এ যেন নতুন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। পুলিশবিহীন রাজধানীর সড়কে শুক্রবার ছুটির দিনও ট্রাফিক সেবার দায়িত্ব পালন করেছেন ছাত্র-জনতা। সড়কে শতভাগ শৃঙ্খলা ফেরাতে কোন ধরনের যানবাহন সড়কের কোন লেনে চলাচল করবে, সেটি নির্ধারণের কাজ করছেন তারা। এজন্য নিজেদের টাকায় রং কিনে সড়কের লেন মার্কিংয়ের কাজ করছেন। এমনকি লেনগুলোতে কোন ধরনের যানবাহন কি পরিমাণ গতিতে চলাচল করবে, সেই গতিসীমাও নির্ধারণ করে দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে সতর্ক করা হচ্ছে হেলমেটবিহীন চালকদেরও।
সরেজমিন শুক্রবার ঢাকার বিভিন্ন ব্যস্ত সড়ক ঘুরে দেখা গেছে এমন চিত্র। দুপুরে আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের সামনে যেতেই কয়েক ছাত্র থামিয়ে দিলেন। তারা জানালেন ডান পাশের লেন ছেড়ে মাঝ বরাবর লেন দিয়ে যেতে। যদিও তারা কারণ হিসেবে শুধু বললেন, ডান পাশের রাস্তায় কাজ চলছে। যে কারণে আপাতত লেনটি দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। এজন্য তারা আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছেন চালকদের কাছে। অন্যান্য চলন্ত যানবাহনের চালকদেরও ইশারা করে ছাত্ররা এমনটাই জানাচ্ছিলেন।
আগারগাঁও চৌরাস্তা মোড়ে যাওয়ার অন্তত ৫শ' গজ আগেই দেখা গেল, সরকারিভাবে রাস্তার মাঝ বরাবর রং দিয়ে লেন মার্কিংয়ের উপর কয়েকটি ফুলের টব রাখা। টবের খুঁটির সঙ্গে রশি বেঁধে তা সড়ক বিভাজকের সঙ্গে আটকিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আরেকটু সামনে এগুতেই দেখা গেল, চৌরাস্তা ছাত্র-ছাত্রীরা সাদা রং দিয়ে লেন মার্কিংয়ের কাজ করছেন। একই সঙ্গে জেব্রা ক্রসিং অর্থাৎ রাস্তার যেসব জায়গা দিয়ে মানুষ হেঁটে পার হবেন, সে জায়গাটিও মার্কিং করছেন ছাত্ররা। কয়েক জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কোন লেনে কোন ধরনের গতির যানবাহন চলাচল করবে, পর্যায়ক্রমে সেটিং মার্কিং করে দেওয়া হবে। প্রয়োজনে সেইসব যানবাহনের নাম ও ছবি লেনের মাঝখান দিয়ে এঁকে দেওয়া হবে। এছাড়া কোন লেনের যানবাহনে গতি কোথায় কত হবে, তা নির্ধারিত করে দেওয়া হবে।
প্রসঙ্গত, যদিও এমন লেন মার্কিং অনেক আগেও ট্রাফিক বিভাগের তরফ থেকে করা হয়েছিল। কিন্তু দীর্ঘ দিন সড়কে লেন মার্কিংয়ের জন্য নতুন করে রং করা হয়নি। এছাড়া যত্রতত্র যানবাহন থামানোর কারণেও সড়কের অনেক জায়গার রং উঠে গেছে। তবে সম্প্রতি করা কিছু সড়কে লেন মার্কিং করে দেওয়া আছে। তাও বাসের জন্য। যেটি মূলত রিকশা লেন বরাবর। বাকি কোনো লেনেই কোনো ধরনের নির্দেশক অর্থাৎ কোন লেনে কোন ধরনের যানবাহন চলাচল করবে, সে সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা বা চিহ্ন নেই। এছাড়া এসব লেনের মার্কিংয়ের রং উঠে গেছে। অধিকাংশ সড়কেই বোঝার উপায় নেই, কোন লেনে কোন ধরনের যানবাহন চলাচল করবে। এজন্য নতুন করে রং দিয়ে পুরানো লেন মার্কিং আবার নতুনভাবে করছেন ছাত্ররা।
এমন উদ্যোগের ব্যাপক প্রশংসা করছিলেন চলাচলকারী যানবাহনের যাত্রী ও চালকরা। একাধিক চালক বলেন, এভাবে থাকলে যানবাহনের ভাড়াও কমে যাবে। কারণ আগে মিরপুর থেকে যাত্রীবাড়ি পর্যন্ত যেতে অন্তত ১০ জায়গায় চাঁদা দিতে হতো। এখন কোন চাঁদাবাজ নেই। এমনকি পরিবহণ সেক্টরের চাঁদাবাজরাও ছাত্র-জনতার ভয়ে পালিয়ে গেছে। এজন্য দ্রম্নত যানবাহনের ভাড়া কমে যাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এমন অবস্থা যেন সারাজীবন থাকে, সেই প্রত্যাশাও করেন চালকরা।
দেখা গেছে, চালকদের নিয়ম মেনে গাড়ি চালাচ্ছেন। যেসব লোকাল কোনোদিনই ট্রাফিক আইন মানত না, সেসব বাসও সুশৃঙ্খলভাবে চলাচল করছে। শুধু তাই নয়, মোটর সাইকেল চালকরাও শতভাগ নিয়ম মেনে চলছেন। এমন চিত্র দেখা গেছে সব যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রেই।
দেখা গেল, চন্দ্রিমা উদ্যান থেকে বিজয় সরণি দিয়ে ফার্মগেট ও বিজয় সরণি চৌরাস্তা মোড়ের দিকে যাওয়ার রাস্তাও লেন মার্কিংয়ের প্রস্তুতি চলছে। সড়কের যেসব স্থানে রাস্তা ভাগ হয়ে ভিন্ন ভিন্ন পথে যানবাহনের যাওয়ার কথা, সেখানে অনেক আগ থেকেই আপাতত ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত পস্নাস্টিকের সড়ক বিভাজক ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে তারও আগে ছাত্রদের দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে।
আরও দেখা গেছে, ছাত্ররা চালকদের আগে থেকেই যেসব যানবাহন যে রাস্তায় যাবে, সেসব যানবাহনের চালকদের নির্দিষ্ট লেনে থাকার অনুরোধ করছেন। বিজয় সরণি চৌরাস্তা মোড়ে আগে প্রায়ই দেখা যেত, বাম দিকের রাস্তা পুরোপুরি ট্রাফিক আইন অমান্য করে যানবাহন গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। এখন আর সে অবস্থা নেই। অনেক দূর থেকেই ছাত্ররা রশি টাঙিয়ে দিয়ে সড়ক বিভাজনের ব্যবস্থা করেছেন। ছাত্ররা অনেক আগ থেকেই যার যার লেন মেনে চলার কথা জানিয়ে দিচ্ছেন।
ঢাকার অনেক রাস্তায় হ্যান্ড মাইক ব্যবহার করছেন ছাত্ররা। মাইক দিয়ে যানবাহন চালকদের নির্দিষ্ট লেনে নির্ধারিত গতিতে গাড়ি চালানোর অনুরোধ করছেন। যাদের হেলমেট নেই, তাদের হেলমেট না থাকার কারণ জিজ্ঞাসা করছেন। সন্তোষজনক জবাব দিলে তাদের সম্মানের সঙ্গে ছেড়ে দিচ্ছেন। আর যারা সন্তোষজনক জবাব দিতে পারছেন না, তাদের হেলমেট কিনে রাস্তায় চলাচল করার অনুরোধ করছেন। ছাত্রদের এমন ব্যবহারে মুগ্ধ যাত্রীরা।
ঢাকার রাস্তা ঘুরে দেখা গেছে, ছাত্ররা প্রচন্ড রোদের মধ্যেও দায়িত্ব পালন করছেন অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে। রোদ আর গরমের কারণে পালাক্রমে দায়িত্ব পালন করছেন তারা। এমন কঠোর পরিশ্রমের পর শুধু একটি সস্তা পাউরুটি, একটি কলা আর আধা লিটারের এক বোতল পানি দিয়ে দুপুরের খাবার সারতে দেখা গেছে ছাত্রদের। ছাত্রদের এমন কষ্টে সহমর্মিতা জানাতে অনেক দামি দামি গাড়ি থেকেও অনেককেই ছাত্রদের খাবার দেওয়ার চেষ্টা করতে দেখা গেছে। কিন্তু ছাত্ররা তা অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করছেন। বলছেন, আপনাদের আন্তরিকার জন্য ধন্যবাদ। দয়া করে সড়কে ট্রাফিক আইন মেনে চলবেন, তাতেই আমরা খুশি।
এমন চিত্র দেখা গেছে, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ, টোলারবাগ, মিরপুর-১ নম্বর গোলচত্বর, চাইনিজ, হযরত শাহআলী মার্কেট, লালকুঠি, ৬০ ফুট রাস্তা, রেডিও বাংলাদেশ, জাতীয় রাজস্ব ভবন (এনবিআর), বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি), বিজয় সরণি চৌরাস্তা, নাবিস্কো, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানাধীন সরকারি কোয়ার্টারের সামনেসহ ঢাকার প্রতিটি অলিতে গলিতে।
ছাত্রদের অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা গেছে। এমনকি যানবাহনের চালকরাও ছাত্রদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে অত্যন্ত নিয়মশৃঙ্খলা মেনে সড়কে যানবাহন চালাচ্ছেন। বড় সড়কগুলোতে ছাত্রদের সঙ্গে আনসার এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সদস্যদের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। তবে অধিকাংশ সড়কের মূল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ করেছেন ছাত্ররা।