হাওড়ে হারুনের শত কোটি টাকার 'প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট'
প্রকাশ | ১৯ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
মন্তোষ চক্রবর্তী, হাওড়াঞ্চল (কিশোরগঞ্জ)
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ। 'ডিবি হারুন' নামেই বেশি পরিচিত তিনি। আলোচিত-সমালোচিত পুলিশের এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জালিয়াতি করে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরি নেওয়াসহ অবৈধভাবে সম্পদের পাহাড় গড়ার অভিযোগ উঠেছে।
হারুন তার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের মিঠামইনে শত কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তুলেছেন 'প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট' নামে অত্যাধুনিক ও বিলাসবহুল একটি প্রমোদাগার। স্থানীয়রা জানান, এই রিসোর্টে রয়েছে হেলিপ্যাড ও অত্যাধুনিক সুইমিং পুল। হেলিকপ্টারে ও বিলাসবহুল গাড়ি করে প্রতিদিনই রাজনৈতিক নেতা ও বিত্তশালীরা এখানে আসতেন। রিসোর্টটি তাদের আনন্দ-ফুর্তির নিরাপদ স্থান হয়ে উঠেছিল।
জানা গেছে, কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে হারুনের জন্ম। ২০তম বিসিএসের মাধ্যমে ২০০০ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় পুলিশে চাকরি পান তিনি। অথচ তার বাবা মো. হাসিদ ভূঁইয়া মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
২০১১ সালের ৬ জুলাই সংসদ ভবনের সামনে তৎকালীন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ বিএনপি নেতা জয়নুল আবদীন ফারুককে মারধর করে আলোচনায় আসেন তৎকালীন ডিএমপির তেজগাঁও জোনের ডিসি (অতিরিক্ত উপ-কমিশনার) হারুন। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আস্থা কুড়ান তিনি। এরপর তাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। একের পর এক পদোন্নতি পেয়ে পুলিশের প্রবল প্রতাপশালী কর্মকর্তা বনে যান হারুন।
মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামে ৪০ একরেরও বেশি জায়গা নিয়ে গড়ে তোলা হয় 'প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট'। এর প্রিমিয়াম সু্যটের প্রতিদিনের ভাড়া ২০ হাজার টাকা। সর্বনিম্ন ডিলাক্স রুমের ভাড়া প্রতিদিন ১০ হাজার টাকা। ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর রিসোর্টটি উদ্বোধন করা হয়। প্রেসিডেন্ট রিসোর্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তার ছোট ভাই ডা. শাহরিয়ার।
রিসোর্টটিতে হারুনের পরিবারের ৫-৭ একর জায়গা রয়েছে। বাকি অন্তত ৩৫ একর জায়গা অন্যদের। প্রতারণা করে এসব জমি দখলে নেন হারুন। জায়গার মালিকদের কেউই প্রকৃত দাম পাননি। কেউ ১০ লাখের মধ্যে এক লাখ, কেউ ২০ লাখের মধ্যে ২ লাখ এই হারে টাকা পেয়েছেন। দাম না পাওয়ায় এখনো অন্তত ১০-১২ জন তাদের জমি রেজিস্ট্রি করে দেননি। তাদেরই একজন মিঠামইন সদর ইউনিয়নের গিরীশপুর গ্রামের দিলীপ কুমার বণিক। তিনি জানান, হারুন রিসোর্টের কথা বলে তার এক একর ১০ শতাংশ জায়গা নিয়েছেন। জমির কোনো দরদামও নির্ধারণ করা হয়নি। তাকে ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। অথচ জমির দাম হবে অন্তত ২০ লাখ টাকা। তিনি বলেন, আমার মতো এমন অন্তত আরও ১২ জন রয়েছেন, যাদের নামমাত্র টাকা দিয়ে জমি নিয়ে গেছে হারুন।
প্রেসিডেন্ট রিসোর্টের পশ্চিম দিকে অষ্টগ্রাম উপজেলা পরিষদের সাবেক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোস্তাক আহাম্মেদ কমল যায়যায়দিনকে বলেন, 'আমার ছয় একরের একটি পুকুর সাবেক ডিবি প্রধান হারুন দখল করে মাছ চাষ করছেন। এ নিয়ে প্রতিবাদ করলে নানাভাবে হুমকি দেওয়া হয়েছে।'
তিনি জানান, তার খাদের চারপাশে আরও ১৮-১৯ একর জমি হারুনের দখলে রয়েছে। হারুনের বাঁধের ভেতর পড়েছে তার আরও প্রায় সাত একর জমি। এ ছাড়া বায়না দলিল সূত্রে পাওয়া তার ১২ একর জমি হারুন দখল করে নিয়েছেন। জমিগুলো অষ্টগ্রামের খলাভাঙ্গুরাইল মৌজার।
কমলের অষ্টগ্রামের বাড়িতে বসে আলাপকালে তিনি সাংবাদিকদের বেদখল হওয়া জমির দলিলপত্র এবং নকশায় দাগ-খতিয়ান চিহ্নিত করে দেখান।
ভুক্তভোগী কলম সরকারের কাছে হারুনের অবৈধ সম্পদ বাজেয়াপ্তের পাশাপাশি নিরীহ কৃষকদের জমি উদ্ধার করে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান।
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভু্যত্থানের পর থেকে রিসোর্টটিতে দর্শনার্থীদের প্রবেশ বন্ধ রাখা হয়েছে। তবে রিসোর্টে বুকিং চালু রয়েছে।
জানা যায়, চার ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় হারুন। দ্বিতীয় জিয়াউর রহমান মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উপ-পরিদর্শক। তৃতীয় জিলস্নুর রহমান পুলিশের ইনস্টেক্টর হিসেবে কর্মরত। হারুন কিশোরগঞ্জের আজিমউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং গুরুদয়াল সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানে অনার্স করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন।