জলবায়ুর অভিঘাতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে 'বায়ুমন্ডলীয় নদী'র পরিধি। এর ফলে অসময়ও হচ্ছে অস্বাভাবিক বর্ষণ। ভূ-উপরিভাগে সৃষ্টি হচ্ছে আকস্মিক ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির। এতে প্রাণহানির পাশাপাশি বাস্তু্যচু্যতির হার বাড়ছে। এশিয়ার দেশগুলোতে বিশেষ করে বাংলাদেশ-ভারতে বর্ষা মৌসুমে বন্যা অস্বাভাবিক না হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মৌসুমি বৃষ্টিপাত অনিয়মিত হয়ে অল্প সময়ের মধ্যে হচ্ছে ব্যাপক বৃষ্টিপাত। বিশ্লেষকরা বলছেন, পূর্ব এশিয়ায় বায়ুমন্ডলীয় এই নদীর তীব্রতা বেড়েছে। যে কারণে গত চার দশকে ভারী বৃষ্টিপাতের ঘটনা বেড়েছে চারগুণ। আবার দীর্ঘ সময় ধরে দেখা দিচ্ছে বৃষ্টিহীনতা বা খরা। বাংলাদেশের উজানে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের কারণে বার বার ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নিম্নভূমির এই দেশ।
আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে বায়ুতে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বা আর্দ্রতার পরিমাণ বাড়ছেই। সেই পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে এক ধরনের ঝড়, যাকে বলা হচ্ছে 'বায়ুমন্ডলীয় নদী' বা 'উড়ন্ত নদী'।
বিবিসির সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন জানাচ্ছে, বায়ুমন্ডলীয় এই ঝড় আসলে বিপুল জলীয় বাষ্পের অদৃশ্য ফিতার মতো; যার জন্ম হয় উষ্ণ মহাসাগরে। বাষ্পীভূত পানি ওই অদৃশ্য ফিতার আকারে জড়ো হয় বায়ুমন্ডলে।
জলবায়ু বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলীয় বাষ্প বায়ুমন্ডলের নিচের অংশে অনেকগুলো স্তম্ভ গঠন করে, বাতাসে ভেসে সেগুলো ক্রান্তীয় অঞ্চল থেকে শীতল অক্ষাংশে চলে যায়। পরে তা নেমে আসে বৃষ্টি বা তুষার হিসেবে, যা বন্যা বা মারাত্মক তুষারপাত সৃষ্টির জন্য দায়ী।
গবেষণা অনুযায়ী, এই 'আকাশ নদীগুলো' পৃথিবীর বাতাসে ভাসমান মোট জলীয় বাষ্পের প্রায় ৯০ শতাংশই বহন করে। আর জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বিশ্বের বৃহত্তম নদী আমাজনের স্বাভাবিক পানিপ্রবাহের প্রায় দ্বিগুণ। পৃথিবী দ্রম্নত উষ্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই বায়ুমন্ডলীয় নদীগুলো দীর্ঘ, প্রশস্ত ও তীব্রতর হয়ে উঠছে, যা বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষকে বন্যার ঝুঁকিতে ফেলেছে। ভারত মহাসাগরে উষ্ণায়নের কারণে 'উড়ন্ত নদী' তৈরি হচ্ছে, যা জুন থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে মৌসুমি বৃষ্টিপাতকে প্রভাবিত করছে।
বিজ্ঞান সাময়িকী নেচারে ২০২৩ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ভারতে ১৯৫১-২০২০ সালের মধ্যে বর্ষা মৌসুমে মোট ৫৭৪টি বায়ুমন্ডলীয় নদীর দেখা মিলেছে; সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এ ধরনের চরম আবহাওয়ার ঘটনা বেড়েছে। গত দুই দশকে সবচেয়ে তীব্র বায়ুমন্ডলীয় নদীগুলোর প্রায় ৮০ শতাংশই বন্যা সৃষ্টি করেছে।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ও ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি) গবেষকরা দেখেছেন যে, ১৯৮৫-২০২০ সালের মধ্যে বর্ষা মৌসুমে ভারতের সবচেয়ে ১০টি মারাত্মক বন্যার সঙ্গে সাতটিরই যোগ আছে বায়ুমন্ডলীয় নদীর সঙ্গে। এতে ভাটির দেশ বাংলাদেশই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক দশকগুলোতে ভারত মহাসাগরে বাষ্পীয়ভবন উলেস্নখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। জলবায়ু উষ্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বায়ুমন্ডলীয় নদী ও এর মাধ্যমে বন্যা সৃষ্টির ঘটনাও সম্প্রতি বেড়েছে।
ওই প্রতিবেদনে বিবিসি লিখেছে, এক-একটি বায়ুমন্ডলীয় নদীর দৈর্ঘ্য দুই হাজার কিলোমিটার (১,২৪২ মাইল), প্রস্থ ৫০০ কিলোমিটার এবং গভীর প্রায় তিন কিলোমিটার হতে পারে। এমন নদী এখন আরও প্রশস্ত ও দীর্ঘতর হচ্ছে, কিছু ক্ষেত্রে পাঁচ হাজার কিলোমিটারের বেশি দীর্ঘ নদীও দেখা গেছে। তবে এগুলো খালি চোখে মানুষ দেখতে পায় না।
নাসার জেট প্রোপালশন ল্যাবরেটরির বায়ুমন্ডলীয় গবেষক ব্রায়ান কান বলেন, 'ইনফ্রারেড ও মাইক্রোওয়েভ ফ্রিকোয়েন্সির সঙ্গে এগুলো দেখা যায়। সে কারণেই বিশ্বজুড়ে জলীয় বাষ্প এবং বায়ুমন্ডলীয় নদী পর্যবেক্ষণের জন্য স্যাটেলাইট কার্যকর উপায় হতে পারে।'
কিন্তু বৈশ্বিক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৬০-এর দশক থেকে বায়ুমন্ডলীয় জলীয় বাষ্প ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। বিজ্ঞানীরা দক্ষিণ এশিয়ায় ৫৬ শতাংশ অতি ভারী বৃষ্টি ও তুষারপাতের সঙ্গে বায়ুমন্ডলীয় নদীর যোগসূত্র দেখতে পেয়েছেন। যদিও এই অঞ্চলে গবেষণা হয়েছে সীমিতই। তবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাশের অঞ্চলে বর্ষায় বায়ুমন্ডলীয় নদীর সঙ্গে ভারী বৃষ্টিপাতের যোগসূত্র নিয়ে বিশদ গবেষণা হয়েছে।
আমেরিকান জিওফিজিক্যাল ইউনিয়ন প্রকাশিত ২০২১ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, বর্ষা মৌসুমের শুরুতে (মার্চ-এপ্রিল) পূর্ব চীন, কোরিয়া ও পশ্চিম জাপানে ঝরা ভারী বৃষ্টির ৮০ শতাংশের সঙ্গে বায়ুমন্ডলীয় নদীর সম্পর্ক আছে।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে রয়্যাল মেটিওরোলজিক্যাল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, 'গত চার দশকে ভারতের মেঘালয়-আসাম এবং বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে বর্ষাকালীন বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমতে থাকলেও এক দিনে অতি ভারী বৃষ্টিপাতের ঘটনা চারগুণ বেড়েছে।'
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই অঞ্চলের বৃষ্টিপাতের ধরন পাল্টাচ্ছে, যা সিলেট অঞ্চলে ঘন ঘন আকস্মিক বন্যা সৃষ্টি করছে বলে গবেষণায় বলা হয়েছে। এক দিনে অতি ভারী বৃষ্টিপাত বলতে গবেষণায় ১৫০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাতকে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপকও এক দিনে অতিবৃষ্টির ঘটনা বৃদ্ধিকে সাম্প্রতিক বন্যা ও জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ হিসেবে পর্যবেক্ষণ করেছেন বলে জানিয়েছেন।
২০২২ সালের ১৭ জুন সিলেট অঞ্চলে যে প্রলয়ঙ্করী বন্যা হয়, সেদিন দেশের উজানে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জিতে এক দিনে ৯৭২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছিল।
অন্যদিকে, জার্মানির পটসড্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সারা এম ভালেজো-বার্নাল বলেন, '১৯৪০ সাল থেকে পূর্ব এশিয়ায় বায়ুমন্ডলীয় নদীর তীব্রতা উলেস্নখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা দেখেছি যে, তখন থেকে মাদাগাস্কার, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানে এই নদী আরও তীব্র হয়ে উঠেছে।'
২০২৩ সালের এপ্রিলে প্রচন্ড বজ্রপাত, শিলাবৃষ্টি ও বিরল বৃষ্টিপাতের পর ইরাক, ইরান, কুয়েত ও জর্ডান ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে। পরে আবহাওয়াবিদরা দেখতে পান যে, এই অঞ্চলের বাতাস রেকর্ড পরিমাণ আর্দ্রতা বহন করেছে। ২০০৫ সালেও এমন ঘটনা ঘটেছিল, তবে তখন এতো আর্দ্রতা ছিল না।
বিশ্লেষকদের মতে, কিছু ক্ষেত্রে এমন নদী উপকার বয়ে আনে, বিশেষ করে যেসব এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে খরা চলছে। তবে অতীতের তুলনায় বায়ুমন্ডলে যে অনেক বেশি আর্দ্রতা দেখা যাচ্ছে, সেটিকেও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। বায়ুমন্ডলীয় নদীর সম্ভাব্য বিধ্বংসী প্রভাব সম্পর্কে গবেষণা করা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।