'লা নিনা' সক্রিয় হওয়ায় বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি পাচ্ছে
চলতি মাসে ফের বন্যার শঙ্কা
প্রকাশ | ০৬ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
আলতাব হোসেন
দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, মধ্যাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বন্যার ক্ষত এখনো শুকায়নি। এর মধ্যে 'লা নিনা' সক্রিয় হওয়ায় সারাদেশে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। উজানের দেশগুলোতেও বৃষ্টিপাত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগামী দুই সপ্তাহ বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অফিস। ভারী বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পানিতে চলমান বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে। নতুন করে বিভিন্ন এলাকা পস্নাবিত হতে পারে। এতে শেষ আগস্টে বড় বন্যার শঙ্কা করা হচ্ছে।
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন জেলায় লক্ষাধিক মানুষ বন্যায় পানিবন্দি হয়ে আছেন। শুক্রবার নেত্রকোনার কলমাকান্দায় বন্যার পানির স্রোতে ভেসে গেছে সাত বছরের এক শিশু। আবহাওয়া ও পানি বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন, ইতিমধ্যে সক্রিয় হয়েছে বৃষ্টিপাত তৈরির চক্র 'লা নিনা'। এতে বাড়বে বৃষ্টিপাতের মাত্রা। এতে অন্তত ১৫০ গুণ এমনকি এর চেয়েও অতি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। দেশজুড়ে অতিভারী বৃষ্টিপাতের প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং স্বাভাবিক বর্ষাকালে মৌসুমি বায়ু অতি সক্রিয় হওয়ায় ভারী বৃষ্টির কারণেই মধ্য আগস্টের পর দেশে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। এতে মাঠে থাকা আমন ধানের বড় ক্ষতি হতে পারে।
এদিকে অতি খরা ও বৃষ্টি এল নিনো ও লা নিনো জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বন্যা, খরা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য দায়ী এল নিনো ও লা নিনা। লা নিনো বা লা নিনা স্প্যানিশ শব্দ। স্প্যানিশ ভাষায় নিনো শব্দের অর্থ ছেলে আর নিনা শব্দের অর্থ মেয়ে। এল নিনো শব্দের অর্থ ছোট ছেলে এবং লা নিনা অর্থ ছোট মেয়ে। উষ্ণতা নিয়ে আসে এল নিনো, এতে খরা ও তীব্র গরমে অতিষ্ঠ হয় মানুষ। এল নিনোর প্রভাব কমে আসার পর প্রশান্ত মহাসাগরে নতুন রূপে আসে অতিশীতল পানি। এ সময় জেলেদের জালে মাছ বেশি ধরা পড়ে। এ অবস্থাকে জেলেরা নাম দিয়েছেন লা নিনা। লা নিনার প্রভাবে অবিরাম বৃষ্টি ও হিমবাহ গলে বন্যা দেখা দেয়। ক্রমাগত বাড়তে থাকা বন্যায় এশিয়াবাসীর সংকট দ্বিগুণ করে তুলে। লা নিনার প্রভাবে পাকিস্তান ও ভারতে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে ভারতের মৃতু্যর সংখ্যা শতাধিক ছাড়িয়ে গেছে। অতিবৃষ্টিতে পাহাড় ধসে মৃতু্য বাড়ছে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া
অধিদপ্তরের দীর্ঘমেয়াদি পূর্বাভাসে আরও বলা হয়েছে, চলতি মাসে বঙ্গোপসাগরে এক থেকে দুটি বর্ষাকালীন লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে, যার মধ্যে একটি মৌসুমি নিম্নচাপে পরিণত হতে পারে। এছাড়া আগস্টে দেশে বিচ্ছিন্নভাবে এক থেকে দুটি মৃদু তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। আগস্ট মাসে মৌসুমি ভারী বৃষ্টিপাতজনিত কারণে দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল, উত্তর-মধ্যাঞ্চল এবং মধ্যাঞ্চলের কতিপয় স্থানে মধ্যমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। অন্যদিকে দক্ষিণ-পূর্ব পার্বত্য অববাহিকার কতিপয় স্থানে বন্যা হতে পারে। ইতিমধ্যে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ফেনীতে মুহরি নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে নতুন নতুন এলাকা পস্নাবিত হচ্ছে।
বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের কর্মকর্তারা জানান, গঙ্গা ও পদ্মা অববাহিকায় পানি সমতল বৃদ্ধি পেতে পারে। এতে দেশের প্রধান নদ-নদীর পানি বাড়তে পারে এবং কিছু এলাকায় বিপৎসীমার বাইরে যেতে পারে। দেশের উত্তরাঞ্চল (রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও নীলফামারী), উত্তর মধ্যাঞ্চল (যমুনা নদী-তীরবর্তী এলাকার টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ ও জামালপুর) এবং উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে (বগুড়া, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা জেলা) উত্তর-পূর্বাঞ্চলের (সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ) এলাকায় বড় ধরনের বন্যা হতে পারে।
আবহাওয়া বিষয়ক সংস্থা সাউথ এশিয়া ক্লাইমেট আউটলুকের বরাত দিয়ে দ্য ইকোনমিক টাইমস জানিয়েছে, চলতি বছর বর্ষা মৌসুমে আবহাওয়ার বিশেষ অবস্থা 'লা নিনা'র কারণে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ অঞ্চলে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হবে এবং বৃষ্টিপাত রেকর্ড ভাঙতে পারে। চলমান বন্যা পরিস্থিতি আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে এবং বন্যাকবলিত জেলার সংখ্যাও বাড়তে পারে। সিলেট ও সুনামগঞ্জে শহররক্ষা বাঁধ না থাকায় বারবার বন্যায় মানুষ ও ফসল আক্রান্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ সাইফুল ইসলাম বলেন, লা নিনা সক্রিয় হওয়ায় ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। ২০১৭-১৮ সাল ছিল লা নিনা বছর। অধিকাংশ প্রাকৃতিক দুর্যোগ এই সময়ে হয়েছে এবং অনেকটা লা নিনার কারণে হয়েছে। ২০১৭ সালে হাওড়ে আগাম বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। তখন ধনাঢ্য কৃষকরা ভাতের অভাবে হাত পাততে বাধ্য হন।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. নজরুল ইসলাম বলেন, উজানের দেশ ভারতের মেঘালয়ে একদিনে ভারী বৃষ্টির ঘটনা ঘটলেই বাংলাদেশে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। কারণ আমাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নদীব্যবস্থা এত স্বল্প সময়ে বিপুল পরিমাণ পানি বহন করতে পারে না। উজানে ও মেঘালয়ে বেশি বৃষ্টি হলে তার পানি নেমে আসে। একই সময় আমাদের দেশে বৃষ্টির পানি খাল-বিল-নদী হয়ে সাগরে যায়। তখন দেশের নদীগুলোর ধারণক্ষমতার চেয়ে পানি বেশি হওয়ায় লোকালয় পস্নাবিত হয়। এতে মৎস্য খামার, ফসল, মানুষের ঘরবাড়ি ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়।
এদিকে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, আগামী কয়েকদিনে গঙ্গা ও পদ্মা অববাহিকায় পানি বৃদ্ধি পাবে। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলের সুরমা-কুশিয়ারা নদীর পানি সমতল বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার প্রধান নদীসমূহের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব এলাকায় চলমান বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। এ ছাড়াও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে মুহুরি নদীর পানি পরশুরাম পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। দেশের উত্তরাঞ্চলে তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, ঘাঘট, যমুনাশ্বরী, আপার করতোয়া, পূর্ণভবা, টাঙ্গন, ইছামতি, যমুনা, আপার আত্রাই নদীর পানি বৃদ্ধি পেতে পারে।
দেশে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীরণ কেন্দ্রের ১১০টি পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে ৬৪টি স্টেশনে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ৪০টি স্টেশনে কমেছে, ৬টি স্টেশনে পানির উচ্চতা অপরিবর্তিত রয়েছে এবং ১টি স্টেশনে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ফেনীর মহুরি নদী।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (বাপাউবো) বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান বলেন, আগস্টের প্রথম দুই সপ্তাহের মধ্যে অতিবৃষ্টির কারণে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাবে এবং নতুন নতুন এলাকা পস্নাবিত হতে পারে। তবে এখনই বন্যার স্থায়িত্ব কত বড় হবে তার তথ্য-উপাত্ত এখনো আমাদের হাতে আসেনি। তবে এটা বলা যায় আগস্টের শেষে একটা বন্যা হতে পারে।