শুক্রবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২২ কার্তিক ১৪৩১
সরকারি ২৬ পাটকল বন্ধ থাকায় দরপতন চলছে

পাটের দরপতনে হতাশ কৃষক

আলতাব হোসেন
  ০৯ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
পাটের দরপতনে হতাশ কৃষক

বিশ্বে পাটের রমরমা বাণিজ্য চললেও বাংলাদেশে বন্ধ রয়েছে সরকারি পাটকলগুলো। প্রায় তিন বছর ধরে সরকারের ২৬টি পাটকল বন্ধ রয়েছে। এতে আবারও পাট কৃষকের গলার ফাঁস হতে যাচ্ছে। পাটকল বন্ধের আগে প্রতিমণ পাট বিক্রি হতো তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকায়। সরকারের প্রায় ১৭০টি পাট ক্রয় কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পাটের দরপতন চলছে। চলতি মৌসুমে ভালোমানের পাটের দাম নেমে এসেছে দুই হাজার ২শ' টাকায়। আর মাঝারি মানের পাট বিক্রি হচ্ছে ১৫শ' টাকা মণে। এতে পাটচাষিদের মাথায় হাত পড়েছে।

বিশ্বে পাটের চাহিদা বাড়ায় ২০২০-২১ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি থেকে রেকর্ড ১ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার আয় করে বাংলাদেশ। দেশ-বিদেশে পাটের বহুমুখী ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। সোনালি আঁশে আবার সোনালি স্বপ্ন দেখা দেয়। শীতপ্রধান দেশগুলোতে প্রায় ৫০ ধরনের পাটের কাপড় রপ্তানি হয়। ২০২১ সালে সাত হাজার টাকা মণে পাট বিক্রি হয়। বাংলার কৃষকরা আবার ঝাঁপিয়ে পড়েন পাট চাষে।

পাটখাড়ি থেকে তৈরি হচ্ছে কম্পিউটার ও ফটোকপির মূল্যবান কালি। প্রায় ৫০ ধরনের পাটের কাপড় রপ্তানি হচ্ছে। গাড়িতে ব্যবহার হচ্ছে পরিবেশবান্ধব পাট। এ ছাড়াও যুদ্ধ বা দুর্ভিক্ষে বিধ্বস্ত দেশগুলোতে দাতা সংস্থার ত্রাণসামগ্রী ব্যবহারে পাটের দড়ি ও বস্তার চাহিদা বেড়েছে। উড়োজাহাজ থেকে পাটের বস্তার মধ্যে খাবার সামগ্রী নিচে ফেলা হচ্ছে। পাটের সুতা দিয়ে শাড়ি, পাঞ্জাবির কাপড়, টুপি, জিন্স ও গরম কাপড় তৈরি হচ্ছে। বিশ্বখ্যাত বিলাসবহুল গাড়িতে ব্যবহার করা হচ্ছে পাট। উড়োজাহাজের ইন্টেরিয়রও তৈরি হচ্ছে পাট দিয়ে। পাট পাতার সু্যপ ও পাটের কফিন ইউরোপের দেশগুলোতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠছে। বিশ্বে পরিবেশবান্ধব প্রাকৃতিক এই তন্তুুর বহমুখী ব্যবহার বেড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বাঁধ ও নদী ভাঙ্গনরোধে পাটের বস্তা ব্যবহার হচ্ছে।

পাট বিশেষজ্ঞ কৃষিবিদ ড. শহীদুল ইসলাম বলেন, কাঁচা পাটের পাশাপাশি জুট ইয়ার্ন, টুওয়াইন, চট ও বস্তার পর এবার বিশ্ববাজারে পাটের কাপড়ের চাহিদা বেড়েছে। শীতপ্রধান দেশগুলোতে প্রায় ৫০ ধরনের পাটের কাপড় রপ্তানি হচ্ছে। হাতে তৈরি বিভিন্ন পাটজাত পণ্য ও কার্পেট মধ্যপাচ্যের দেশগুলোতে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। পাটের ২২ জাতের সুতা রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের ১৪ দেশে। পাটকাঠি এতদিন রান্নার কাজে জ্বালানি ও ঘরে বেড়া দেওয়ার কাজে ব্যবহার হতো। এখন পাটকাঠি থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হচ্ছে উচ্চ মূল্যের অ্যাক্টিভেটেড চারকোল। এই চারকোল দেশের বিভিন্ন কারখানায় ব্যবহার হচ্ছে ও বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে, যা থেকে তৈরি হচ্ছে কার্বন পেপার, কম্পিউটার ও ফটোকপির কালি, মোবাইল ফোনের ব্যাটারি, ওয়াটার পিউরিফিকেশন পস্ন্যান্ট, বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনী পণ্য। পাটের চারকোল রপ্তানি হচ্ছে চীন, তাইওয়ান, ব্রাজিলসহ বিভিন্ন দেশে। পাটের আঁশ থেকে তৈরি হচ্ছে শাড়ি, লুঙ্গি, পর্দার কাপড়, গয়না, অলংকারসহ ২৮৫ ধরনের পণ্য, যা দেশে ও বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে।

পাটভিক্তিক প্রতিষ্ঠান কার্বন ফ্যাক্টরি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চারকোল ম্যানুফ্যাকচার্স অ্যান্ড এক্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে চারকোল রপ্তানি হয় চার হাজার ১৮২ দশমিক ২৭ টন। প্রতি টন চারকোলের মূল্য ছিল ৭শ' ডলার। এ হিসাবে চারকোল থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আসে ২৯ লাখ ২৭ হাজার ৫৮৯ ডলার বা প্রায় ২৫ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে পাটপণ্য বিক্রেতা এমএ বারী জানান, ১৩৫ ধরনের বহুমুখী পাট পণ্য বিক্রি হচ্ছে দেশে-বিদেশে। পাট দিয়ে নন্দন ও রুচিশীল ফ্যাশনেবল বা সৌন্দর্যমন্ডিত পণ্য, দৈনন্দিন ব্যবহার উপযোগী সামগ্রী, নানা প্রকারের হ্যান্ডিক্রাফট, হোম টেক্সটাইল পার্টেক্স বোর্ড ইত্যাদি বাংলাদেশের পাট এখন পশ্চিমা বিশ্বে গাড়ি নির্মাণ, পেপার অ্যান্ড পাম্প, ইনসু্যলেশন শিল্পে, জিওটেক্সটাইল হেলথ কেয়ার, ফুটওয়্যার, উড়োজাহাজ, কম্পিউটারের বডি তৈরি, ইলেকট্রনিক্স, মেরিন ও স্পোর্টস শিল্পে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশ্বে বাংলার পাটের এখন রমরমা বাণিজ্য চলছে। অথচ অদৃশ্য কারণে দেশের পাটকলগুলো বন্ধ করা হয়েছে।

কয়েক বছর রমরমা ব্যবসার পর এবার পাটের বাজারে মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। সারা দেশে পাটের ভরা মৌসুম চলছে। জুলাই থেকে আগস্ট মাসে সরকারি পাট ক্রয়কেন্দ্র বন্ধ থাকায় পাটের দাম কমছে। ঘাম ঝরিয়ে পাট উৎপাদন করে ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় পাট চাষিরা হতাশ। পাটের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে অনেক কৃষক বলছেন- এ যেন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা'র দশা। বাজারে মিলছে না ন্যায্যমূল্য, আবর হাটে নেই পাটের ক্রেতা। পাট নিয়ে মহাজনের গুদামে গুদামে ঘুরছেন কৃষক।

বৃহস্পতিবার ফরিদপুরের তালমা ও কামারখালী বাজারে পাট বিক্রি হয় ২ হাজার টাকায়। মাগুরা, ময়মনসিংহ, নরসংদী, বগুড়া, গাইবান্ধার হাটগুলো কমবেশি ২ হাজার ২০০ টাকার মধ্যে পাট কিক্রি হচ্ছে। মাগুরার নাঙ্গলহাট ও সমাধিনগরে পাট বিক্রি হয় ২শ' হাজার টাকায়। এতে লোকসান গুনতে হচ্ছে কৃষকদের। উৎপাদন ব্যয়ের অর্ধেক দাম পাচ্ছেন না পাটচাষি কৃষকরা। পাটচাষিদের উৎপাদনের অর্ধেক খরচও উঠছে না। তাদের আশঙ্কা পুরোদমে বাজারে পাট উঠলে দাম দেড় হাজার টাকার নিচে নেমে যাবে।

ফরিদপুরের তালমা হাটে পাট নিয়ে এসেছেন কৃষক খবির উদ্দিন। তিনি জানান, গত ২ বছর আগে সাত হাজার টাকা মণে পাট বিক্রি করেছেন। ভালো দামের আশায় তিনি এবার বেশি জমিতে পাট চাষ করেন। ভেবে ছিলেন এবার বাজারে পাটের দাম আট হাজার ছাড়াবে। কিন্তু এখন তিনি হতাশ। ভালোমানের শুকনো পাট ২ হাজার ১শ' টাকা মণে বিক্রি করেছেন। এতে তার লোকসান হবে বলে জানান।

ফরিদপুর, রাজবাড়ীর বহরপুর, কনকাপুর, পাংশার হাটগুলোতে উন্নত মানের পাট ২ হাজার টাকা মণে বিক্রি হচ্ছে। আর মাঝারি মানের পাট ১ হাজার ৪শ' থেকে ১ হাজার ৫শ' টাকা মণে বিক্রি হচ্ছে। মাগুরার রাঁধানগর, সত্যজিৎপুর, লাঙ্গলবাদ, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, শাহজাদপুর, ময়মনসিংহ, গৌরীপুর, ইশ্বরগঞ্জ, জামালপুর, সরিষাবাড়িতে পাটের কম দামে নাখোশ কৃষক।

অনুসন্ধানে জানা যায়, লোকসানের কারণে তিন বছর ধরে বন্ধ সরকারের ২৬টি পাটকল। বেসরকারি উদ্যোক্তদের ২৩টি পাটকল এখনো পাট কেনা শুরু করেনি। এই সুযোগ নিচ্ছেন পাটের ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা। তারা কমদামে পাট কিনে মজুত করছেন। যখন কৃষকের হাতে পাট থাকবে না, তখন তিনগুণ বেশি দামে সরকারের কাছে পাট বিক্রি করে পাটের লাভের গুড় খাবেন তারা।

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র পাট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশিদ যায়যায়দিনকে বলেন, প্রায় তিন বছর ধরে সরকারি ২৬টি পাটকল বন্ধ রয়েছে। এতে সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) প্রায় ১৭০টি পাট ক্রয় কেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। এতে পাটের দাম দিনের পর দিন কমছে। পাটকলগুলো বেসরকারিকরণের উদ্যোগ নিলেও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সাড়া মিলেনি। এরমধ্যে দুটি পাটকল লিজ দেওয়া হয়েছে। এই দুটি পাটকলও বন্ধ। দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকায় পাটকলগুলোর যন্ত্রপাতি নষ্ট ও ব্যাহত হচ্ছে। পাটকলের ভেতরের গাছপালা আসবাবপত্র ও অন্যান্য মূল্যবান জিনিস চুরি হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত হবে অন্তত লাভজনক কয়েকটি পাটকল চালু করা। তাহলে পাটচাষি ও পাটের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা উপকৃত হবেন। তিনি আরও বলেন, পাটকল বন্ধ থাকলেও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঠিকই বেতন-ভাতা পাচ্ছেন।

উলেস্নখ্য, প্রয়াত বাংলাদেশি বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে ২০১০ সালে একদল গবেষক পাটের জীবন রহস্য (জিনোম সিকোয়েন্স) আবিষ্কার করে এর ফলে বাংলাদেশ উন্নত মানের পাট চাষ এবং বীজ উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়। এবার সারাদেশে ৯০ লাখ বেল পাট উৎপাদনের টার্গেট রয়েছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে