স্বামীর মৃতু্যতে তছনছ সংসার

প্রকাশ | ০৩ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

লক্ষ্ণীপুর প্রতিনিধি
ভালোবেসে এতিম নুরনাহার বেগমকে বিয়ে করেন স্যানিটারি মিস্ত্রি মো. ফয়েজ। তাদের সংসারে ফুটফুটে একটি ছেলের জন্ম হয়। ঢাকা শহরে একটি ভাড়া বাসায় ভালোই কাটছিল তাদের দিনকাল। কিন্তু কে বা কার আগ্নেয়াস্ত্রের দুটি গুলিতে ফয়েজের জীবন প্রদীপ নিভে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একমাত্র সন্তানকে নিয়ে অন্ধকারে তলিয়ে গেছে নুরনাহারের সংসার। কোটাবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ২১ জুলাই সন্ধ্যায় কাজ শেষে ভাড়া বাসায় ফেরার পথে যাত্রাবাড়ীর সাইনবোর্ড এলাকায় গুলিতে মারা যান ফয়েজ। স্যানিটারি মিস্ত্রি হিসেবে দৈনিক হাজিরায় কাজ করতেন তিনি। তার বাড়ি লক্ষ্ণীপুরের রায়পুর উপজেলার উত্তর চর আবাবিলের ইউনিয়নের পশ্চিম ঝাউডগি গ্রামে। তার পিতা কাঠমিস্ত্রি আলাউদ্দিন। ফয়েজের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, ফয়েজ অল্প বয়সেই কাজের উদ্দেশ্যে মালদ্বীপ যান। করোনাকালে চাকরি হারিয়ে বাড়ি ফিরতে হয় তাকে। ফের পরিবারের হাল ধরতে চাকরি খুঁজতে তিনি ঢাকায় যান। সেখানে স্যানিটারি মিস্ত্রি (পাইপ ফিটিংস) হিসেবে কাজ শুরু করেন। এর মধ্যেই গাজীপুরের টঙ্গীর বাসিন্দা এতিম নুরনাহারকে ভালোবেসে বিয়ে করেন। ১৮ মাস আগে তাদের সংসারে একটি পুত্র সন্তান জন্ম নেয়। তার নাম রাফি মাহমুদ। ঘটনার পর গুলিবিদ্ধ ফয়েজকে তার পরিচিত স্যানিটারি ঠিকাদার মো. কাশেম হাসপাতালে নিয়েছিলেন। ফোনে কথা হয় তার সঙ্গেও। তিনি বলেন, 'অ্যাম্বুলেন্সে করে প্রথমে ফয়েজকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে যাই। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তার মাথা ও ঘাড়ে গুলি লাগে। পরে তার মরদেহ লক্ষ্ণীপুর গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। ফয়েজ খুব শান্ত ও ভদ্র স্বভাবের ছিল। দৈনিক ৭০০ টাকা তিনি মজুরি পেতেন। ওই টাকায় স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে তিনি যাত্রাবাড়ী সাইনবোর্ড এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন।' ফয়েজের মা সবুরা বেগম বলেন, 'ঘটনার আগমুহূর্তে আমি ফয়েজকে কল দিয়েছি। সে বলছিল কাজ শেষে বাসায় যাচ্ছে। এরপর বলছিল, মা রাস্তায় অনবরত গুলি হচ্ছে। এখন ফোন রাখো। কথা শেষ না হতেই বিকট শব্দ শুনতে পাই। এরপর আর তার কথা শুনতে পাইনি। বারবার কল দিলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।' এদিকে স্বামীকে হারিয়ে পৃথিবীতে ফের একা হয়ে গেলেন নুরনাহার। শ্বশুরবাড়ির লোকজন গরিব হওয়ায় সেখানে ঠাঁই নিতে পারেননি তিনি। স্বামীর মরদেহ দাফন শেষে শিশু রাফিকে বুকে করে গাজীপুরের টঙ্গী এলাকায় ফিরতে হয় তাকে। মুঠোফোনে তিনি বলেন, 'বাবা-মা, ভাই-বোন কেউই নেই। ফয়েজ আমাকে বিয়ে করে আপন করে নিয়েছিল। সে আমার একমাত্র আশ্রয় ছিল। তাকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। এখন আমার আর কেউ নেই। কে দেখবে আমাকে আর আমার ছোট্ট রাফিকে। কী দোষ ছিল ফয়েজের, কে দেবে এর জবাব? আমি এখন বড় একা।' নুরনাহার আরও বলেন, 'শ্বশুরবাড়ির লোকজনও গরিব। সেখানে আশ্রয় নিয়েও ফয়েজের মরদেহ দাফন শেষে টঙ্গীতে এক খালার বাসায় এসে আশ্রয় নিয়েছি। খালাও অসুস্থ, তার পরিবারও থাকে অর্ধাহারে-অনাহারে।' নুরনাহারের খালা বৃদ্ধা হাজেরা বেগম বলেন, 'আমি অন্ধ ও অসুস্থ। আমার একমাত্র ছেলেটিও পঙ্গু। আমাদের ওপর আলস্নাহ এত নির্দয় কেন? এত কষ্ট নিয়ে আমরা কোথায় যাব? নুরনাহার ও তার ছেলেটার দিকে আপনারা সবাই দেখবেন। আমাদের কেউ নেই।' অন্যদিকে ফয়েজের মা সবুরা বেগম ও বাবা আলাউদ্দিন ছেলের শোকে অনবরত কান্না করছেন। ছেলের মৃতু্যর ৯ দিন পার হলেও তাদের কান্না থামেনি। ফয়েজ ছিল তাদের তিন ছেলেমেয়ের সবার বড়। তার কবরের পাশে বার বার ছুটে যাচ্ছেন মা সবুরা। আর ছেলের শোকে হাউমাউ করে কাঁদছেন। প্রতিবেশীরাও তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না। ফয়েজের বাবা আলাউদ্দিন বলেন, 'ফয়েজ একজন শ্রমিক ছিল। কোনো ধরনের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। কী দোষে তাকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। সেতো আর ফিরে আসবে না। তার স্ত্রী-সন্তানকে কে দেখবে। আমি চট্টগ্রাম পোর্টে চাকরি করতাম। সেনা সরকারের সময় এক আন্দোলনে চাকরি হারিয়েছি। এবার আরেক আন্দোলনে আমার ছেলেকে হারালাম। কে বা কার আগ্নেয়াস্ত্র থেকে ছোড়া দুটি গুলি আমার ছেলেটাকে শেষ করে দিল। আমি ফয়েজ হত্যার বিচার কার কাছে চাইব?'