দীর্ঘদিন ধরে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা উপেক্ষিত রয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর যা আরও স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। প্রায় ১৫ বছরের শাসন আমলে গৃহীত একের পর এক ভুল নীতি, আমদানিনির্ভরতা ও একচেটিয়া সিদ্ধান্ত এই সংকটের প্রধান কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এ অবস্থায় দেশের জ্বালানি খাতে সংকট আরও বাড়তে পারে। পিছিয়ে যেতে পারে গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমের উদ্যোগসহ স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে নেওয়া বিভিন্ন প্রকল্প। আপাতত যেহেতু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ চালাবে তাই নতুন বিনিয়োগও কমে যেতে পারে। অন্যদিকে আমদানি নির্ভরতায় গ্যাস খাতে চরম বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। এতে শিল্প ও বিদু্যৎ উৎপাদন চরম হুমকির মুখে পড়বে বলে মনে করছেন তারা।
জ্বালানি বিশ্লেষক ও ভূতাত্ত্বিক অধ্যাপক বদরুল ইমাম যায়যায়দিনকে বলেন, 'বিগত সরকার দেশের জ্বালানি খাত এমন এক পরিস্থিতিতে ফেলে রেখে গেছে যেখান থেকে নতুন সরকারের জন্য পরিস্থিতি সামাল দেওয়া বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। বিশেষ করে চাহিদা অনুযায়ী জ্বালানির জোগানের নিশ্চয়তা, বিদ্যমান চুক্তি আওতায় জ্বালানি আমদানি ও চলমান প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন কঠিন হতে পারে। এছাড়াও সমুদ্রে ও স্থলভাগে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানসহ জ্বালানি খাতে বিদেশি ও বেসরকারি বিনিয়োগও কমার আশঙ্কা রয়েছে। সবমিলিয়ে সামনের দিনগুলোতে জ্বালানি খাতে সংকটগুলো আরও প্রকট হতে পারে।'
বদরুল ইমাম বলেন, 'আমরা দীর্ঘদিন ধরে সরকারের বিদু্যৎ ও জ্বালানি নীতির সমালোচনা করে আসছি। কিন্তু সরকার তা উপেক্ষা করে একটি আমদানিনির্ভর জ্বালানি খাত তৈরি করা হয়েছে। ফলে বিশ্ব বাজারে অস্থিতিশীলতা বাড়লে দেশের বাজারে তার প্রভাব পরে। অন্যদিকে দেশের আর্থিক পরিস্থিতি আমদানি সহায়ক নেই। তাই এ খাতে বিগত সরকারকে ব্যাপক ঋণ নিতে হয়েছে যা মোকাবিলা করে জ্বালানি সরবরাহ বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে।
এদিকে দেশের বিদু্যৎ ও শিল্প খাত অনেকটাই গ্যাসনির্ভর। ফলে গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতুলস্নাহ। যায়যায়দিনকে তিনি বলেন, নতুন সরকারের জন্য অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। তার মধ্যে অন্যতম বিদু্যৎ ও শিল্প খাতে গ্যাসের সরবরাহ। বর্তমানে বিদু্যতের ৫০ শতাংশই গ্যাসনির্ভর। শেখ হাসিনা সরকার শিল্প খাতে গ্যাসের সরবরাহ কমিয়ে বিদু্যৎ উৎপাদন সচল রাখলেও এখন তেমনটা নাও হতে পারে। কারণ ব্যবসায়ী নেতারা শেখ হাসিনার অনুগত ছিল, তাই সম্ভব হয়েছিল। এবার ব্যবসায়ীরা শিল্প খাতে গ্যাসের সরবরাহ চাইবেন তখন বিদু্যৎ উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। সেক্ষেত্রে সরকারকে গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধি করতে হবে। কিন্তু নিজস্ব গ্যাসের উৎপাদন ক্রমেই কমছে এর বিপরীতে বাড়ছে আমদানিকৃত এলএনজির দাম। এছাড়াও জ্বালানি খাতে সরকারের বকেয়া ও ঋণ পরিশোধেও বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হবে। সব মিলিয়ে সামনে বড় ধরনের ধাক্কা আসছে বিদু্যৎ জ্বালানি খাতে।
পাওয়ার সেলের সাবেক এই কর্মকর্তার মতে নতুন সরকার এসেই এসব সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। প্রথমে তাদের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় পলিসি নির্ধারণ করতে হবে। পরে সে অনুযায়ী কাজ করতে হবে। তা সময় সাপেক্ষ। যদি সময় উপযোগী সিদ্ধান্ত নেওয়া ও বাস্তবায়ন করা যায় তাতেও অন্তত ২ বছর লাগবে জ্বালানির জোগান স্বাভাবিক করতে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি সচিব নুরুল আলম কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে যায়যায়দিনকে বলেন, 'জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিতে কিছু সংকট রয়েছে। বিশেষ করে ধারদেনা পরিশোধের চাপ রয়েছে। তবে সরবরাহকারীদের অনুরোধ করে জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিতে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।'
সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল তা অব্যাহত থাকবে কিনা জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, 'অবশ্য এটা নতুন সরকার গুরুত্ব সহকারে বিচেনা করবে বলেই আমরা আশা করি।'
তবে অধ্যাপক বদরুল ইমামের মতে, পলিটিক্যাল ইনস্টাবেলিটি থাকলে কোনো বিদেশি বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ করতে চাইবে না। বিশেষ করে সমুদ্রে অনুসন্ধান কার্যক্রমে। কারণ এখানে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে হয়। এছাড়াও জ্বালানিতে বিনিয়োগে হাই রিস্ক রয়েছে। তাই সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগ করে থাকে।
তবে গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে সাময়িকভাবে সামগ্রিক সংকট অনেকটাই চলে যাবে সে ক্ষেত্রে নতুন সরকারকে বেশ কিছু কর্মপরিকল্পনা হাতে নিতে হবে বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা। বিডি রহমতুলস্নাহ বলেন, সরকার যদি অভ্যন্তরীণ বিদ্যমান উৎস হতে গ্যাস উত্তোলন বাড়ানোর উদ্যোগ নেয় তাহলে কিছুটা সরবরাহ বাড়বে। পাশাপাশি নতুন কূপ খনন ও উত্তোলনে জোর দিতে হবে। অন্যদিকে বিদু্যৎ উৎপাদনে গ্যাসের বিকল্প যেমন সোলার ও বায়ু বিদু্যৎ খাতে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
এর বাইরে বিদু্যৎ উৎপাদনে গত সরকারের আমলে নেওয়া যেসব প্রশ্নবিদ্ধ চুক্তি রয়েছে তা বাতিল করতে হবে, 'নো ক্যারেন্ট নো পেমেন্ট'-এর আওতায় বিদু্যৎ কিনলে বিশাল অংকের ক্যাপাসিটি চার্য দিতে হবে যা দিয়ে গ্যাস আমদানি বাড়ানো যাবে। এছাড়াও অপারেশন কস্ট ও সিস্টেম লস কমিয়ে আনলে আরও অর্থ সেভ হবে। কেবল সিস্টেম লস মনিটরিং করলেই এর হার ১৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬ শতাংশে আনা সম্ভব। ৮ শতাংশ কমানো গেলে বছরের অন্তত ১০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় কমানো সম্ভব। অন্যদিকে দেশে ডলারের দাম যেহেতু স্থিতিশীল না তাই বিদু্যৎ ক্রয় চুক্তিতে নির্দিষ্ট একটি রেট নির্ধারণ করে ক্রয় চুক্তি করলে ব্যয় আরও কমবে। যা অতীতে কার্যকর ছিল।
এর বাইরে সোলার বিদু্যতের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। বর্তমানে শুধু দিনের ৫ ঘণ্টা সোলার বিদু্যৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়। কিন্তু ব্যাটারি ব্যবহারে তা ১২-২০ ঘণ্টা করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে ব্যাটারি আমদানিতে শুল্ক সুবিধা দেওয়া প্রয়োজন যা বর্তমান বাজেটে নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি শুল্কমুক্ত ব্যাটারি আমদানি করা গেলে সোলারে বিদু্যৎ উৎপাদন বাড়বে এবং রাতেও এর সরবরাহ পাওয়া যাবে। এতে শুল্ক কমলেও সরকার অন্যভাবে দ্গিুণের বেশি অর্থ ব্যয় কমাতে পারবে।
এদিকে জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস পালনের কথা থাকলেও দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় তা বাতিল করা হয়েছে।