বলছেন, শেখ হাসিনার শাসনামলে বিদু্যৎ ও জ্বালানি খাতের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত দেশের জ্বালানি খাতে বিপুল পরিমাণ আর্থিক দেনা তৈরি করেছে। বিদায়ী সরকারের শেষ সময়ে বিদু্যৎ খাতে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা এবং জ্বালানি খাতে ১৪ হাজার কোটি টাকার বেশি বকেয়া পড়েছে। এসব দায়দেনা তৈরি হয়েছে সরকারের অনৈতিক সুবিধা ও অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে। ফলে বিদু্যৎ খাত ঘুরে দাঁড়াতে হলে আওয়ামী লীগ শাসনামলে যেসব চুক্তি হয়েছে সেগুলো রিভিউ করে দেখতে হবে বলে জানান তারা।
বিদু্যৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বিশেষ বিধানের আওতায় আগে যেসব চুক্তি হয়েছে সেগুলো পর্যালোচনা করা হবে। তবে এ আইনের আওতায় যেসব প্রকল্প চলমান সেগুলোর কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।
তিনি বলেন, 'বিশেষ বিধানের অধীনে চলমান সব কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। আগে যেসব চুক্তি করা হয়েছে সেগুলো পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। যেহেতু চুক্তি হয়ে গেছে তাই চাইলে তা বাতিল করা যাবে না। এজন্য আইনগত দিক খতিয়ে দেখতে হবে।'
বিশেষ আইনটি বাতিলের প্রসঙ্গে উপদেষ্টা বলেন, 'এজন্য উপদেষ্টা পরিষদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তবে যে সিদ্ধান্তই নেওয়া হোক তাতে জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন থাকবে।'
বিশেষ আইনে নেওয়া বিভিন্ন প্রকল্প
২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বিদু্যৎ ও জ্বালানি খাতে বিশেষ আইনের আওতায় শুধু বিদু্যৎ খাতে ৯১টি নতুন বিদু্যৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হয়। দেশে ১৫৪টি বিদু্যৎকেন্দ্রের মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ হয়েছে এ আইনে। বিশেষ করে ২০১০ ও ২০১১ সালের দিকে বিদু্যৎ খাতের রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদু্যৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছিল এ আইনের আওতায়।
এছাড়াও আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিভিন্ন ব্যবসায়িক গোষ্ঠী দুই ও পাঁচ বছরমেয়াদি এসব বিদু্যৎকেন্দ্রের মেয়াদ ১০ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত বাড়িয়ে নিয়েছে। সাবেক বিদু্যৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের সংসদে দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, গত দেড় দশকে বিদু্যৎ খাতে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দেওয়া হয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১০টি কোম্পানি সবচেয়ে বেশি ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়ে গেছে। এর মধ্যে রয়েছে সামিট গ্রম্নপ, ইউনাইটেড গ্রম্নপ, ব্যাংলা ক্যাট, আরপিসিএল, কেপিসিএল, মোহাম্মদী গ্রম্নপের মতো প্রতিষ্ঠান। তারা ক্যাপাসিটি পেমেন্ট বাবদ অন্তত ৪৪ হাজার কোটি টাকার বেশি নিয়ে গেছে।
আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকে গ্যাসভিত্তিক চারটি বিদু্যৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলোর সক্ষমতা অন্তত ২ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। গ্যাসের অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও এসব বিদু্যৎকেন্দ্র অনুমোদন দেওয়া হয়েছে ২০১৮-২০ সালের মধ্যে। বর্তমানে এসব কেন্দ্র উৎপাদন না করলেও বিপুল পরিমাণ ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে হচ্ছে।
দেশে জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদু্যৎকেন্দ্রের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক সৌর বিদু্যৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এর প্রায় ডজনখানেক বিদু্যৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে গত দুই বছরে। বিশেষ আইনের আওতায় কোনো ধরনের প্রতিযোগিতা ছাড়াই এসব বিদু্যৎকেন্দ্র নির্মাণ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এসব বিদু্যৎকেন্দ্রের বিদু্যৎ ক্রয় চুক্তি হয়েছে প্রতিবেশী দেশ ভারতের তুলনায় অন্তত তিন গুণ বেশি দরে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যেসব সৌর বিদু্যৎকেন্দ্র অনুমোদন দেওয়া হচ্ছে সেগুলোর ইউনিট প্রতি দাম ১১ থেকে ১২ টাকার নিচে নয়।
জ্বালানি খাতের গ্যাসের সংকট কাটাতে সদ্য বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকার বেশ কয়েকটি এলএনজি আমদানি চুক্তি ও এলএনজি অবকাঠামো নির্মাণে চুক্তি সই হয়। এর মধ্যে গত বছরের জুনে অর্থনৈতিক ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে দেশের তৃতীয় এলএনজি নির্মাণে কাজ পায় সামিট গ্রম্নপ। ৫০০ এমএমসিএফডি ক্ষমতাসম্পন্ন টার্মিনালটির যদিও এখন পর্যন্ত মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকার দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি সরবরাহের চুক্তি করে মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেটের সঙ্গে। বিশেষ বিধানের আওতায় দেশে গ্যাস অনুসন্ধানে ৪৮টি কূপ খননের প্রকল্পও বাস্তবায়িত হচ্ছে। তবে এখানেও চীন ও রাশিয়ার কোম্পানিগুলোকে স্থানীয় কোম্পানি বাপেক্সের চেয়ে দুই থেকে তিনগুণ বেশি দামে কাজ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন 'বিশেষ আইনের আওতায় বিদু্যৎ ও জ্বালানির চলমান প্রকল্প স্থগিত রাখা হয়েছে এটি ভালো উদ্যোগ। তবে আইনটির আওতায় যেসব কাজ হয়েছে এখন সেগুলো যৌক্তিকতা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। তাহলে জনসাধারণ জানতে পারবে এগুলোর বিদু্যৎ খাতে আর্থিক সফলতা রয়েছে কিনা।'