সাজিদকে চোখের পানিতে বিদায় জানালেন সতীর্থরা

প্রকাশ | ১৭ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

জোবায়েদ মলিস্নক বুলবুল, টাঙ্গাইল
অবশেষে মৃতু্যর কাছে হার মানতে হলো ইকরামুল হক সাজিদকে। কোটা আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বর এলাকায় ৪ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হন তিনি। তার মাথার পেছনে গুলি লেগে ডান চোখ ভেদ করে বের হয়ে যায়। আহত অবস্থায় ১০ দিন মৃতু্যর সঙ্গে লড়াই গত বুধবার মারা যান সাজিদ। বৃহস্পতিবার তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামসহ জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তা, কোটা আন্দোলনের শিক্ষার্থী-শিক্ষক ও তার স্বজনরা চোখের পানিতে বিদায় জানিয়েছেন তাকে। টাঙ্গাইল থেকে ৬০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে ধনবাড়ী উপজেলার বিলকুকরী গ্রামের বিমানবাহিনীর সাবেক মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার জিয়াউল হকের ছেলে তিনি। সাজিদ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। বৃহস্পতিবার সকালে গ্রামের বাড়িতে সাজিদের মরদেহ দাফন করা হয়েছে। এর আগে বাঐজান স্কুল মাঠে তার তৃতীয় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এতে ডাক, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম, জেলা প্রশাসক মো. কায়ছারুল ইসলাম, পুলিশ সুপার গোলাম সবুর, ধনবাড়ী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আ. ওয়াদুদ তালুকদার (সবুজ), ইউএনও মোস্তাফিজুর রহমান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাসহ ধনবাড়ী উপজেলার বিভিন্ন স্তরের মানুষ এবং সাজিদের আত্মীয়স্বজনরা অংশ নেন। তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম সাজিদের বাড়ি গিয়ে স্বজনদের সমবেদনা জানান। তিনি বলেন, 'আজকে সাজিদদের এই আত্মত্যাগের কারণে আমরা নতুন স্বাধীনতা পেয়েছি। তার আত্মত্যাগ দেশের মানুষ, ছাত্রসমাজ কোনো দিন ভুলবে না। খুনিদের বিচার এই বাংলার মাটিতে অবশ্যই করা হবে। অবশ্যই তাদের কঠোরতম শাস্তির আওতায় আনবই।' নিহত সাজিদের বাবা জিয়াউল হক বিমানবাহিনীর চাকরি থেকে অবসরের পর ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তিনি বলেন, 'সাজিদ বলেছিল, কয়েক মাস পর স্নাতকোত্তর ডিগ্রিটা হয়ে যাবে। তারপর চাকরি হলেই আমাকে আর কিছু করতে দেবে না। বাবাকে বিশ্রাম দিয়ে পুরো সংসারের দায়িত্ব নেবে। সেই সাজিদ চিরবিশ্রামে চলে গেল।' জিয়াউল হক আরও বলেন, 'পড়াশোনার পাশাপাশি সাজিদ ঢাকায় টিউশনি করত। গ্রামের সব আত্মীয়স্বজনকে একদিন নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতে চেয়েছিল। ওর কথামতো স্বজনদের তালিকাও করেছিলাম, কিন্তু আর খাওয়ানো হলো না।' সাজিদের মামা আব্দুর রাজ্জাক জানান, সাজিদ ঢাকায় বেড়ে উঠলেও গ্রামের সব শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। বাড়িতে এলেই সবার সঙ্গে সময় কাটাতো। সর্বশেষ মাসখানেক আগে সাজিদ বাড়িতে এসেছিল। সাজিদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, একটি কক্ষে বিলাপ করছেন তার মা লিপি বেগম। স্বজনেরা তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। কিন্তু কিছুতেই তাকে শান্ত করা যাচ্ছে না। তিনি চিৎকার করে বলছিলেন, 'আমার সাজিদের নাম মিশা গেল গো..., আমি দুনিয়ায় কেমনে বাঁচমু গো...। আমারে আর কেউ মা বইলা ডাকব না গো...। মাথায় হাত বুলাইয়া আদর করব না গো...।' সাজিদের বড় বোন ফারজানা হক (৩০) জানান, কোটা আন্দোলনে শুরু থেকেই সাজিদ ছিলেন সক্রিয়। ৪ আগস্ট ঢাকার অবস্থা ছিল উত্তাল। তাই বাসা থেকে বের হতে বাধা দিতে চেয়েছিলেন মা। কিন্তু সাজিদ বাধা মানবেন না জানতেন তারা। তাই বাধা না দিয়ে মা গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, সাবধানে থাকতে। এদিন বেলা আড়াইটার দিকে সাজিদ কাফরুলের বাসা থেকে বের হন। সন্ধ্যায় তার বন্ধুরা ফোনে জানান সাজিদ গুলিবিদ্ধ হয়ে সিএমএইচে আছেন। তার মাথার পেছন দিক দিয়ে গুলি লেগে ডান চোখ ভেদ করে বের হয়ে গেছে। ওই রাতেই তার অস্ত্রোপচার হয়। তারপর ১০ দিনেও জ্ঞান ফেরেনি। বুধবার দুপুরে মৃতু্যর কাছে হেরে যায় সে।