সীমান্তে নিরাপত্তা টহল জোরদার
ফের রোহিঙ্গা ঢলের আশঙ্কা!
নাফ নদ ও সমুদ্রসৈকতে ভেসে এলো ৪৪ মরদেহ. অনুপ্রবেশের অপেক্ষায় থাকা ২শ' রোহিঙ্গা ড্রোন হামলায় নিহত
প্রকাশ | ১২ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি ডেস্ক
ছাত্র-জনতার তুমুল আন্দোলনে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর দেশে সৃষ্ট অস্থিরতার সুযোগ নিয়েছেন সীমান্তের কিছু দালাল। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের রয়েছে, এরা টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের নাফনদী পাড়ি দিয়ে এদেশে ঢুকতে সহযোগিতা করেছেন। আর এদিনই মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ক্যাম্প থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় থাকা রোহিঙ্গাদের ওপর ঘটে ড্রোন হামলা। এ হামলায় অন্তত ২০০ মানুষের মৃতু্যর খবর পাওয়া গেছে। হতাহত হয়েছেন অনেক মানুষ। নিহতদের মধ্যে পরিবারের সঙ্গে থাকা শিশুরাও আছে। সংঘাতপূর্ণ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর এটিই সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলা বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্লেষকরা।
এদিকে এ হামলার ঘটনার পর রোববার পর্যন্ত রাখাইন থেকে সহিংসতার মুখে পালিয়ে বাংলাদেশে আসার পথে নৌকাডুবির ঘটনায় নাফ নদ ও সমুদ্র সৈকতে শিশুসহ ৪৪ জন রোহিঙ্গার মৃতদেহ ভেসে এসেছে। স্থানীয় জেলেরা জীবিত উদ্ধার করেছে এক নারীসহ দুজনকে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়েছে, রাখাইনের মংডুতে বাংলাদেশ সীমান্ত-সংলগ্ন এলাকায় রোহিঙ্গাদের ওপর ড্রোন হামলায় অনেক মানুষ হতাহত হওয়ার ঘটনার পর আবারও দেখা দিয়েছে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কা। এ পরিস্থিতিতে অনুপ্রবেশ রুখতে টেকনাফ সীমান্তে টহল জোরদার করেছে বিজিবি। নাফ নদ-স্থলপথ অতিক্রম করে রোহিঙ্গারা যাতে টেকনাফ বা সেন্টমার্টিনে ঢুকতে না পারে, সেজন্য চলছে অতিরিক্ত নজরদারি ও টহল।
স্থানীয়রা জানান, ৫ আগস্ট সোমবার রাখাইন থেকে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় মংডুতে থাকা পরিবারগুলোর ওপর ড্রোন হামলা চালানো হয়। সীমান্তের এপার থেকে থাকা বিকট শব্দ শুনেছেন। হামলায় সময় সীমান্তবর্তী টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন কেঁপে ওঠে। এতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সীমান্তের বাসিন্দাদের মধ্যে। এর আগে উপকূল দিয়ে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছেন বলেও জানিয়েছেন টেকনাফ সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম রয়টার্সের কাছে চারজন প্রত্যক্ষদর্শী, মানবাধিকার কর্মী ও একজন কূটনীতিক এই ড্রোন হামলার বর্ণনা দিয়েছেন বলে সংস্থাটি এক প্রতিবেদনে উলেস্নখ করেছে। তারা জানিয়েছেন, যারা হামলা থেকে বেঁচে গেছেন তারা মৃতদেহের স্তূপের মধ্যে নিহত ও আহত স্বজনদের খুঁজে বেড়াচ্ছেন। হামলায় নিহতদের মধ্যে একজন গর্ভবতী নারী ও তার দুই বছর বয়সি মেয়েও আছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোয় রাখাইন রাজ্যে জান্তা সেনা ও বিদ্রোহীদের মধ্যে চলা লড়াইয়ের মধ্যে জানামতে বেসামরিকদের ওপর হওয়া সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলা এটাই।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগ, দেশের আইনশৃঙ্খলার নাজুক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কিছু দালাল টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের নাফনদী পাড়ি দিতে সহযোগিতা করেছেন। টেকনাফে গত ৫ আগস্ট রাতে দালালের মাধ্যমে অনুপ্রবেশকালে শাহপরীর দ্বীপের কাছাকাছি রোহিঙ্গা বোঝাই দুটি ট্রলারডুবির ঘটনায় রোববার পর্যন্ত ৪৪ রোহিঙ্গার মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া জীবিত এক নারীসহ দু'জনকে উদ্ধার করেছে স্থানীয় জেলেরা।
বিজিবি ও কোস্টগার্ড কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা সামান্যই। রোহিঙ্গা বোঝাই অনেক নৌকাকে অনুপ্রবেশে বাধা দেওয়া হয়েছে এবং অনেক রোহিঙ্গাদের পুশব্যাক করা হয়েছে। গত ৫ আগস্ট ছাত্র আন্দোলনের মুখে সরকার পতনের পরপরই অস্থিরতা তৈরির সুযোগ নেন রোহিঙ্গারা।
বিভিন্ন সূত্র দাবি করেছে, মিয়ানমারের রাখাইনে গোলাগুলি ও সংঘর্ষ বেড়ে যাওয়ায় সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন রোহিঙ্গারা। তবে তারা যাতে ঢুকতে না পারে, সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক পাহারায় রয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এরপরও নাফ নদীর ওপারে অর্ধশতাধিক নৌকায় দুই হাজারের বেশি রোহিঙ্গা অপেক্ষায় রয়েছে।
ড্রোন হামলা প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে তিনজন রয়টার্সকে জানিয়েছেন, আরাকান আর্মি এই হামলার জন্য দায়ী। তবে আরাকান আর্মি হামলার দায় অস্বীকার করেছে। আরাকানের এই বিদ্রোহী বাহিনী ও মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ওই হামলার জন্য একে অপরকে দোষারোপ করেছে। হামলাটি কারা চালিয়েছে বা হামলায় কতজন নিহত হয়েছেন, স্বতন্ত্রভাবে তা যাচাই করতে পারেনি এই সংবাদমাধ্যমটি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করা ভিডিওতে দেখা গেছে, কাদার মধ্যে লাশের পর লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাদের সু্যটকেস ও ব্যাকপ্যাক চারপাশে পড়ে রয়েছে। বেঁচে যাওয়া তিনজন জানিয়েছেন, প্রায় ২০০ জনেরও বেশি নিহত হয়েছেন। ঘটনার অপর প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, তিনি অন্তত ৭০টি মৃতদেহ দেখেছেন।
রয়টার্স ভিডিওগুলোর স্থান যাচাই করে ঘটনাটি মিয়ানমারের উপকূলীয় শহর মংডুর ঠিক বাইরে ঘটেছে বলে নিশ্চিত হয়েছে। তবে কবে ভিডিওগুলো ধারণ করা হয়েছে রয়টার্স তা নিশ্চিত হতে পারেনি। প্রত্যক্ষদর্শী মোহাম্মদ ইলিয়াস (৩৫) জানান, হামলায় তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ও দুই বছর বয়সি মেয়ে গুরুতর আহত হওয়ার পর মারা যায়। উপকূলে জড়ো হওয়া লোকজনের ওপর ড্রোন হামলা শুরুর সময় তিনি স্ত্রী-সন্তানকে পাশে নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।
রোহিঙ্গা শিবির থেকে ইলিয়াস রয়টার্সকে জানান, তিনি একাধিক গোলাবর্ষণের বিকট শব্দ শুনতে পেয়েছেন। আত্মরক্ষার জন্য তিনি মাটিতে শুয়ে পড়েছিলেন, যখন উঠে দাঁড়ান তখন দেখেন তার স্ত্রী ও মেয়ে গুরুতর আহত আর অনেক আত্মীয় মরে পড়ে আছেন। প্রাণে বেঁচে যাওয়া ইলিয়াস প্রাণপণ চেষ্টার পর একটি নৌকা খুঁজে বের করে বাংলাদেশে পৌঁছাতে সক্ষম হন।
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী শামসুদ্দিন (২৮) জানান, তিনি স্ত্রী ও নবজাতককে নিয়ে বেঁচে ফিরেছেন। তিনিও বাংলাদেশের একটি শরণার্থী শিবির থেকে বলেন, হামলার পর অনেকে মরে পড়ে ছিল আর কিছু মানুষ তাদের আঘাতের যন্ত্রণায় চিৎকার করছিল।
রয়টার্স আরও জানায়, আরাকান আর্মি রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে দখল করে নেওয়ার পর থেকে কয়েক সপ্তাহ ধরে ফের দেশ ছাড়তে শুরু করেছে রোহিঙ্গারা। রাখাইনের উত্তরাঞ্চলে বিশাল সংখ্যক মুসলিম জনগোষ্ঠী রয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো রাখাইনের সাম্প্রতিক সহিংসতার নিন্দা জানিয়েছে এবং জাতিসংঘে কানাডার রাষ্ট্রদূত রোহিঙ্গা মৃতু্যর প্রতিবেদন নিশ্চিত করেছেন।
টেকনাফ সীমান্তে স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, বিজিবি ও কোস্টগার্ড কার্যত অনুপ্রবেশ ঠেকাতে পারছে না। নাফ নদীতে কড়া নজরদারি ও পাহারা থাকলেও দেশের চলমান পরিস্থিতির সুযোগে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশ করছে বাংলাদেশে।
টেকনাফ সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান সাংবাদিকদের জানান, ছাত্র আন্দোলনের মুখে সরকার পতনের পরপরই দেশে অস্থিরতা তৈরির সুযোগ নেন সীমান্তের কিছু দালাল। ৫ থেকে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ করতে সুযোগ করে দিচ্ছে তারা। সরকার পতনের দিন সোমবার সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশকালে বোট ডুবে ৩১ রোহিঙ্গার মরদেহ ভেসে আসে। এ সময় দুইজকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। নাফ নদীতে এখনো হাজার হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের অপেক্ষা করছে।
টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপ পর্যন্ত ৭১ কিলোমিটার জল-স্থলপথে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বিজিবি সীমান্তে টহল বৃদ্ধি করা হয়েছে জানিয়ে বিজিবি টেকনাফ-২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, 'সীমান্তে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের খবরে বেশ কয়েকটি পয়েন্টে নজরদারি ও টহল বাড়ানো হয়েছে। তবে নতুন করে কেউ অবৈধভাবে প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য আমরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছি। এ ছাড়া স্থানীয় জেলেদের রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ করতে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে বিজিবিকে জানাতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া দেশের চলমান পরিস্থিতিতে সাম্প্রদায়িক সংঘাত রোধ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে বিজিবির বিশেষ টহল অব্যাহত রয়েছে।'
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনের মুখপাত্র জানিয়েছেন, তাদের সংস্থা 'বঙ্গোপসাগরে দু'টি নৌকা উল্টে শরণার্থীদের মৃতু্যর বিষয়ে তারা জ্ঞাত আছেন' এবং মংডুতে বেসামরিকদের মৃতু্যর প্রতিবেদনগুলো দেখেছেন কিন্তু কোন পরিস্থিতিতে ঘটনাটি ঘটেছে বা কতজনের মৃতু্য হয়েছে তা নিশ্চিত হতে পারেননি।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ওপর দেশটির সামরিক বাহিনী ব্যাপক দমনপীড়ন শুরু করলে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা, যারা মূলত মুসলিম, সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী গণহত্যার অভিপ্রায় নিয়ে তাদের ওপর দমন-পীড়ন চালিয়েছে বলে জাতিসংঘের।
২০২১ সালে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে মিয়ানমারের সামরিক ক্ষমতা দখলের পর পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ ও বিস্তৃত সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু হয়। এই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর একটি হলো আরাকান আর্মি।