বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে ব্যাহত হয় পণ্য পরিবহণ। সরবরাহ সংকটের প্রভাব পড়ে বাজারে। ধীরে ধীরে সেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। তবে নিত্যপণ্য নিয়ে অস্বস্তি এখনো কাটেনি। সপ্তাহের ব্যবধানে দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। চালেও ফেরেনি স্বস্তি।
অন্যান্য নিত্যপণ্যের দামে খুব বেশি হেরফের না হলেও বাজারে বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হলেও চালের দাম কমেনি। আন্দোলনের সময় চালের দাম কেজিপ্রতি ২-৪ টাকা বেড়েছিল, এখনো তেমনই রয়েছে।
শুক্রবার সকালে রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি ভালো মানের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকা দরে। যা আগে চেয়ে ১০ টাকা বেশি তবে ভারত থেকে আমদানি করা কিছু পেঁয়াজ এখনো ১০০ থেকে ১১০ টাকায় কেনা যাচ্ছে। যদিও ভারতীয় পেঁয়াজের মান দেশি পেঁয়াজের চেয়ে কিছুটা নিম্ন।
শুক্রবার ঢাকার কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গত কয়েক সপ্তাহ ধরে চালের চড়া দাম এখনো একই অবস্থায় রয়েছে। বাজারে মিনিকেট ৭০ থেকে ৭২ টাকা, নাজিরশাইল ৭০ টাকা ৭৫, পাইজাম ৫৮ টাকা থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। যা আগের চেয়ে ৪ থেকে ৫ টাকা বাড়তি। মোটা চাল স্বর্ণা বিক্রি হচ্ছে ৫৫-৫৬ টাকায়।
সেগুনবাগিচা শিমুল রাইস এজেন্সির জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ছাত্রদের আন্দোলনের সময় পরিবহণ বন্ধ থাকায় মোকামে প্রতি বস্তায় চালের দাম ২০০ টাকা বেড়েছে। এরপর তা এখনো কমেনি। প্রধান এ খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ায় সীমিত আয়ের মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত। সবচেয়ে বেশি নাজেহাল দরিদ্র মানুষ। লোকমান নামে একজন ক্রেতা বলেন, সবজির দাম কমেছে, ডিম-মুরগিরও কমেছে। কিন্তু চালের দাম কমে না। আসলে সিন্ডিকেট করে একবার দাম বাড়ালে আর কমানো হয় না।
ছোট ব্যবসায়ীরা বলছেন, পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা তথা মিল ও পাইকারি পর্যায়ে তদারকি করলে জিনিসপত্রের দাম কমতে পারে।
রামপুরা বাজারের চাল বিক্রেতা ইউনুস হোসেন বলেন, এখন পরিবহণ ব্যবস্থা স্বাভাবিক। পণ্য আনা-নেওয়ায় কোনো সমস্যা হচ্ছে না। তবু কোনো কারণ ছাড়াই মিলাররা চালের দর বাড়িয়েছেন। সরকার মিলগুলোয় তদারকি করলে দাম কমে আসবে।
চাল-পেঁয়াজে অস্বস্তি থাকলেও গত এক সপ্তাহ ধরে বাজারে সবজির দাম কিছুটা কমছে। সর্বনিম্ন ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে পেঁপে, ১৫-২০ দিন আগে পেঁপের কেজি ছিল ৭০ টাকা। একইভাবে পটল, ঢেঁড়শ, চিচিঙ্গা কেনা যাচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে। এতদিন এসব সবজির দাম ছিল ৭০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত।
বাজারে সর্বোচ্চ ৭০ টাকা দেখা গেছে বরবটি, বেগুন ও শসার কেজি। সপ্তাহ তিনেক আগেও এসব সবজির কেজি ১৫০ টাকা ছুঁয়েছিল। কাঁচা মরিচের কেজি কোথাও ২০০ আবার কোথাও ২৪০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।
বর্ষায়ও মিলছে না ইলিশ
এদিকে বরিশাল নগরীর পোর্টরোড মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে বর্ষার এ সময় ৪০০-৫০০ মণ ইলিশ আসত প্রতিদিন। শ্রমিকদের দম ফেলার ফুরসত থাকত না আড়তে। কিন্তু এবারের চিত্র ভিন্ন। প্রায় এক মাস ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলেও দিনে ৫০ মণ ইলিশও আসছে না এই মৎস্য আড়তে।
যদিও মৎস্য অধিদপ্তর দাবি করেছে, নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় কেজি সাইজের ইলিশের দাম কমেছে ১ হাজার টাকা। ভারতে রপ্তানির সুযোগ বন্ধ হওয়ায় বৃষ্টি বাড়লে পাড়া মহলস্নায় সচরাচর ইলিশ পাওয়া যাবে। দাম আরও কমার সম্ভাবনা রয়েছে।
পোর্টরোড মৎস্য আড়তদার মালিক সমিতির সদস্য ইয়ার হোসন বলেন, ২৩ জুলাই ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়েছে। এরপর প্রায় এক মাস হতে চললেও জেলেরা নদী-সমুদ্রে কাঙ্ক্ষিত ইলিশ পাচ্ছে না। তাই আড়তেও মাছ আসছে না। নদীর পানি দূষণ, বৈরী আবহাওয়ার কারণে মাছ আসছে না। তারপরও আমরা আশা করছি বৃষ্টি আরও বাড়লে মাছ বাড়তে পারে। মাছ না পাওয়া গেলে জেলেরা যেমন ঋণী হবেন তেমনি আমাদেরও লোকসান গুনতে হবে।
ক্রেতা মকবুল হোসেন বলেন, আষাঢ়-শ্রাবণ শেষ হয়ে এখন ভাদ্র মাস চলছে। এখনো ইলিশের দামে আগুন। আজকে ইলিশ কিনতে এসে দেখি নিষেধাজ্ঞার সময় যে দামে বিক্রি হতো তেমনি বিক্রি হচ্ছে। প্রতি বছর যে টিভি-পত্রিকায় দেখি ইলিশের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েছে- তাহলে সেই ইলিশ কোথায়?
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, পাইকারি বাজারে প্রতি মণ এলসি সাইজের ইলিশ ৬০ হাজার, এক কেজির ইলিশ ৬৫ হাজার, ৫০০-৬০০ গ্রামের ইলিশ ৫৩ হাজার, জাটকা ৩৪ হাজার টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে রূপাতলী, বাংলাবাজার ও নতুনবাজার ঘুরে দেখা গেছে, ৫০০ গ্রামের ইলিশ ১২৫০ থেকে ১৩০০, ৮০০-৯০০ গ্রামের ইলিশ ১৬০০, এক কেজির ইলিশ ১৭৫০, দেড়কেজি ২২০০-২৩০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
ইলিশ বিক্রেতা আরাফাত হোসেন বলেন, আড়তে মাছ না আসায় কেজিতে ১০০ থেকে দেড়শ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। মাছের দাম নির্ভর করে মাছ আসার ওপর। পরশু দিন আড়তে ১২টি ট্রাক এসেছিল। সেদিন কম ছিল। আজকে ৫টি ট্রাক এসেছে। মাছ নাই তাই দামও বেড়েছে।
ক্রেতা ইকবাল হোসেন বলেন, ফেসবুকে দেখলাম শিক্ষার্থীরা দাম কমিয়ে দিয়েছে। এসে দেখি দাম আগের মতোই আছে। খুচরা বাজারে জাটকার কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ৮৫৯ টাকায়। অন্য ইলিশের দাম জিজ্ঞেস করিনি। জাটকার দাম এত হওয়ায় তেলাপিয়া কিনে বাসায় ফিরছি।
মৎস্য আড়তদার আক্তার হোসেন বলেন, ইলিশের ভরা মৌসুমেও মাছ না থাকায় লোকসান গুনছি। মাছের ট্রলার, জেলে সব মিলিয়ে যে টাকা খাটিয়েছি তা কিছুই উঠছে না। বাজারে মাছের দাম অনেক বেশি।
বরিশাল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রিপন কান্তি ঘোষ বলেন, মাছের উৎপাদন ঠিকই আছে। সমস্যা হচ্ছে সড়ক যোগাযোগ উন্নত হওয়ায় এখন আর আড়তে আসতে হয় না জেলেদের। যেমন মেহেন্দীগঞ্জ, হিজলা, ভোলার জেলেরা মাছ ধরে হয় ঢাকা না হয় চাঁদপুরে নিয়ে যায়। আবার বরগুনা, পটুয়াখালী এলাকার জেলেরা সড়ক পথে সরাসরি ঢাকায় পাঠাচ্ছে। এজন্য স্থানীয় বাজারগুলোয় চাহিদার বেশি ইলিশ সরবারহ হচ্ছে না।
তিনি বলেন, মে মাসে এক কেজি ওজনের ইলিশ কিনেছি ২৪৮৫ টাকায়। নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ায় তা বিক্রি হচ্ছে ১৬০০-১৭০০ টাকায়। দাম কিন্তু কমেছে প্রায় এক হাজার টাকার কাছাকাছি। এ ছাড়া পরিবেশের হেরফেরের কারণে বর্ষার ব্যাপ্তি হয়েছে অক্টোবর মাস পর্যন্ত। ভারী বর্ষণ হলে ইলিশও প্রচুর ধরা পড়বে। জেলেদের হতাশ হওয়ার দরকার নেই। সরকার ঘোষণা দিয়েছে ইলিশ বিদেশে পাঠানো কমিয়ে আনার জন্য। এতে স্থানীয় বাজারগুলোয় ইলিশ পাওয়া যাবে।