জটিল রোগের চিকিৎসায় রোগীরা হাসপাতালে অপারেশনের জন্য দিন গুনছেন। অনেকে অপারেশনের সিরিয়াল নিয়ে শয্যায় কাতরাচ্ছেন। গত ১৬ জুলাই থেকে বেশিরভাগ হাসপাতালে জরুরি বিভাগের অপারেশন ছাড়া অন্যসব অপারেশন বন্ধ আছে। চিকিৎসকরা আসছেন কম। যারা আসছেন তারা সপ্তাহে একদিন কয়েক ঘণ্টার জন্য এসে আবার চলে যাচ্ছেন। শুধু ইন্টার্ন ও জুনিয়র চিকিৎসকদের ভরসায় চলছে হাসপাতালগুলো।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসকরা জানিয়েছে, আওয়ামীপন্থি চিকিৎসকরা ভয়ে হাসপাতালে আসছে না। রাজধানী ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলোয় কর্মরত চিকিৎসকদের ৮০ ভাগই আওয়ামীপন্থি। এদের ৯০ ভাগ চিকিৎসক ভয়ে হাসপাতালে আসছেন না। এমনকি তাদের ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না।
তারা বলেছেন, বিএসএমএমইউতে গত রোববার হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর এখনও অস্থিরতা বিরাজ করছে। প্রত্যেকে এখন নিরাপদে আশ্রয় আছেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও নিরাপত্তা জোরদার করা হলে হাসপাতালে ফেরা সম্ভব।
সরেজমিন রাজধানীর জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) এমন চিত্র উঠে এসেছে।
এ ছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল,
জাতীয় অর্থোপেডিক্স ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর), জাতীয় কিডনি ইনস্টিটিউ হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতাল, জাতীয় নিউরো সায়েন্সেস ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালসহ রাজধানীর অন্য হাসপাতালগুলোয় খোঁজ নিয়ে একই চিত্র পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য থেকে শুরু করে সরকারি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের অধ্যক্ষ, পরিচালক, উপ-পরিচালক, অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপকসহ সিনিয়র চিকিৎসকদের বেশিরভাগই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সমর্থক চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) অনুসারী। এ ছাড়া চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন 'বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন' (বিএমএ) কেন্দ্রীয় ও শাখার নেতৃস্থানীয়রাও গা-ঢাকা দিয়েছেন।
জানা গেছে, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) নেতারা সরকারের পতর ঠেকাতে মাঠে-ঘাটে হাসপাতলের ভিতরে-বাইরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমর্থন করছেন। এমনকি অনেকে মিটিং-মিছিল করছেন। এ কারণে ১৬ জুলাই থেকে বেশিরভাগ চিকিৎসক হাসপাতালে আসছে না। যারা আসছেন তারা সপ্তাহে একদিন কয়েক ঘণ্টার জন্য এসে আবার চলে যাচ্ছেন। শুধু ইন্টার্ন চিকিৎসক ও জুনিয়র চিকিৎসকদের ভরসায় চলছে হাসপাতালগুলো।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর সরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে ১৬ বছরে সরকারপন্থি চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পদায়ন করা হয়েছে। সরকারপ্রধান পদত্যাগ করে দেশ ত্যাগ করেছেন এমন খবর ছড়িয়ে পড়ার পর তারা সবাই ব্যক্তিগত ফোন নম্বর বন্ধ করে আত্মগোপনে চলে গেছেন। দরিদ্র রোগীদের চিকিৎসা পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, হাসপাতালগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্তদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য ফোন করছি। কিন্তু কাউকে পাচ্ছি না। বেশিরভাগ চিকিৎসকের ফোন বন্ধ পাচ্ছি। চিকিৎসা যদি হাসপাতালে না যায় তাহলে চিকিৎসাসেবা চালানো কঠিন হয়ে পড়বে। হাসপাতাল পরিচালকদের নিয়ে জুম (অনলাইন) মিটিং করেছি। পুরোপরি না হলেও সেবা যেন বন্ধ না হয় সেই নির্দেশ দিয়েছি।'
এদিকে গত সোমবার সকালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্র-জনতার হাতে সরকার পতন হবে- এমন খবরে চিকিৎসকদের অনেকেই কর্মস্থল ত্যাগ করতে শুরু করেন। দুপুরে সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে প্রায় সব হাসপাতাল চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী শূন্য হয়ে পড়ে। এর প্রভাবে পরের দিন মঙ্গলবার রাজধানীর বেশিরভাগ হাসপাতালে পরিচালক, সিনিয়র চিকিৎসক, কর্মকর্তারা আসেনি। শুধু আউটডোরে দু-একজন জুনিয়র চিকৎসক চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে রোগীদের চিকিৎসাসেবা অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সমর্থক চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) নেতারা বলেছেন, ১৬ বছর যাবৎ রাজধানীর সরকারি হাসপাতালে সরকারপন্থি চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পদায়ন করা হয়েছে। সবাই আওয়ামী লীগ সরকারের তদবিরে পদায়ন হয়েছে। সরকারপ্রধান পদত্যাগ করে দেশ ত্যাগ করেছেন এমন খবরে তারা সবাই ব্যক্তিগত নম্বর বন্ধ করে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছেন। দেশের পরিস্থিতি বুঝে ব্যবস্থা নেবে তারা।
মঙ্গলবার দুপুরে সরেজমিন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে গিয়ে দেখা, অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, অধিদপ্তরের সিডিসির লাইন ডিরেক্টর, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) পরিচালকসহ বেশিরভাগ কর্মকর্তাকে কর্মস্থলে অনুপস্থিত দেখা গেছে। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, অতিরিক্ত মহাপরিচালক এই দপ্তরের বেশকিছু ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে কর্মস্থলে পাওয়া যায়নি।
রাজধানীর জাতীয় ক্যানসার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল পরিচালক ও উপপরিচালক ও সহকারি পরিচালককে পাওয়া যায়নি। চিকিৎসকদের অনুপস্থিতির কারণে শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালেও সব ধরনের অস্ত্রোপচার বন্ধ থাকতে দেখা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাতীয় হূদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. জুলফিকার আলী লেলিন, অধ্যাপক ডা. মাহবুবুর রহমান বাবু, সহযোগী অধ্যাপক ডা. কাজল কুমার কর্মকার, অধ্যাপক ডা. আতাউল হক, সহযোগী অধ্যাপক আশ্রাফুল হক সিয়ামসহ একাধিক চিকিৎসকের কক্ষ তালাবদ্ধ বয়েছে।
এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য, উপ-উপাচর্যসহ স্বাচিপন্থি চিকিৎসক, কর্মকর্তারাও বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেনি। তাদের অভিযোগ বিএনপিপন্থি চিকিৎসক-কর্মচারীরা উপাচার্যের কার্যালয় তালাবদ্ধ করে রেখেছেন।
অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, বেশকিছু হাসপাতাল ভাঙচুরের কথাও শুনতে পাচ্ছি। এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরপত্তা দরকার। আমি একটা কথা সবসময় বলি, মসজিদে মুমলমান যায়, মন্দিরে যায় হিন্দুরা আর খ্রিষ্টানরা যায় গির্জায়। এদের সবাই কিন্তু এক হাসপাতালে যায়। তাই হাসপাতাল রক্ষার দায়িত্ব সবার মন্ত্রণালয়েও এখন কেউ নেই।'
বিএনপিপন্থি চিকিৎসক বিএসএমএমইউ'র রিউমাটোলজির বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শামিম আহমেদ বলেন, 'বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস খোলা। কাউকে আসতে বাধা দেওয়া হচ্ছে না। রোগীরা চিকিৎসা পাচ্ছেন। বরং ভিসি-প্রোভিসি নিজেরাই আসছে না। গত ১৫ বছর বিএসএমএমইউ'র চিকিৎসা, শিক্ষা, গবেষণায় নৈরাজ্য চলে আসছে। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার চিকিৎসক টিমের সদস্য হওয়ায় বিভিন্ন সময় হুমকির স্বীকার হয়েছি। সরকার পতনের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেবা কার্যক্রমে অংশ না অনেকেই অপপ্রচার চালাচ্ছেন।'