দেশে গমের উৎপাদন ও চাহিদায় বড় ফারাক
গমের উৎপাদন বৃদ্ধিই বড় চ্যালেঞ্জ * আমদানিতে ব্যয় হচ্ছে ডলারের বড় অংশ
প্রকাশ | ১৩ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
আলতাব হোসেন
গম দেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশস্য। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ভোক্তার খাদ্য তালিকায় গম তথা আটা-ময়দা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে আয়ের পাশাপাশি ভূমিকা রাখছে স্বাস্থ্যসচেতনতা। দেশে বছরে গমের চাহিদা কমবেশি ৭০ লাখ টন। আর দেশে উৎপাদিত গমের পরিমাণ ১০ থেকে ১২ লাখ টনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাই দেশে গমের চাহিদা মেটানোর প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে আমদানি। যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে গমের দাম বৃদ্ধি রেকর্ড ভাঙছে। আমদানি করতে ব্যয় হচ্ছে বিপুল ডালার। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য মতে, বিশ্বের যে কয়টি দেশে সবচেয়ে দ্রম্নত হারে গমের আমদানি বাড়ছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়।
গমের আটা-ময়দা থেকে তৈরি বিস্কুট, কেক, ইত্যাদি শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রপ্তানি হচ্ছে ভারত, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। বেকারিজাতীয় পণ্য, যেমন- পাউরুটি, বিস্কুট, কেকসহ নানা ধরনের পণ্য তৈরি হয় আটা ও ময়দা থেকে। এর ফলে আটা ও ময়দার চাহিদা প্রতিনিয়তই বাড়ছে। দেশে গমের চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশই বেকারি, হোটেল ও রেস্তোরাঁগুলোয় ব্যবহার হয়। এ জন্য গত বছরও প্রায় ৪০ লাখ টন আমদানি করা হয়।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) তথ্য অনুসারে সর্বশেষ গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে গমের উৎপাদন হয়েছে ১১ লাখ ৭১ হাজার টন, যা ২০২১-২২ সালে ১০ লাখ ৮৬ হাজার টন। এর আগের বছর ২০২০-২১ অর্থবছরে ছিল ১০ লাখ ৮৫ হাজার টন। ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে দেশে গমের উৎপাদন হয়েছিল ১৯ লাখ ৮ হাজার টন। এটি এ পর্যন্ত বাংলাদেশে গমের সর্বোচ্চ উৎপাদন। এর পর থেকে গমের উৎপাদন কমতে থাকে এবং ২০০৬-০৭ অর্থবছরে উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়ায় ৭ লাখ ২৫ হাজার টনে। (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা, ২০২৪)।
মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের ফলে গমের বহুবিধ ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। তবে চাহিদা বাড়লেও সে অনুপাতে উৎপাদন বাড়ছে না। বরং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে গম উৎপাদনের জমি কমে আসছে। ফলে গমের উৎপাদন বৃদ্ধিই বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিচ্ছে। দেশে উৎপাদন কম হওয়ায় চাহিদার প্রায় পুরোটাই পূরণ করতে হয় আমদানির মাধ্যমে। বর্তমানে ডলার সংকট থাকায় গম আমদানিতে ভাটা পড়েছে। এতে বাড়ছে আটার দামও। আটার অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে বেকারি ব্যবসা সীমিত হচ্ছে। এক বছরের ব্যবধানে আটার দাম দ্বিগুণ হয়েছে। টিকে থাকার লড়াই করলেও আটার দাম না কমলে শত শত কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
মানুষের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের ফলে গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ভাতের পরিবর্তে অনেকে রুটি খাচ্ছেন। এ ছাড়াও আটা ও ময়দা দিয়ে নানা জাতের বিস্কুট, কেকসহ অনা্যন্য বেকারি পণ্য তৈরি হচ্ছে। এসব পণ্য তরুণদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। তবে বাংলাদেশ রুটি-বিস্কুট ও কনফেকশনারি প্রস্তুতকারী সমিতির তথ্য বলছে, আটা ও ময়দার অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে তাদের উৎপাদিত পণ্যের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে।
দেশে খাদ্যশস্যের তালিকায় চালের পরের অবস্থানে অর্থাৎ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে গম। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেনডিচার সার্ভে ২০২৩ অনুযায়ী জাতীয় পর্যায়ে মাথাপিছু দৈনিক গমের ব্যবহার দাঁড়িয়েছে ২২ দশমিক ১১ গ্রামে। ২০০৫ সালে এ পরিমাণ ছিল ১২ দশমিক ১ গ্রাম। ২০১৬ সালে তা ছিল ১৯ দশমিক ৮ গ্রাম। গমের ব্যবহার বৃদ্ধির কারণ হচ্ছে-খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন ও স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধি। সময়, আয় ও জীবনযাত্রার মানের পরিবর্তনের দোলা খাদ্যাভ্যাসেও লেগেছে।
কৃষিবিদ ড. শহীদুল আলম বলেন, দেশে গমের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন হয় দীর্ঘ শীতকাল। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে শীতের সময় কমে যাচ্ছে। দীর্ঘ হচ্ছে গরমের মৌসুম। এ কারণে দেশে গমের উৎপাদন বৃদ্ধি বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। এ ছাড়া এখন গমের বদলে কৃষকরা ভুট্টা, আলু এবং স্বল্পমেয়াদি সবজি চাষ করে বেশি লাভবান হচ্ছেন। এতে কমছে গম চাষের জমির পরিমাণ। গম চাষে শ্রমিক সংকট, ইঁদুরের উপদ্রব, মাড়াইয়ের সমস্যা এবং ভালো বীজের অভাব উৎপাদন বৃদ্ধি না হওয়ার একটি বড় কারণ। সম্প্রতি দেশে গমের বস্নাস্ট রোগ দেখা দিয়েছে। এতে উৎপাদিত গমের ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ক্ষতি হয়। পরের মৌসুমে এই জমিতে অন্য ফসলও কম হয়। এসব ঝামেলার কারণে গম চাষে চাষিরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।
গমের উৎপাদন বৃদ্ধি বিষয়ে কৃষিবিদ সামসুল আলম বলেন, গম উৎপাদনে একটি মহাপরিকল্পনা নিতে হবে। এতে চাষের জমি বাড়াতে হবে। উৎপাদন বাড়াতে পারলে আমদানি ব্যয় কমবে। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও চীনে হেক্টরপ্রতি গম উৎপাদনের হার আমাদের দেশের চেয়ে বেশি। চীনে এ হার ৫ দশমিক ৪ টন। ভারতে সাড়ে তিন টন। আমাদের দেশে তা তিন টনের কিছুটা ওপরে। এখনই উন্নত ব্রীজ আমদানি করে গমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে গম উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে। এজন্য উষ্ণ আবহাওয়া সহনশীল গমের জাত উদ্ভাবন করতে হবে। এ ছাড়া গম ভালো হয় দেশের এমন অঞ্চলে গম চাষ বাড়াতে হবে। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল গম চাষের উত্তম স্থান হতে পারে। উত্তরাঞ্চলে দেশের অন্য সব অঞ্চল থেকে দীর্ঘ হয়ে থাকে শীতের প্রকোপ। গম চাষ করা কৃষকদের উন্নতমানের গমবীজ, সার ও কীটনাশক সরবরাহসহ আর্থিক প্রণোদনা দিতে।
কৃষিবিদ আবুল হাশেম চৌধূরী বলেন, আমদানিনির্ভরতায় আমাদের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে, আমাদের রিজার্ভ কমছে। গমের মতো একটি প্রধান খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধি বিষয়ে সরকারকে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। গমচাষি কৃষকদের বিশেষ প্রণোদনা দিতে হবে। তা না হলে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে খাদ্যনিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। দিনের পর দিন বিশ্বে যুদ্ধ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনিতে গমের দাম রেকর্ড ভাঙছে। আগামীদিনে টাকা থাকলেও বিশ্ববাজার থেকে বাংলাদেশ গম কিনতে হিমশিম খেতে হতে পারে। উচ্চ দামের কারণে হয়তো গম কেনা সম্ভব না-ও হতে পারে। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বব্যাপী গম সরবরাহ এখন উলেস্নখযোগ্য মাত্রায় চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।