কোটা সংস্কার আন্দোলনে সহিংসতা ও হতাহতের বিষয়ে বিভিন্ন মামলায় শিশু-কিশোরদের গ্রেপ্তার, হাতকড়া পরানো ও বিমান্ডের ঘটনাগুলোকে আইনের শাসনের পরিপন্থি কর্মকান্ড হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞ আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মীরা।
তারা বলছেন, একটি শিশু রিমান্ড শব্দ জানে 'নেতিবাচক' হিসেবে। রিমান্ডের যে চিত্র তাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেটি নির্যাতনের। যেসব শিশু রিমান্ডের মুখোমুখি হবে, তাদের এই দুঃসহ স্মৃতি সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে, মানসিক ভারসাম্যহীনও হয়ে পড়তে পারে তারা।
এসব বিভীষিকা থেকে সুরক্ষাকবচ হিসেবে দেশে আলাদা শিশু আইন রয়েছে। শিশুদের গ্রেপ্তার, বিচার, জামিন, রিমান্ড ও দন্ড দেওয়ার বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে সংবেদনশীল আচরণ দেখানোর বিষয়গুলো এই আইনে বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। জাতিসংঘ শিশু
অধিকার সনদেও এসব বিষয় রয়েছে, যেখানে স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ।
ফৌজদারি অপরাধ বিশেষজ্ঞ আইনজীবী আমিনুল গণী টিটো বলছেন, কোনো শিশুর হাতে-কোমরে দড়ি পরানোই যেখানে আইনবিরুদ্ধ, সেখানে রিমান্ডে নেওয়ার তো 'প্রশ্নই ওঠে না'।
এ ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগকারীদের মধ্যে আইন অমান্যের প্রবণতা দেখছেন অধিকারকর্মী ও আইনজীবী জেড আই খান পান্না।
'শিশু আইন ২০১৩' অনুযায়ী, ১৮ বছর বয়স পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত তারা শিশু হিসেবে গণ্য হবে। অর্থাৎ কোনো মামলায় শিশুরা গ্রেপ্তার হলেও তাদের হাতকড়া, ডান্ডাবেড়ি বা কোমরে দড়ি পরানো যাবে না।
অথচ কোটা আন্দোলন ঘিরে সহিংসতা ও নাশকতার বিভিন্ন মামলায় ১৩ বছর ৭ মাস বয়সি স্কুলছাত্র, ১৬ বছর ১০ মাস বয়সি কলেজছাত্র, ১৭ বছর বয়সি কলেজছাত্রের গ্রেপ্তার ও রিমান্ডসংশ্লিষ্ট ঘটনাগুলোতে সেসব দেখা গেছে, যা নিয়ে দেশজুড়ে জোরালো সমালোচনার সৃষ্টি হয়েছে।
১৭ বছর বয়সি কলেজছাত্রের ঘটনায় হাইকোর্টের মন্তব্য ও নিদের্শনার পরও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে দেখা যাচ্ছে, যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আইন বিশেষজ্ঞ ও শিশু অধিকারকর্মীরা।
১৩ বছর ৭ মাস বয়সি শিশুর ঘটনা
ঢাকার দনিয়া এ কে স্কুলের এই শিক্ষার্থীকে ২২ জুলাই গ্রেপ্তার করা হয়। তার আইনজীবী মোহাম্মদ ইব্রাহীম মৃধা বলছেন, তার বয়স এখন ১৩ বছর ৭ মাস। সে শিশু।
পুলিশের কাজে বাধা, বেআইনি সমাবেশ, দাঙ্গা-হাঙ্গামায় অংশগ্রহণ ও বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে কাফরুল থানার মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
২৬ জুলাই ঢাকার একজন মহানগর হাকিম পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তার পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। ১৩ বছরের শিশুকে কোন আইনে রিমান্ডে পাঠানো হচ্ছে, তা চ্যালেঞ্জ করা হয়।
২৯ জুলাইয়ের শুনানিতে শিশুটির রিমান্ড বাতিল করে তাকে গাজীপুরে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানোর আদেশ দেন আরেকজন বিচারক।
২০১৩ সালে সরকার শিশু আইন প্রণয়নের সময় যে অংশীজনদের সহযোগিতা নিয়েছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস তাদের একজন।
মামলার আসামি হলেও শিশুদের রিমান্ডে পাঠানো যায় কি না জানতে চাইলে অধ্যাপক ফেরদৌস বলেন, 'শিশুসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদ (কনভেনশন) অনুযায়ী শিশুদের রিমান্ডে দেওয়ার কোনো বিধান নেই। বাংলাদেশ যেহেতু ওই সনদে স্বাক্ষর করেছে এবং শিশু আইন ২০১৩-এর মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করেছে, ফলে শিশুকে রিমান্ডে পাঠানোর কোনো সুযোগ নেই।'
আইনজীবী ইব্রাহীম মৃধার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৩ বছরের ওই শিশুকে দনিয়ার বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে কাফরুল এলাকার মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। সে দনিয়ার এ কে হাই স্কুলের ছাত্র। তার বাবা দনিয়া এলাকায় ডিশ সংযোগের লাইনম্যান।
এ আইনজীবী বলেন, 'শিশু-কিশোরদের এভাবে গ্রেপ্তারের ঘটনা আইনের শাসনের পরিপন্থি। আইন না জানা কিছু সদস্যের জন্য গোটা পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি ধ্বংস হচ্ছে।' তার ধারণা, পুলিশের মধ্যে কিছু সদস্য 'প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে অথবা টাকার জন্য' এ ধরনের কাজ করে থাকেন।
ইব্রাহীম মৃধা বলেন, ৩১ জুলাই শিশুটিকে হাজির করে তার উপস্থিতিতে জামিন শুনানি আবেদন করা হয়।
বিচারক আবেদন মঞ্জুর করে ১ আগস্ট শিশুটির উপস্থিতিতে জামিন শুনানির জন্য গাজীপুরের শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে উপস্থিতি পরোয়ানা (প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট/পিডবিস্নউ) পাঠান। সেদিন শুনানিতে গিয়ে আইনজীবী জানতে পারেন সংশ্লিষ্ট পুলিশ শিশুটিকে আদালতে হাজির করেনি।
২০১৩ সালের শিশু আইনেও দেখা যাচ্ছে শিশুদের আদালতে তোলা হলে জামিন পাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
আইনের ৫২ ধারার (৫) উপধারায় বলা হয়েছে, 'থানা হইতে জামিনপ্রাপ্ত হয় নাই এমন কোনো শিশুকে শিশু-আদালতে উপস্থাপন করা হইলে শিশু-আদালত তাহাকে জামিন প্রদান করিবে বা নিরাপদ স্থানে বা শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে আটক রাখিবার আদেশ প্রদান করিবে।'
ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শিশুটিকে উপস্থিত করে আইনজীবী শুনানির আর্জি করলে ৪ নম্বর শিশু আদালতের বিচারক শাহরিয়ার কবির বলেন, 'এখন তেমন ব্যবস্থা নেই। আপনি চাইলে ফ্রেশ পিটিশন দিয়ে জামিন শুনানি করতে পারেন।'
নতুন দরখাস্ত দিয়ে জামিন শুনানিতে আইনজীবী অভিযোগ করেন, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানোর পর শিশুটিকে শারীরিকভাবে নির্যাতনের করা হয়েছে। তার দ্রম্নত সুচিকিৎসা করানোর আর্জি রাখেন তিনি।
শুনানি শেষে বিচারক জামিন আবেদন নাকচ করে শিশুটির শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে উপস্থিতি পরোয়ানা মূলে শিশুটির উপস্থিতিতে ৭ দিন পর জামিন শুনানির জন্য আদেশ দেন।
আইনজীবী মৃধা বলেন, 'আমরা এই ৭ দিনের মধ্যে বিশেষ জামিনের আবেদন করব না। আমরা উচ্চ আদালতে যাব।'
১৬ বছর ১০ মাস বয়সি কিশোরের ঘটনা
জন্মসনদ অনুযায়ী উচ্চ মাধ্যমিকের এই ছাত্রের বয়স ১৬ বছর ১০ মাস। তবে মিরপুর থানা-পুলিশ তার বয়স ১৮ বছর দেখিয়ে এক মামলায় গ্রেপ্তার করে তাকে আদালতে তোলে। পরে তার আইনজীবী আদালতে জন্মসনদ জমা দিয়ে তাকে শিশু হিসেবে গণ্য করে মামলাটি শিশু আদালতে পাঠানোর আর্জি করেন।
শিশু আইন অনুযায়ী, কোনোভাবেই দাগি অপরাধীর সঙ্গে শিশুর বিচারকাজ পরিচালনা করা যাবে না। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবু্যনাল-৮ শিশুটিকে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
আদালতে পেশ করা তথ্য অনুযায়ী, শিশুটির গ্রামের বাড়ি ঢাকার নবাবগঞ্জে। মিরপুরে একটি হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করে। সোমবার দুপুরে তার এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে মিরপুর-১০ নম্বরের গোল চত্বরে যায়। সেখানে থেকে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়। সে বারবারই বলেছিল, গত বছর সে মাধ্যমিক পাস করেছে। তার বয়স ১৮ বছর হয়নি।
মঙ্গলবার শিশুটিকে যখন আদালত কক্ষে আসামির কাঠগড়ায় রাখা হয়, তখনও তার হাতে হাতকড়া ছিল। অথচ শিশুদের কোনো অবস্থাতেই হাতকড়া পরানোর বিধান নেই কোনো আইনে।
শিশু আইনের ১৯ (৪) ধারায় বলা হয়েছে, 'গ্রেপ্তার করিবার পর কোনো শিশুকে হাতকড়া বা কোমরে দড়ি বা রশি লাগানো যাইবে না।'
শিশু আইনের ৪৪ ধারায়ও বিষয়টি নিয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, 'গ্রেপ্তারের পর কোনো শিশুকে হাতকড়া বা তার কোমরে দড়ি লাগানো যাবে না। আইন অনুযায়ী, ১৮ বছরের নিচে সব সবাই শিশু হিসেবে গণ্য হয়।'
হাতকড়া পরে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো শিশুটি আদালতকে সেদিন বারবার বলছিল, সে শ্বাসকষ্টের রোগী।
অথচ ২০১৩ সালের শিশু আইনের ১৯ (৩) ধারায় বলা হয়েছে, 'উপ-বিধি (১) এর সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ করিয়া আদালত কক্ষে শিশুর জন্য উপযুক্ত আসনসহ প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য প্রয়োজনে বিশেষ ধরনের আসন প্রদানের বিষয়টি শিশু-আদালত নিশ্চিত করিবে।'
শিশুটির আইনজীবী মোহাম্মদ মইন উদ্দিন বলেন, তার মক্কেল কোনো ধরনের নাশকতা কিংবা ভাঙচুরের সঙ্গে জড়িত নয়। আইন অনুযায়ী, সে শিশু। আইনের সংস্পর্শে আসা শিশুর বিচার কখনো পূর্ণবয়স্ক আসামির সঙ্গে হওয়ার সুযোগ নেই। শিশুদের মামলার বিচার হবে শিশু আদালতে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মিরপুর থানার উপপরিদর্শক সাইফুল ইসলাম বলেন, যখন ওই কলেজছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হয়, তখন সে নিজের বয়স ১৮ বছর বলেছিল। এ জন্য মামলার প্রতিবেদনে তার বয়স ১৮ দেখানো হয়েছে।
অথচ আইনে এ বিষয়ে পুলিশকে বিশেষভাবে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। শিশু আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে, 'শিশুকে গ্রেপ্তার করিবার পর গ্রেপ্তারকারী পুলিশ কর্মকর্তা গ্রেপ্তারের কারণ, স্থান, অভিযোগের বিষয়বস্তু ইত্যাদি সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে শিশুবিষয়ক পুলিশ কর্মকর্তাকে অবহিত করিবেন এবং প্রাথমিকভাবে তাহার বয়স নির্ধারণ করিয়া নথিতে লিপিবদ্ধ করিবেন।'
আইনের (৪) ধারার (৩) উপ-ধারায় বলা হয়েছে, 'বয়স নির্ধারণের ক্ষেত্রে পুলিশ কর্মকর্তা জন্ম নিবন্ধন সনদ অথবা উক্ত সনদের অবর্তমানে স্কুল সার্টিফিকেট বা স্কুলে ভর্তির সময় প্রদত্ত তারিখসহ প্রাসঙ্গিক দলিলাদি উদ্?ঘাটনপূর্বক যাচাই-বাছাই করিয়া তাহার বয়স লিপিবদ্ধ করিবেন। তবে শর্ত থাকে যে, যে ক্ষেত্রে পুলিশ কর্মকর্তার নিকট প্রতীয়মান হয় যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি একজন শিশু কিন্তু সম্ভাব্য সকল চেষ্টা করিয়াও দালিলিক প্রমাণ দ্বারা তাহা নিশ্চিত হওয়া যায় না, সেই ক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তিকে এই আইনের বিধান অনুযায়ী শিশু হিসেবে গণ্য করিতে হইবে।'
আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, 'শিশুদের বিষয়ে স্পেসিফিক আইন রয়েছে। সেগুলো না মানলে সেসব পুলিশের শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু এ রাষ্ট্রে তার চর্চা নেই।'
১৭ বছর বয়সি শিশুর হাতে হাতকড়া
ঢাকার যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ সদস্য গিয়াস উদ্দিন হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার ১৭ বছরের কিশোরকে ২৮ জুলাই শিশু হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
এর আগে ২৭ জুলাই মহানগর হাকিম শান্তা আক্তার এই শিশুকে সাত দিনের জন্য রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দিয়েছিলেন, যা নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়।
তখন শিশু আইনের আলোকে তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দাবি ওঠে। ২০১৩ সালের শিশু আইন অনুযায়ী, শিশুকে রিমান্ডে পাঠানোর কোনো এখতিয়ার আদালতের নেই।
শিশুটির আইনজীবী মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, 'তাকে রিমান্ডে নেওয়ার আদেশ চ্যালেঞ্জ করে আমরা ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে রিভিশন দায়ের করি।'
শিশুটিকে 'রিমান্ডে নেওয়ার' বিষয়টির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিটের শুনানিতে বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকার ও বিচারপতি এসএম মনিরুজ্জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চে এসব তথ্য জমা দেওয়া হয়।
অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ মোরসেদ বলেন, 'শিশুটিকে রিমান্ডে নেওয়া হবে না। এ ব্যাপারে শিশু আইন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।'
জন্ম নিবন্ধন অনুসারে, তার জন্ম ২০০৭ সালের ১৯ এপ্রিল। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ঢাকার মাতুয়াইলে শিশু-মাতৃ স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের বিপরীত পাশে বসবাস করা এক পুলিশ সদস্যকে মেরে ঝুলিয়ে রাখার মামলায় ১৭ জন আসামির মধ্যে ১৬ নম্বরে রয়েছে সে।
বৃহস্পতিবার ঢাকার তৃতীয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবু্যনালে শিশুটির জামিন চেয়ে আবেদন করেন তার আইনজীবীরা। শুনানি শেষে বিচারক রোকসানা বেগম হ্যাপী জামিন নাকচ করে দেন।
এই শিশুটিকে আদালতে নেওয়ার সময় তার হাতে হাতকড়া ও দড়ি দিয়ে বাঁধা দেখা গেছে। অথচ হাতকড়া নিয়ে পুলিশ প্রবিধানের ৩৩০ ধারায় বলা হয়েছে, 'গ্রেপ্তারকৃত বন্দি এবং বিচারাধীন বন্দিকে তাহাদের পলায়ন বন্ধ করিবার জন্য যাহা প্রয়োজন তাহার চাইতে বেশি কড়াকড়ি করা উচিত নহে। হাতকড়া বা দড়ির ব্যবহার প্রায় ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় ও অমর্যাদাকর। বয়স বা দুর্বলতার কারণে যাহাদের নিরাপত্তা রক্ষা করা সহজ ও নিরাপদ, তাহাদের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি করা উচিত হইবে না।'
আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মীদের ভাষ্য
মানুষের অধিকার নিয়ে লড়াই করা আইনজীবী জেড আই খান পান্নার সঙ্গে শিশুদের রিমান্ড বিষয়ে কথা হয়। তিনি বলেন, 'আমাদের দেশে পুলিশের কাছে 'মাইট ইজ রাইট'। তারা সব সময়ই রিঅ্যাকশনারি ফোর্স। তাদের কাছে অধিকারের কোনো গুরুত্ব নাই। আর তারা তা বুঝতেও চায় না। শিশুদের বিরুদ্ধে এসব অত্যাচার আইনের শাসনের পরিপন্থি, অমানবিক ও নিষ্ঠুর কাজ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ।'
অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, 'শিশু আইনে একজন শিশুকে আসামি বলা যায় না, বলতে হয় আইনের সঙ্গে সংঘাতে আসা শিশু। আমাদের দেশে পুলিশ তা মানে না। শিশুদের সাজা খাটার ক্ষেত্রেও আইনে পরিবর্তন এসেছে। বদল করা হয়েছে নামও।'
তিনি আরও বলেন, 'আগে বলা হতো শিশু সংশোধনাগার। সংশোধনাগার বলা হলে তা শিশুদের বিরুদ্ধে চলে যায় বলে এখন আইন হয়েছে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র বলার। কেননা সংশোধনাগার বলা হলে শিশু অন্যায় করেছে বলে প্রতীয়মান হয়। আসলে শিশু ভুল করে, অন্যায় করে না। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক অনেক চার্টার আছে। মানবাধিকার বিষয়ে কনভেনশনেও শিশুদের অধিকার সমুন্নত রাখা হয়েছে। আমাদের দেশে এ সংস্কৃতি চালু হতে অনেক দেরি হবে। কিন্তু আমাদেরই এর দায়িত্ব নিতে হবে।'
সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের নেতা অ্যাডভোকেট পারভেজ হাসেম বলেন, অপেক্ষাকৃত কম বয়সি কাউকে ধরতে গেলে বাবা-মা বা তার আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে তাদের জন্মসনদ অথবা স্কুল-কলেজের সার্টিফিকেট দেখা উচিত পুলিশের।
তিনি আরও বলেন, 'আটক বা গ্রেপ্তার যাই হোক না কেন, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা মেনে তা করা উচিত। এ ক্ষেত্রে আমাদের দেশে আইনের অপব্যবহার রয়েছে। শিশুদের রিমান্ডে নেয় যে পুলিশ, তার শাস্তি হওয়া দরকার।'
আইনজীবী আমিনুল গণী টিটো বলেন, 'পূর্ণবয়স্ক মানুষকে যদি কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুধু জিজ্ঞাসাবাদই করা হয়, তাকে কোনো অত্যাচার বা প্রহার করা হয় না, তাদের বেলাতেও আমি দেখেছি; রিমান্ড থেকে ফিরার পর তারা বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েন। সেখানে একজন শিশুকে রিমান্ডে নেওয়ার প্রসঙ্গই আসে না। এসব ক্ষেত্রে দোষী পুলিশের সাজা না হলে এমন ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে আরও বাড়বে।'
বিষয়গুলো জানতে ঢাকা মহানগর পুলিশের অপরাধ (তথ্য ও প্রসিকিউশন) বিভাগের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ আনিসুর রহমানের সঙ্গে কথা বলতে দুই দিন গিয়েও তাকে কার্যালয়ে পাওয়া যায়নি। মোবাইল ফোনে কল দিলেও তা ধরেননি তিনি।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি আবদুলস্না আবু শিশুদের রিমান্ড বিষয়ে বলেন, রিমান্ড বিষয়ে শিশু আইন অনুযায়ী প্রবেশন কর্মকর্তার সাহায্য নেওয়া উচিত পুলিশের। তিনি আরও বলেন, 'আমাদের এখানে নারী-শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবু্যনালগুলো শিশু আদালতের দায়িত্ব পেয়েছেন। উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে শিশু আইনে শিশুদের বিচার করতে গেলে কালো কোর্ট ও গাউনও পরা যাবে না।'