প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক কুমার ঘটকের পৈতৃক বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। রাজশাহী নগরীর মিয়াপাড়ায় এই পৈতৃক বাড়িতে শৈশব-কৈশোর ও তারুণ্যের একটি সময় কাটিয়েছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ঋত্বিক ঘটক। বাড়িটি সংরক্ষণের উদ্যোগের মধ্যেই গত কয়েকদিন আগে ভেঙে ফেলা হয়েছে। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ দেশের সাংস্কৃতিককর্মীরা।
জানা গেছে, এই বাড়িতে থাকার সময় ঋত্বিক ঘটক রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল ও রাজশাহী কলেজে পড়াশোনা করেছেন। তাকে ঘিরে তখন রাজশাহীতে সাহিত্য ও নাট্য আন্দোলন বেগবান হয়েছিল। তার পরিবার কলকাতা চলে যাওয়ার পর ১৯৮৯ সালে তৎকালীন এরশাদ সরকার এই বাড়ির ৩৪ শতাংশ জমি রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজকে ইজারা দিয়েছিল।
এরপর জায়গাটির উত্তরে গড়ে তোলা হয়েছে হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজের আধুনিক ভবন। এই ভবনের দক্ষিণ অংশে ঋত্বিক ঘটকের স্মৃতিবিজড়িত পুরনো বাড়ির ঘরগুলো দাঁড়িয়ে ছিল। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর হোমিওপ্যাথিক কলেজের অধ্যক্ষ আনিসুর রহমান পুরনো স্থাপনাগুলো ভেঙে ফেলেছেন বলে অভিযোগ সাংস্কৃতিককর্মীদের।
তারা জানান, ঋত্বিকের বাড়িটি ভেঙে ফেলে জায়গাটি অন্য কাজে ব্যবহারের চেষ্টা কলেজ কর্তৃপক্ষ আগেও করেছে। বার বার বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন সাংস্কৃতিককর্মীরা। ২০২০ সালে সাইকেল গ্যারেজ তৈরির জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষ ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক বাড়ি ভেঙে ফেলছে- এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম
সোসাইটি, রাজশাহী ফিল্ম সোসাইটি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ এবং বরেন্দ্র ফিল্ম সোসাইটি। প্রতিবাদলিপি পাঠান ১২ চলচ্চিত্র নির্মাতা। এ ছাড়া চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফসহ ১১ জন নির্মাতা ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক বাড়ি ভেঙে ফেলার প্রতিবাদে বিবৃতি দেন।
এরপর সংস্কৃতি-বিষয়ক মন্ত্রণালয় বাড়িটি সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়। মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসনের মতামত চায়। করণীয় নির্ধারণে জেলা প্রশাসন একটি কমিটিও করে। সেই কমিটির সদস্যরা বাড়িটি পরিদর্শন করে ঋত্বিক ঘটকের পরিবারের ব্যবহৃত বাড়ির অক্ষত অংশ এবং একটি কুয়া চিহ্নিত করেন। জেলা প্রশাসন পুরনো বাড়িটি আগের অবস্থায় সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এর মধ্যেই গত কয়েকদিন আগে বাড়িটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
এ খবর ছড়িয়ে পড়লে বুধবার দুপুরে রাজশাহীর সাংস্কৃতিককর্মীরা বাড়িটি সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত দেওয়া কাগজপত্র নিয়ে বাড়িটিতে যান। এ সময় কলেজ কর্তৃপক্ষ তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করলে হট্টগোল শুরু হয়। পরে অধ্যক্ষের কক্ষ থেকে বেরিয়ে সাংস্কৃতিককর্মীরা জেলা প্রশাসকের কাছে যান।
সাংস্কৃতিককর্মী আন্নাবা কবির বলেন, 'অধ্যক্ষ এখন ছাত্রদের ওপর দায় চাপাচ্ছেন। ছাত্ররা ভাঙলে কলেজের নতুন ভবনেও ভাঙচুর চালাতেন। সেখানকার একটি জানালার কাঁচও ভাঙেনি। অথচ ঋত্বিক ঘটকের বাড়ির পুরোটাই গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা কি করে সম্ভব! ছাত্ররা ভাঙলে সবকিছুতেই ভাঙচুর করতেন।'
রাজশাহী হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ আনিসুর রহমান দাবি করেন, ৬ আগস্ট কিছু ছাত্র এসে প্রথমে বাড়িটি ভাঙতে শুরু করে। তাদের কয়েকজনকে তিনি চেনেন। যারা ভাঙছিলেন, তিনি তাদের পরিচয় জানতে চেয়েছিলেন। তখন তারা জানান, তারা শ্রমিক এবং কিছু ছেলে তাদের টাকা দিয়েছেন এটা ভেঙে ফেলার জন্য। জায়গাটি নিয়ে কলেজের পরিকল্পনা থাকলেও বাড়িটি নিজেরাই ভাঙার অভিযোগ অস্বীকার করেন অধ্যক্ষ।
জেলা প্রশাসক শামিম আহমেদ বলেন, 'সাংস্কৃতিককর্মীরা আমার কাছে এসেছিলেন। ঋত্বিক ঘটকের পৈতৃক বাড়িটি ভেঙে ফেলার কথা শুনলাম। আমি অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (শিক্ষা ও আইসিটি) তদন্ত করে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলেছি। যারাই এই বাড়ি ভাঙুক, তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বাড়িটির যা অবশিষ্ট আছে, তা সংরক্ষণ করা হবে।'